প্রসঙ্গঃ আমার গ্রাম নহাটা ---সেকাল- একাল
দশ দিন পর বিদেশ থেকে ফিরে নিজ এলাকার খবর শুনে মনটা ভারী হয়ে গেলো, শাহ বাউল আব্দুল করিমের বিখ্যাত গানটি বারবার মনে পড়ছে।
“আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম
গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান ঘাটুগান গাইতাম ॥
হিন্দু বাড়িত যাত্রা গান হইত
নিমন্ত্রণ দিত আমরা যাইতাম
কে হবে মেম্বার কে হবে চেয়ারম্যান
আমরা কি তার খবর লইতাম ॥
বিবাদ ঘটিলে পঞ্চাইতের বলে
গরিব কাঙালে বিচার পাইতাম
মানুষ ছিল সরল ছিল ধর্মবল
এখন সবাই পাগল বড়লোক হইতাম ॥
করি ভাবনা সেদিন আর পাব না
ছিল বাসনা সুখী হইতাম
দিন হতে দিন আসে যে কঠিন
করিম দীনহীন কোন পথে যাইতাম ॥
১৯৭৯ সালে শিক্ষা ও জীবিকার জন্য ছেড়ে এসেছি গ্রামের বাড়ি নহাটা । মাঝে মধ্যে নাড়ির টানে গ্রামে যাওয়া পড়ে। সময়ের সাথে বাউল করিমের গানের মতো- বদলে গেছে আমার গ্রামের সামাজিক পরিবেশ। দেশের অন্য এলাকার তুলনায় যেন একটু বেশিই বদলেছে। সে বদলের বেশির ভাগই নেতিবাচক পরিবর্তন।
দেশের বাইরে বসে শুনলাম ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান তৈয়েবুর রহমান তুরাফ কে প্রকাশ্যে বাজারের মধ্যে হামলা করে আহত করা হলো। কয়েকমাস আগে ইউনিয়ন আঃলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক হাবিব মিয়াকে বাজারের মধ্যে পিটিয়ে আহত করা হয়। উভয় ক্ষেত্রেই হামলাকারীরা আক্রান্ত ব্যক্তিদের সাথে একই দল করতেন। বিশেষ কোন সুবিধা আদায় না হওয়ায় তারা দল বদল করে হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে।
শুনা কথা- থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা কামাল লিটন কে শায়েস্তা করার ষড়যন্ত্রকে কেন্দ্র করে পানিঘাটায় জোড়া খুনের ঘটনা ঘটেছে। এ সব ঘটনা এক ভয়াল অশনি সংকেত বহন করে। যে কোন সময় যে কারো সম্মান নষ্ট হতে পারে, মৃত্যু হতে পারে, তৈরি হতে পারে অরাজকতা। সমাজে কায়েম হবে ফ্রাঙ্কেনস্টাইল। সামাজিক কাঠামোর চেইন অফ কমান্ড ভেঙ্গে পড়বে। পেশি শক্তির কাছে সব কিছু পরাজিত হবে। নেতা. নেতৃত্ব , বয়োজৈষ্ঠের সম্মান , জীবনের নিরাপত্তা বলে কিছু থাকবে না।
আগের কালে গ্রামের , বংশের, দলের মাতুব্বর বা নেতৃত্ব দিতেন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিরা, নেতারা ছিলেন সৎ, ন্যায়নিষ্ঠ এবং দল, বেদল সব মানুষই নিজের দলের সাথে অন্য নেতাদের সম্মান করতেন, মান্য করতেন। গায়ে হাত তোলা তো দুরের কথা, বয়োজেষ্টদের, নেতাদের, সম্মানীত মানুষকে কেউ অপমান করার কথা কখনো চিন্তাও করতে পারতেন না। সেই সামাজিক কাঠামো একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
আগে বংশের নেতা হতেন সবচেয়ে বয়োজৈষ্ট ব্যক্তি, তার কথার বাইরে কেউ যাওয়ার সাহস পেতেন না। এখন একই পরিবারের চার সদস্য থাকলে মাতুব্বর তিন জন। কেউ কাউকে মানে না। আগে কেউ কোন অন্যায় করলে তার বংশের নেতার কাছে বিচার দিলে সুবিচার পেতেন সবাই। এখন বিচার দিলে নেতা বলেন, “ ও তো আমার কথা মানে না। “
আগে কোন নেতা ঘুষ খেয়ে কখনো বিচার সালিশে অন্যায় রায় দিয়েছেন কেউ বলতে পারবেন না। এখন পয়সা খেয়ে ধর্ষক, যৌন হয়রানীকারীদেরকেও রক্ষা করার ঘটনাও ঘটে।
মারামারি কাইজা আগেও ছিল, তবে এখনকার মতো নৃশংসতা ছিল না, এতো ঠুনকো বিষয়ে কেউ মারামারিতে জড়াতো না। মানুষ ন্যায় আর অন্যায় বিচার করতো। আগে মারামারির দরকার হলে দুই পক্ষ ঘোষণা দিত, অমুক জায়গায়, অমুক সময়ে হবে। যার অধিকাংশই অন্যান্য গ্রামের মাতুব্বরেরা এসে থামিয়ে দিতেন, হতে পারত না। আর হলেও সেটা মাঠেই শেষ। তারপর আবার সবাই মিলেমিশে চলতো।
আগে ভিন্ন মতের নেতারা এক সাথে বসে চায়ের দোকানে আড্ডা দিতেন। দলীয় কর্মীদের মধ্যেও কোন ভেদাভেদ ছিল না। এখন দু দল করলে কেউ কারো সাথে কথা বলে না।
এখনকার মতো হরহামেশা শক্তির দাপট দেখানো, ঘরবাড়ি ভাঙ্গা, একাকী পেলে হামলা করা , এগুলো ছিল না। একটা বাড়ি ভাঙ্গলে ঐ পরিবারের ছোট শিশুদের মনের উপর প্রচণ্ড ভয়াবহ প্রভাব পড়ে, মেয়ে ছেলেরা আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে।
গত কয়েক মাসে পানিঘাটায় দুজনকে গলা কেটে হত্যা। ফূলবাড়িতে একজনকে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। গত দশ – পনেরো বছরে মার্ডারের সংখ্যা কত গুনলে গা শিউরে ওঠে। আমরা কী বর্বর আদিম মানুষের চেয়েও খারাপ হয়ে গেলাম !! একটা হত্যা একটা পরিবারের জন্য কতটা কষ্টের কতটা ক্ষতির তা শুধু ঐ পরিবারের মানুষেরাই জানে। আচ্ছা একবার চিন্তা করুন তো যদি আপনার সাথে এমনটা হয়।
আগে মানুষ জনপ্রিয়, ভদ্র, বিনয়ী, সৎ ব্যক্তিদের মেম্বার চেয়ারম্যান বানাতেন। টাকা পয়সা নিয়ে ভোট দিতেন না। এখন আমাদের এলাকায় আমরা টাকা দিয়ে ভোট কিনি বা কিনতে হয়। আমাদের একটা অংশ যোগ্যতা বিচার না করে অর্থের বিনিময়ে ভোট দিই। টাকার বিনিময়ে কর্মীরা ভোট চাইতে যান। আগে বড় জোর পান-বিড়ি খাওয়াতে হতো। এখন চেয়ারম্যান নির্বাচনে কয়েক কোটি টাকা লাগে।
চেয়্যারম্যার মেম্বার হওয়ার পরেও নিজের একটা চাটুকর বা সুবিধাবাদি চামচার দলকে বিবিধ সুবিধা দিতে না পারলে দল অচল। ফল যা তাই হয়। এরপর খরচের টাকা উঠাতে বয়স্ক ভাতা, বিধবাভাতা সহ অন্যান্য সরকারি সুবিধা ভোগী কার্ড বিতরণে টাকা আদায় করা হয়। জনগণের জন্য দেয়া সরকারি বরাদ্দের একটা অংশ নয় ছয় হয়ে যায়।
