এই ব্লগটি সন্ধান করুন

এই ব্লগটি সন্ধান করুন

এই ব্লগটি সন্ধান করুন

এই ব্লগটি সন্ধান করুন

এই ব্লগটি সন্ধান করুন

এই ব্লগটি সন্ধান করুন

সোমবার, ২৩ জুন, ২০২৫

অদৃশ্যকরণ প্রযুক্তি: আলো, তাপ আর শব্দ লুকানোর বিজ্ঞান

 অদৃশ্যকরণ প্রযুক্তি: আলো, তাপ আর শব্দ লুকানোর বিজ্ঞান


বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা এমন প্রযুক্তি বানানোর চেষ্টা করছেন যা আমাদের দৃষ্টির আড়ালে রাখবে। কিন্তু আসলেই কি আমরা অদৃশ্য হওয়ার কাছাকাছি চলে এসেছি?


অদৃশ্য হওয়ার ইচ্ছা অনেক পুরোনো। শিকারি আর সৈনিকরা শত শত বছর ধরে নিজেদের লুকাতে নানা রকম কৌশল ব্যবহার করে আসছেন, কিন্তু এখন বিজ্ঞানীরা সত্যিকার অর্থে কিছু জিনিস অদৃশ্য করার কাছাকাছি চলে এসেছেন। আজকের আধুনিক স্টেলথ টেকনোলজি শুধু প্লেনকে রাডার থেকে আড়াল করতেই পারে না, বরং ইনফ্রারেড ক্যামেরায় দেখা যাওয়া তাপের চিহ্নও লুকিয়ে ফেলতে পারে, এমনকি শব্দও গোপন করতে পারে। তাহলে অদৃশ্য হওয়ার প্রযুক্তি কতটা কাছাকাছি?

.


অদৃশ্য করার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি


আমরা কোনো বস্তু দেখি, কারণ আলো যখন ওই বস্তুতে পড়ে, তখন সেটা কিছুটা শোষিত হয় আর কিছুটা প্রতিফলিত হয়। কিন্তু কাচের মত স্বচ্ছ জিনিস আলোকে প্রায় বিনা বাধায় পার হতে দেয়। কিন্তু যদি কোনো অস্বচ্ছ বস্তুকে লুকাতে হয়, তাহলে আলোকে ওই বস্তু ঘিরে ঘুরিয়ে নিয়ে যেতে হবে, যেন মনে হয় ওখানে কিছু নেই!


২০০৬ সালে ডিউক ইউনিভার্সিটির ইঞ্জিনিয়াররা প্রথম এক ধরনের ক্লোকিং ডিভাইস (Cloaking Device) তৈরি করেন। এটি এক ধরনের তামার সিলিন্ডার, যেটিকে মাইক্রোওয়েভ দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছিল, যাতে তা মাইক্রোওয়েভ ডিটেক্টরের কাছে অদৃশ্য মনে হয়। এই ডিভাইসটি বানানো হয়েছিল মেটাম্যাটেরিয়াল দিয়ে—এটি এমন এক ধরনের বিশেষ কাঠামো যেটা ত্রিমাত্রিক ভাবে বার বার এক রকম প্যাটার্নে সাজানো হয়। এর ফলে এটি কিছু অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য পায়।


তবে এই ক্লোক শুধু মাইক্রোওয়েভে কাজ করত—যেটা তুলনামূলকভাবে অনেক বড় তরঙ্গ। কিন্তু দৃশ্যমান আলোতে (যেটার তরঙ্গ অনেক ছোট) অদৃশ্য হওয়া অনেক কঠিন। কারণ একদিকে ন্যানো-স্কেলে কোয়ান্টাম ইফেক্ট চলে আসে, অন্যদিকে সব রঙের আলোকে একসাথে ঘুরিয়ে দেওয়া ভীষণ কঠিন কাজ। আর একটি বড় সমস্যাও ছিল—এই ক্লোকটি কেবল ছোট একটি বস্তুর জন্য কাজ করত, মানুষের মত বড় কিছুর জন্য নয়।

.


