খেসারি হলো জনগণের জন্য গাছন্ত মাংস!
কারণ খেসারি ডালে শতকরা প্রায় ২০-৩০ ভাগ পর্যন্ত প্রোটিন থাকে! এজন্য কম খরচে প্রচুর পরিমাণ আমিষের চমৎকার একটি উৎস।
খেসারি কলাই বা খেসারির ডাল বা Grass Pea যেকোন জলবায়ুতে টিকে থাকার ক্ষমতাসম্পন্ন বিধায় ফলন হয় প্রচুর, কিন্তু খরচ আর শ্রম প্রয়োজন হয় কম! ফলে আগে বঙ্গে যখন খরা মৌসুম চলতো, তখন কৃষকরা ব্যাপক পরিমাণে খেসারি উৎপাদন করতো।
অতীতে বঙ্গের একজন গৃহস্থ নারী কেবল খেসারি ডাল দিয়েই পুরো এক বেলার খাবার রান্না করে ফেলত– খেসারির খিচুড়ি, খেসারি দিয়ে তেঁতুলের ঝোলের তরকারি, খেসারি ভর্তা, পেঁয়াজু, খেসারির ডালভাজি ইত্যাদি। গ্রামবাংলার মানুষ প্রতি দিনের খাবারের অংশ হিসেবে খেসারি ডাল খেত।
...
খেসারি ডাল খাদ্য হিসেবে পুষ্টিকর হলেও এতে থাকা β-ODAP নামক নিউরোটক্সিনের কারণে অতিরিক্ত খাওয়ার ফলে ল্যাথিরিজম নামক পায়ের প্যারালাইসিস হতে পারে।
বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বিজ্ঞানী এবং চিকিৎসকরা নিশ্চিত হয়ে যায়, দীর্ঘসময় ধরে শুধুমাত্র খেসারি ডালই খাদ্য হিসেবে খেতে থাকলে ল্যাথিরিজম হয়।
১৯৪২ সালে, নাৎসিরা ইউক্রেনের ভ্যাপনিয়ার্কা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের ইহুদিদেরকে খাবার হিসেবে শুধু খেসারি ডাল সরবরাহ করে। বন্দিদের খাদ্যের বিকল্প কিছু না থাকায় তারা দীর্ঘসময় ধরে খালি খেসারি ডাল খেয়ে বেঁচে ছিল। কিন্তু বেঁচে রইলেও তাদের মধ্যে প্রায় ১,২০০ ইহুদি পঙ্গু হয়ে যায়।
ভারতের স্বাধীনতার পরও বহু দশক ধরে জমিদাররা চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক ব্যবস্থায় কৃষকদেরকে শোষণ করেছে। মজুরি হিসেবে তাদেরকে টাকা না দিয়ে দিয়েছে সস্তা খেসারি। খেসারি বিক্রি করে অন্য খাবার কেনা যেতো না। কৃষকদেরকে বাধ্য হয়ে কেবলমাত্র খেসারি খেয়ে বেঁচে থাকতে হতো।
না খেয়ে মারা যাওয়া কিংবা খেয়ে পঙ্গুত্ব বরণের মধ্যে দরিদ্র কৃষকরা বেছে নিয়েছিল পরেরটিকেই। যখন এই শ্রমিকরা ল্যাথিরিজমে আক্রান্ত হত, তাদেরকে ছাঁটাই করা হতো। তখন তারা কাজ হারিয়ে পাটনা, বেনারস, বোম্বে, কলকাতা ইত্যাদি বড় বড় শহরে গিয়ে ভিক্ষা শুরু করতো। এসব শহরের ভিক্ষুকদের বড় অংশ ছিল এই ল্যাথিরিজমে আক্রান্ত খেসারি খাওয়া শ্রমিক।
বেনারস হিন্দু ভার্সিটির নিউরোলজির চীফ ড. বিজয়নাথ মিশরা খেসারি ডাল নিয়ে প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেন। উত্তর প্রদেশের ৯ হাজার মানুষের ওপর একটি গবেষণা চালান ড. মিশরা। অংশগ্রহণকারীদের বেশিরভাগেরই খাবারের একটি বড় অংশ ছিল খেসারি ডাল। তাদের মধ্যে খোঁড়া বা পা কাঁপার প্রবণতা মোটেই দেখা যায়নি। তার মতে, "যদি স্বাভাবিকভাবে খেসারি ডাল খাওয়া হয় এবং ডালের সাথে অন্যান্য খাবার খাওয়া হয়, তখন নিউরোল্যাথিরিজমের কোনো অস্তিত্বই দেখা যায় না। কেবল খেসারি খেলেই ল্যাথিরিজম হয়ে যাবে, এমন নয়। ইতিহাস ঘাঁটলে চোখে পড়ে কেবল খরা ও অন্যান্য দুর্যোগের কারণে দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলেই ল্যাথিরিজমের প্রকোপ হয়েছে।"
...
বর্তমানে এটা প্রমাণিত যে, যদি খেসারি ডাল ২৪ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয় এবং পরবর্তিতে ওই পানি ফেলে ভালোভাবে রান্না করে খাওয়া হয় তাহলে কোন সমস্যা হয় না।
প্রতিদিনের খাদ্যের অর্ধেকই খেসারি ডাল হলে এবং তা টানা তিন থেকে ছয় মাস পর্যন্ত খেলে মানুষের মধ্যে সমস্যা দেখা দিতে পারে।
অধিক ক্রুড প্রোটিন থাকার কারণে গবাদিপশুর সেরা প্রোটিন জাতীয় খাবার হতে পারে খেসারি। কিন্তু অতিরিক্ত খেসারি ডাল খাওয়ানো যাবে না।
Muhammad Rahat Khan
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন