সিনেমা বা টিভি ফ্রেমের অ্যাসপেক্ট রেশিও বা আকৃতির অনুপাত কেন গুরুত্বপূর্ণ
বর্তমানে আধুনিক বিশ্বের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ হল সিনেমা। কিন্তু একটা সিনেমা বানাতে কত প্রচেষ্টার দরকার হয় আর কত কিছুর দিকে খেয়াল রাখতে হয়, তা নিয়ে সাধারণ দর্শকদের খুব বেশি ধারণা নেই।
সিনেমা বানানোর সময় রঙের ব্যবহার বা কালার গ্রেডিং কীভাবে করা হবে, প্রতিটি দৃশ্যের ফ্রেমিং কেমন হবে কিংবা ‘অ্যাসপেক্ট রেশিও’ কোনটা হবে, এ ধরনের অনেক বিষয় নির্মাতাদের মাথায় রাখতে হয়। মোটকথা, দর্শকদের সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা কেমন হবে তা নির্ধারণ করে দেয় এসব কিছু।
বিশেষ করে চলচ্চিত্র নির্মাতাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এক বিষয় হল অ্যাসপেক্ট রেশিও। নির্দিষ্ট একটি সিনেমা কীভাবে ফ্রেমে বন্দি করা হবে, সেটা নির্ভর করে এর অ্যাসপেক্ট রেশিও’র ওপর। এমনকি, সময়ের সাথে সাথে অ্যাসপেক্ট রেশিও পাল্টে যাওয়ার ফলে দৈনন্দিন জীবনে আমাদের ভিডিও ক্লিপ দেখার অভিজ্ঞতাও পাল্টে গেছে।
টিভি সেটও একটা সময় বর্গাকার বাক্সের আকারে তৈরি করা হত। অথচ সময়ের সাথে সাথে তা পাল্টে গেছে। এখন বেশিরভাগ টেলিভিশনই আয়তকার। এর সঙ্গেও অ্যাসপেক্ট রেশিও’র সম্পর্ক আছে।
.
# অ্যাসপেক্ট রেশিও বা আকৃতির অনুপাত আসলে কী?
প্রতিটা ভিডিও, কিংবা প্রতিটা সিনেমাই অনেকগুলি স্থিরচিত্র বা ছবি পরপর সাজিয়ে তৈরি করা হয়। এসব স্থিরচিত্রকে বলা হয় ফ্রেম। প্রতি সেকেন্ডে স্ক্রিনে যতগুলি ফ্রেম দেখা যায়, তাকে ‘ফ্রেম পার সেকেন্ড’ বা ‘এফপিএস’ (FPS) বলা হয়। একটি সিনেমায় ‘এফপিএস’কে অনেক সময় ‘ফ্রেম রেট’ও বলা হয়।
এখানে প্রতিটা ফ্রেম দৈর্ঘ্যে আর প্রস্থে কতখানি লম্বা আর চওড়া, সেটাই মূলত অ্যাসপেক্ট রেশিও বা আকৃতির অনুপাত। সহজে বললে, অ্যাসপেক্ট রেশিও হল পর্দার মাপ অনুসারে সিনেমার ফ্রেমের আয়তন বা অনুপাত।
তাই যেকোনো স্ক্রিন বা পর্দায় একটি চলচ্চিত্রের সম্পূর্ণ ফ্রেমটা দেখতে হলে পর্দার আয়তনও তেমন থাকতে হবে। অর্থাৎ, যেই অ্যাসপেক্ট রেশিও’তে সিনেমাটি নির্মাণ করা হয়েছে, সেটা পর্দায় দেখার জন্য পর্দার আয়তনের সঙ্গে অ্যাসপেক্ট রেশিও’র সামঞ্জস্য থাকতে হয়।
বিষয়টা আরো ভালভাবে বোঝার জন্য প্রথমে চিন্তা করুন একটি সিনেমা আপনি মুভি থিয়েটারে গিয়ে কীভাবে দেখবেন, সে ব্যাপারে। এরপরে ভাবুন, একই সিনেমা আপনার টেলিভিশন, স্মার্টফোন বা ট্যাবলেটের মত ডিভাইসে দেখতে কেমন মনে হবে? মোটকথা, সিনেমাটা আপনি যেখানেই দেখুন না কেন, সেটার ফ্রেমের আকার-আকৃতি ঠিক একই রকম থাকবে। এ কারণেই অ্যাসপেক্ট রেশিও এত গুরুত্বপূর্ণ।
অর্থাৎ, স্ক্রিন বা পর্দার আকার যেমনই হোক না কেন, অ্যাসপেক্ট রেশিও ঠিক থাকলে দর্শকরা সিনেমার প্রতিটা ফ্রেমই ঠিকঠাক দেখতে পান। এতে তাদের সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতায় প্রভাব পড়ে না।
বর্তমানে নির্মিত প্রায় সবগুলি স্মার্টফোন বা টেলিভিশনের আকৃতির মধ্যে সামঞ্জস্য আছে। সবগুলিই আয়তকার। এর কারণ হল, মিডিয়ার দুনিয়ায় এখন সিংহভাগ ভিডিও ক্লিপ যেই অ্যাসপেক্ট রেশিও অনুসারে নির্মাণ করা হয়, তার অনুপাত হল ১৬:৯। ফ্রেমের আকৃতির এই অনুপাত বা অ্যাসপেক্ট রেশিও খুব সহজেই আয়তকার স্ক্রিন বা পর্দার পুরোটা জুড়ে দেখা যায়।
প্রশ্ন জাগতে পারে, ঠিক ১৬:৯ অ্যাসপেক্ট রেশিও কেন এখন এত বেশি দেখা যায়? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে অতীতে অন্যান্য যেসব অ্যাসপেক্ট রেশিও’র অনুপাত প্রচলিত ছিল, সেসব সম্পর্কে ধারণা নিতে হবে।
.
# সময়ের সাথে সাথে অ্যাসপেক্ট রেশিও’তে আসা পরিবর্তন
১৮৯১ সালে নতুন এক ধরনের ভিডিও ক্যামেরা উদ্ভাবনের জন্য প্যাটেন্ট জমা দেন আমেরিকান উদ্ভাবক থমাস আলভা এডিসন। তার বক্তব্য অনুসারে, ‘কিনেটোগ্রাফ’ নামের সেই ক্যামেরা যন্ত্রটি “চোখের জন্য সেটাই করবে, ফোনোগ্রাফ যন্ত্র যেটা কানের জন্য করেছিল।”
তবে যন্ত্রটি তৈরি করার আগে এডিসন আর তার সহকর্মীদের ঠিক করতে হয়েছিল সেটা দিয়ে ধারণ করা চিত্র বা ফ্রেমের আকৃতি বা আকার কেমন হবে।
আমেরিকান ফটোগ্রাফি প্রতিষ্ঠান ‘কোডাক’ সে সময়ে বাজারে থাকা তাদের বক্স ক্যামেরায় ব্যবহারের জন্য ৭০ মিলিমিটার এর রোল ফিল্ম বিক্রি করত।
এদিকে এডিসনের কোম্পানিতে প্রকৌশলী হিসেবে তখন কাজ করতেন উইলিয়াম ডিকসন। তিনি কোডাকের রোল ফিল্ম নিয়ে সেটা কেটে অর্ধেক করে ব্যবহার করেছিলেন তাদের কিনেটোগ্রাফ যন্ত্রের জন্য। তখন থেকেই ৩৫ মিলিমিটার ফিল্মের জন্ম। আজও সিনেমা শিল্পে ৩৫ মিলিমিটার ফিল্ম দিয়ে ভিডিও ধারণ করার প্রচলন রয়ে গেছে।
বলা হয়ে থাকে ইতিহাসের প্রথম চলচ্চিত্রের নাম হল ‘রাউন্ডহে গার্ডেন সিন’। চলচ্চিত্রটি ১:১ অ্যাসপেক্ট রেশিও’তে শ্যুট করা হয় এবং দর্শকদের দেখানো হয়। ৪.৩৩ সেকেন্ডের এই চলচ্চিত্রে মোট ৫২টি ফ্রেম বা চিত্র সংযুক্ত ছিল। এবং তাতে প্রতি সেকেন্ডে ১২টি ফ্রেম প্রদর্শন করা হয়েছিল।
১:১ অনুপাতের অ্যাসপেক্ট রেশিও’তে নির্মিত এই সিনেমা বর্গাকার বাক্স আকৃতির পুরোনো টেলিভিশন সেটে কিন্তু খুব সুন্দরভাবে ফিট হবে। ‘ক্যাথোড রে টিউব’ বা ‘সিআরটি’ (CRT) টিভি নামের সেসব টেলিভিশন অন্তত বিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত খুবই জনপ্রিয় ছিল।
অন্যদিকে ইতিহাসের প্রথম বর্ণনামূলক চলচ্চিত্র ছিল ১ মিনিটের একটি ডকুমেন্টারি। শ্রমিকরা ‘লুমিয়ের কারখানা’ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, এমন একটা দৃশ্য বন্দি করা হয়েছিল সেই ডকুমেন্টারিতে। যুগান্তকারী এই চলচ্চিত্রের অ্যাসপেক্ট রেশিও ছিল ১.৩৩:১। পরবর্তীতে একই মাপের অ্যাসপেক্ট রেশিও ৪:৩ হিসেবে পরিচিতি পায়।
৪:৩ অ্যাসপেক্ট রেশিও খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সিনেমা শিল্পের মানদণ্ড হয়ে ওঠে। কারণ তা এডিসন উদ্ভাবিত ৩৫ মিলিমিটার ফিল্মের ভিডিও ক্যামেরা দিয়ে ধারণ করা হত।
একই সময়ে ‘অ্যাকাডেমি অফ মোশন পিকচার আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান—এখন যারা অস্কার আয়োজন করে থাকে, তারা—অ্যাসপেক্ট রেশিও’র নতুন একটি মানদণ্ড নির্ধারণ করে। ‘অ্যাকাডেমি রেশিও’ নামে পরিচিত এই অ্যাসপেক্ট রেশিও’র মাপ ছিল ১.৩৭৫:১।
১৯৫০ এবং ৬০ এর দশকে ভিডিওগ্রাফিতে বড় ধরনের দুটি প্রযুক্তির উদ্ভাবন হয়। ‘প্যানাভিশন’ এবং ‘সিনেমাস্কোপ’ নামের সে দুটি ভিডিও ধারণের প্রযুক্তি আজও সিনেমা নির্মাতাদের কাছে জনপ্রিয়। এই ফরম্যাটে ২.৩৫:১ অ্যাসপেক্ট রেশিও ব্যবহার করা হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে “অ্যাভেঞ্জারস এন্ডগেম” এবং “১৯১৭” (1917) নামের দুটি সিনেমা এই ফরম্যাটে নির্মিত চলচ্চিত্রের উদাহরণ। যুক্তরাষ্ট্রে আরেকটি জনপ্রিয় অ্যাসপেক্ট রেশিও’র মাপ হল ১.৮৫:১।
এভাবে চলচ্চিত্র নির্মাতারা নতুনভাবে সিনেমা তৈরির চেষ্টা করতে থাকেন। ফলে তাদের কাজের মধ্য দিয়ে আরো নতুন নতুন ফরম্যাট এবং অ্যাসপেক্ট রেশিও আবিষ্কৃত হতে থাকে। কিন্তু এর ফলে একটা বড় সমস্যা দেখা দেয়। সেটা হল, এত সব হরেক রকম ফরম্যাট বা অ্যাসপেক্ট রেশিও কীভাবে একটা বর্গাকার টিভির স্ক্রিনে দেখানো যাবে?
.
# নিখুঁত সমাধান - ১৬:৯
বিভিন্ন ধরনের মাল্টিমিডিয়া ডিভাইসে ভিডিও ক্লিপ দেখার জন্য ১৬:৯ অ্যাসপেক্ট রেশিও কেন এত প্রচলিত? এর মূল কারণ হল, ৪:৩ এবং ২.৩৫:১ এর গড় করলে ১৬:৯ এর কাছাকাছি একটা মান পাওয়া যায়।
অর্থাৎ, ১৬:৯ এর মধ্যে অনেক ধরনের অ্যাসপেক্ট রেশিওতে নির্মিত ভিডিও ক্লিপ দেখা সম্ভব হয়।
যেকোনো অনুপাতের পর্দা বা স্ক্রিনে কোনো ধরনের বিকৃতি ছাড়া সব ধরনের চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা সম্ভব নয়। কিন্তু অ্যাসপেক্ট রেশিও ১৬:৯ রাখা হলে মোটামুটি সব ধরনের ভিডিও একই স্ক্রিনে দেখা সম্ভব।
দুটি পদ্ধতির মাধ্যমে ১৬:৯ অ্যাসপেক্ট রেশিওতে নির্মিত স্ক্রিনে সব মাপের ভিডিও দেখা যায়। সেগুলি হল:
১. পিলারবক্সিং: কোনো ভিডিও চলাকালীন ফ্রেমের বাম এবং ডানদিকে কালো রঙের দুটি বার থাকলে বুঝতে হবে এই ভিডিওতে পিলারবক্সিং আছে। চওড়ার হিসাবে স্ক্রিনের তুলনায় কোনো ভিডিওর ফ্রেমের প্রস্থ কম হলে পিলারবক্সিং পদ্ধতি কাজে লাগানো হয়।
২. লেটারবক্সিং: ২.৩৫:১ অ্যাসপেক্ট রেশিও’র মত বিভিন্ন ধরনের ওয়াইডস্ক্রিন ফরম্যাটের ভিডিও দেখতে হলে লেটারবক্সিং পদ্ধতি কাজে লাগানো হয়। এতে করে ১৬:৯ অ্যাসপেক্ট রেশিওতে নির্মিত স্ক্রিনে সিনেমার সম্পূর্ণ ফ্রেম দেখার জন্যে স্ক্রিনের ওপরে এবং নিচে কালো রঙের বার দেখা যায়।
আপনি ‘নেটফ্লিক্স’ ব্যবহার করে থাকলে হয়ত লক্ষ্য করেছেন যে, সেখানে ‘ফিট-টু-স্ক্রিন’ কিংবা ‘অরিজিনাল’ এর মত ভিডিও দেখার বিভিন্ন ধরনের বিকল্প অপশন থাকে। বিভিন্ন ধরনের মিডিয়া প্লেয়ার অ্যাপ্লিকেশনেও এ ধরনের অপশন দেখা যায়।
আধুনিক সব ডিভাইসের আয়তকার স্ক্রিনে অনেক ভিডিও কিংবা সিনেমার ফ্রেমের পুরোটা দেখতে হলে পিলারবক্সিং বা লেটারবক্সিং পদ্ধতি কাজে লাগাতে হয়। এতে স্ক্রিনের দুপাশে কালো রঙের বার দেখা যায়। কালো রঙের বারগুলি দেখতে না চাইলে আপনি ‘ফিট-টু-স্ক্রিন’ অপশন কাজে লাগাতে পারেন। কিন্তু এভাবে অ্যাসপেক্ট রেশিও উপেক্ষা করা হলে সিনেমার পুরো ফ্রেমটা স্ক্রিনে দেখা যাবে না।
যাহোক, ওপরে বর্ণিত এসব সুবিধার কারণে ১৬:৯ অ্যাসপেক্ট রেশিও এখন মিডিয়া ও গণমাধ্যম শিল্পের মানদণ্ডে পরিণত হয়েছে। সিনেমা, ভিডিওগেম বা টিভি-শো’র মত সব ধরনের হাই-ডেফিনিশন কন্টেন্ট এখন ১৬:৯ অ্যাসপেক্ট রেশিওতে ধারণ করা হয়। এমনকি, পুরনো দিনের সব মিডিয়া কন্টেন্ট আধুনিক ডিভাইসে দেখার উপযোগী করে রিমাস্টার করার জন্যও ১৬:৯ অ্যাসপেক্ট রেশিও নির্ধারণ করা হয়।
সবশেষে বলা যায়, অ্যাসপেক্ট রেশিও এমন একটি ধারণা, যে ব্যাপারে সাধারণ দর্শকরা খুব একটা মাথা ঘামান না। এতে করে আমরা বুঝতে পারি না যে, বর্তমানে সিনেমা বা টিভি-শো’র মত যত ধরনের ভিডিও দেখি, তা নির্মাণের ওপর এর প্রভাব কত বেশি।
লেখক এবং অধ্যাপক পল ডিউরো তার ‘রেটোরিক অফ দ্যা ফ্রেম’ বইয়ে যেমনটা লিখেছেন: কোনো সিনেমায় থাকা ফ্রেম অদৃশ্য বলে মনে হওয়ার মানে এই না যে, সেটা আসলেই অদৃশ্য। যত যাই হোক, আমরা আমাদের চারপাশে যা দেখি, সবই একেকটা ফ্রেম, যদি আমাদের তা দেখার চোখ থাকে।
#ফ্রেম #সিনেমা #টিভি