মেটালেন্স: আলোকে নিখুঁতভাবে নিয়ন্ত্রণ


২০১৮ সালে হার্ভার্ড ও কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ওয়াটারলু’র গবেষকরা একটি অত্যাধুনিক ডিভাইস তৈরি করেন, যেটি মেটালেন্স (metalens) নামে পরিচিত। মেটালেন্স মূলত একধরনের অতি পাতলা ও চ্যাপ্টা লেন্স, যা দেখতে প্রায় কাচের পাতলা চাকতির মত, কিন্তু তার কাজ অনেক বেশি জটিল।


এই লেন্সের পৃষ্ঠে বসানো থাকে ন্যানোফিন (nanofin)—মানে, অতিক্ষুদ্র "পাখার মত" গঠন। প্রতিটি ন্যানোফিনের আকার এতটাই ছোট যে একটির প্রস্থ একটি চুলের প্রস্থের হাজার ভাগের এক ভাগের চেয়েও কম। এই ন্যানোফিনগুলি বিশেষভাবে সাজানো থাকে, যেন তারা আলোকে নির্দিষ্টভাবে বাঁকাতে পারে।


আমরা জানি, কোনো বস্তু দেখতে হলে আলো সেই বস্তু থেকে আমাদের চোখে পৌঁছায়। আর আলো এক ধরনের তরঙ্গ, যার বিভিন্ন রঙের জন্য তরঙ্গদৈর্ঘ্য ভিন্ন হয়। কিন্তু সাধারণ লেন্স সব রঙের আলোকে সমানভাবে বাঁকাতে সক্ষম না, ফলে বিভ্রান্তি তৈরি হয় (যেমন, রঙ বিকৃতি বা ফোকাসের সমস্যা)।


মেটালেন্সের ন্যানোফিনগুলি এই সমস্যার সমাধান করে। এগুলি এমনভাবে কাজ করে যে, একাধিক রঙ বা তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোও সঠিকভাবে বাঁকানো যায়—একই পয়েন্টে ফোকাস করা যায়। ফলে, এটি অনেক বেশি নিখুঁতভাবে আলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।


এই কারণে, মেটালেন্স স্টেলথ প্রযুক্তিতে আলোকে ঘুরিয়ে দিয়ে বস্তুকে "অদৃশ্য" করার পথে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়।


তবে এই প্রযুক্তি এখনও উন্নয়নের পর্যায়ে। মেটালেন্স দিয়ে দৃশ্যমান আলো নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও, এখনও এমন একটি ক্লোক তৈরি হয়নি, যেটা পরে মানুষ হেঁটে বেড়াতে পারে—কারণ এটি এখনও ছোট আকারের বস্তুর জন্যই কার্যকর।


ইউনিভার্সিটি অব এক্সেটার-এর থিওরেটিক্যাল ফিজিক্সের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর সাইমন হর্সলি বলেন, “সবাই চায় এমন একটা ক্লোক যা গায়ে পরা যাবে… কিন্তু ওগুলিকে নরম ও নমনীয় করা এখনও সম্ভব হয়নি।”


তিনি আরো বলেন, “এখনকার ক্লোক বলতে আপনি যা বুঝবেন, সেটা অনেকটা একটা সিলিন্ডার যেটা নিজের চারপাশে পরতে হয়। কিন্তু আপনি যদি এমন কিছু চান যেটা পরে ঘুরে বেড়াতে পারবেন, সেটা একদম ভিন্ন ডিজাইনের ব্যাপার।”

.


রাডার থেকে লুকাতে স্টেলথ বিমানের কৌশল


যদিও আমরা এখনও এমন কোনো জিনিস বানাতে পারিনি যা পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে যায়, তবুও কিছু প্রযুক্তি ইতিমধ্যেই এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে জিনিসগুলি অন্য তরঙ্গদৈর্ঘ্যে কার্যত অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। যেমন—স্টেলথ জেট। এসব জেট এমনভাবে বানানো হয় যেন রাডারে ধরা না পড়ে।


রাডার আসলে একটা রেডিও তরঙ্গ পাঠায়, তারপর দেখে সেটি কোনো কিছুর গায়ে লেগে ফেরত আসে কিনা। যদি ফেরে, তাহলে সেই সময় আর দিক দেখে বোঝা যায় ওই বস্তুটা কোথায় আছে। বিমান সাধারণত ধাতবে তৈরি, তাই এগুলি রাডার তরঙ্গ খুব ভালভাবে প্রতিফলিত করে—যার মানে হল, রাডার সহজেই এগুলিকে ধরতে পারে।


তবে দুটি জিনিস আছে যা প্লেনকে রাডার থেকে লুকাতে সাহায্য করে: প্রথমত, প্লেনের গঠন বা আকার। বিমানগুলি যদি গোল-গোল হয় (যেমন যাত্রীবাহী প্লেন), তাহলে যে দিকেই রাডার তরঙ্গ আসুক, তা কিছুটা ফেরত যাবেই। কিন্তু স্টেলথ প্লেনগুলি একদম বিপরীত—এসবের পৃষ্ঠ একেবারে চ্যাপ্টা, ধারালো কোণযুক্ত। এতে রাডার তরঙ্গগুলি এমনভাবে প্রতিফলিত হয় যে, তারা রাডারের উৎসে আর ফিরে যায় না—ফলে রাডারে ধরা পড়ে না।


দ্বিতীয়ত, বিমান তৈরির উপাদান। বিমান যদি ধাতব বা কার্বন ফাইবার দিয়ে তৈরি হয়, তাহলে সেটি রাডার তরঙ্গ খুব সহজে প্রতিফলিত করবে। তাই রাডার-প্রুফ করতে গেলে এমন উপাদান ব্যবহার করতে হয় যেগুলি বিদ্যুৎ পরিবাহক না। আর যদি ধাতব ব্যবহার করতেই হয়, তাহলে বিমানের গায়ে এমন এক ধরনের পেইন্ট ব্যবহার করা হয়, যা রাডার তরঙ্গ শোষণ করে।


এরকম একটি রাডার শোষণকারী পেইন্টের নাম ‘iron ball paint’। এতে থাকে ছোট ছোট আয়রন বল, যেগুলির তরঙ্গ কম্পন রাডারের মতই। রাডার সিগনাল প্লেনের গায়ে লাগলেই, এই ছোট ছোট বলগুলি কম্পিত হয়ে সেই শক্তিকে তাপে রূপান্তর করে চারপাশে ছড়িয়ে দেয়। ফলে, রাডার যখন ফিরে আসা তরঙ্গ খুঁজছে, তখন কিছুই খুঁজে পায় না—প্লেন কার্যত অদৃশ্য হয়ে যায়। অনেক সময় এমন হয় যে, প্লেনকে দেখে মনে হয় কোনো পাখি উড়ছে!


তবে এসব প্রযুক্তি নির্দিষ্ট কিছু তরঙ্গদৈর্ঘ্যের জন্যই কাজ করে। আর আজকের আধুনিক রাডার কম্পিউটারগুলি এতটাই শক্তিশালী হয়ে গেছে যে, বিমান লুকিয়ে থাকলেও তারা সেগুলি চিনে ফেলতে পারে।


শুধু রাডার নয়, স্টেলথ বিমানগুলিকে দৃশ্যমান আলো থেকেও লুকাতে হয়। এ জন্য এসব বিমান সাধারণত কালো রঙে রঙ করা হয় এবং রাতের বেলায় ওড়ানো হয়। এমনকি প্লেনগুলি এমন উচ্চতায় চালানো হয়, যেখানে কনডেনসেশন ট্রেইল (বিমানের  পেছনে সাদা রেখা) কম তৈরি হয়। কারণ এটাও অনেক দূর থেকে দেখা যায়।


আরেকটি সমস্যা হল তাপ। বিমানের ইঞ্জিন থেকে প্রচণ্ড উত্তাপ বের হয়, যেটা ইনফ্রারেড ক্যামেরায় সহজেই ধরা পড়ে। তাপ গোপন করতে কিছু বিমান ঠাণ্ডা বাইরের বাতাস ইঞ্জিনের গরম এক্সহস্টে মিশিয়ে দেয়। কেউ কেউ সরু-আকৃতির পাইপ ব্যবহার করে, যাতে গরম বাতাস বেশি ছড়িয়ে যায়। আবার কিছু বিমান এমনভাবে ডিজাইন করা হয়, যাতে এক্সহস্ট উপরের দিকে বের হয়—নিচ থেকে কেউ দেখতে না পায়।


নতুন প্রজন্মের ইলেকট্রোম্যাগনেটিক মেটাসারফেস নামের প্রযুক্তি এসেছে, যা আরও ভালভাবে রাডার বা আলোকে ঘুরিয়ে দিতে পারে। কিন্তু চ্যালেঞ্জ হল—সব রকম তরঙ্গদৈর্ঘ্যে একসাথে লুকানো এখনও সম্ভব হয়নি।

.