আগে দশ মাইল দুর থেকে আমাদের গ্রামের স্কুলে মানুষ পড়তে আসতো আর এখন এই এলাকা থেকে বেরইল, জোকায় পড়তে যায়। অবশ্যই এর পেছনে কারণ আছে। আমরা আমাদের বিদ্যালয় গুলোর পড়ালেখার পরিবেশ ধরে রাখতে পারি নাই বা বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে নষ্ট করে ফেলেছি।
আশপাশের দশ বারো মাইলের মধ্যে নহাটার মতো বড় হাট বাজার আর নেই । অথচ খাজনা বৃদ্ধির যন্ত্রণায় এখন কৃষক তার পণ্য বাজারে নিয়ে আসতে ভয় পান। এত করে মূল ক্ষতি হবে বাজারের দোকানদারদের।
ইন্দ্রপুরের মতো বিখ্যাত ঈদগাঁতেও দলাদলির ফলে এখন আর আগের মতো সব মানুষ আসে না। নহাটা কালিবাড়িতেও দলাদলি। এলাকার মানুষকে তাদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন রাখতে বলব, এই দুই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নিয়ে বিভেদ কী চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় না আমরা আসলে কতটা নিচে দিকে চলে যাচ্ছি।
এখন দল বদল মাছ ভাত। সকালে এ দল তো বিকালে বি দল। পরের দিন আবার এ দল। তার মানে আমাদের দলাদলির পেছনে আদর্শ বলে কিছু নেই, যা আছে সব স্বার্থের খেলা।
আমি বিশ্বাস করি এলাকার সাধারণ মানুষ শান্তি চায়। এলাকার শান্তি , উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য এই মারামারি, হানাহানি, অন্যায়, অবিচার বন্ধের কোন বিকল্প নেই।
১। নেতৃবৃন্দ নিজেদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তুলুন, আপনাদের বিভেদ এর কারণে সুবিধাবাদীরা সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করে। অন্যদল থেকে অন্যায় করে কেউ আপনার দলে এলে তাকে দলে নিবেন না।
২। বাইশ গ্রামের মানুষ এক সাথে বসে সিদ্ধান্ত দিন আমরা অন্যায়কে প্রশ্রয় দিব না, ন্যায়ের পক্ষে থাকব। মারামারি করব না, ন্যায় অন্যায় বিচার করুন। দয়া করে নিজের দলের কারো অন্যায়কে প্রশ্রয় দিবেন না।
৩। ঘুরে ফিরে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষেরাই অশান্তি, মারামারি লাগিয়ে রাখে। এদের নিয়ন্ত্রণ করুন বা পরিহার করুন।
৪। পাঁচ বছর পর পর নির্বাচন হবে। যিনি নির্বাচিত হবেন তাকে কাজ করতে দিতে হবে, তবে সে যদি অন্যায় করে , দুর্নীতি করে তবে আইন সম্মত পথেই তার প্রতিকারের পথ খোলা আছে। আবার যিনি নির্বাচিত হবেন, তাকে মনে রাখতে হবে নির্বাচনী এলাকার সকল মানুষের দ্বায়িত্ব কিন্তু আপনার উপর। সব মানুষকেই তার সমান চোখে দেখতে হবে। তাকে ন্যায় ও সততার মানদণ্ড বজায় রাখতে হবে, না হলে অধর্ম হবে। পাঁচ বছর পর আবার নির্বাচনে মানুষ যাচাই করবে কে ভাল কে মন্দ।
( দয়া করে এমন কোন মন্তব্য করবেন যা এলাকার অশান্তিকে আরো উসকে দেয়। আমার লেখার সাথে অনেকের দ্বিমত থাকতে পারে, তাদের সমালোচনা মাথা পেতে গ্রহন করব)