তাপ গোপন করার কৌশল


যুদ্ধে বা গোপন মিশনে সৈনিকদের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ হল ইনফ্রারেড (IR) ক্যামেরা থেকে লুকানো। কারণ মানুষের শরীর স্বাভাবিকভাবেই প্রায় ২০০ ওয়াট তাপ বিকিরণ করে, যা প্রায় তিনটা ঘরের লাইটবাল্বের সমান। আর এই তাপ সহজেই ইনফ্রারেড ক্যামেরায় ধরা পড়ে।


একটা সহজ, সস্তা উপায় হল অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল কম্বল ব্যবহার করা। এই ধরনের কম্বলকে "ইমারজেন্সি ব্ল্যাঙ্কেট" বা "স্পেস কম্বল"ও বলা হয়। এর চকচকে ধাতব পৃষ্ঠ তাপ বের হতে দেয় না।


এর পেছনে রয়েছে একটি বৈজ্ঞানিক ধারণা—ইমিসিভিটি (emissivity)। সহজভাবে বললে, ইমিসিভিটি হল কোনো বস্তু কতটা সহজে তাপ বিকিরণ করে সেটা মাপার একটি মান। একে ০ থেকে ১ পর্যন্ত স্কেলে মাপা হয়। যেখানে ১ মানে সেই বস্তু খুব সহজেই তাপ বিকিরণ করে (যেমন মানুষের ত্বক বা কাপড়), আর ০ মানে তাপ প্রায় বের হয় না (যেমন চকচকে ধাতু)।


অ্যালুমিনিয়ামের ইমিসিভিটি প্রায় ০.০৩ থেকে ০.০৫—মানে প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। তাই এই ফয়েল কম্বল শরীরের তাপ বাইরে বের হতে দেয় না। এর ফলে ইনফ্রারেড (IR) ক্যামেরা বুঝতেই পারে না যে ভেতরে কেউ আছে—কারণ তাপের চিহ্ন দেখা যায় না।


কিন্তু সমস্যা হল, শরীরের তাপ যেহেতু বাইরে বের হতে পারছে না, সেটা ভেতরেই জমা হতে থাকে। কিছুক্ষণ পর এই অতিরিক্ত তাপ পুরো কম্বল গরম করে ফেলে। তখন পুরো কম্বলটাই ইনফ্রারেড ক্যামেরায় গরম বস্তু হিসেবে দেখা যায়।


আর আশেপাশের পরিবেশ যদি অনেক ঠাণ্ডা বা অনেক গরম হয়, তাহলে কম্বলটা চারপাশের তুলনায় আলাদা দেখায়—যেটা ইনফ্রারেড ক্যামেরার জন্য একটি পরিষ্কার সংকেত হিসাবে ধরা পড়ে।


ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টার-এর প্রফেসর কসকুন কোকাবাস আর তার টিম এমন এক প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছেন, যেটা আশেপাশের পরিবেশের সঙ্গে মিলিয়ে নিজেকে বদলে ফেলতে পারে—একেবারে গিরগিটির মত! “প্রথমে ভাবনা ছিল, গিরগিটির মত স্মার্ট সারফেস বানানো যায় কি?”—বলেন কোকাবাস। উত্তর হল: হ্যাঁ, যায়! আর সেটা সম্ভব গ্রাফিন দিয়ে।


গ্রাফিন একধরনের ২D ম্যাটেরিয়াল (মাত্র এক পরমাণু পুরুত্বের) যেখানে অসংখ্য চলমান ইলেকট্রন থাকে। আর এই ইলেকট্রনগুলিই আলো আর তাপের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া করে। এই ইলেকট্রনগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করলেই আপনি বস্তুটির আলোক প্রতিফলন, শোষণ আর তাপ বিকিরণ—সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। গ্রাফিনের স্তরগুলির মধ্যে আয়ন গুঁজে দেওয়া হয়—যাকে বলে ইন্টারক্যালেশন। এতে ইলেকট্রনের চলাফেরা বদলে যায়, ফলে আপনি পুরো সারফেসের অপটিক্যাল প্রপার্টি বদলে ফেলতে পারেন—মানে, আলো বা তাপ কেমনভাবে প্রতিফলিত হবে, সেটি নিয়ন্ত্রণ করা যায়।


২০২২ সালে কোকাবাসের টিম ৪২টি গ্রাফিন প্যাচ দিয়ে একটা জ্যাকেট বানায়, যেটা একেকটা পিক্সেলের মত কাজ করে। এই জ্যাকেট এমনভাবে আশেপাশের পরিবেশের তাপমাত্রা অনুকরণ করতে পারে, যে ইনফ্রারেড ক্যামেরায় লোকটিকে দেখা যায় না! যদিও গ্রাফিন মাত্র ২০ বছর আগে আবিষ্কৃত হয়েছে, আর এখনও এটি বড় থ্রিডি ম্যাটেরিয়ালের সঙ্গে ভালভাবে মিশিয়ে কাজ করানো কঠিন। কিন্তু একবার এই সমস্যাগুলি কাটিয়ে উঠতে পারলে, অদৃশ্য জ্যাকেট বা ক্লোক বাস্তবে পরা সম্ভব হবে—যা দৃশ্যমান আলো এবং ইনফ্রারেড দুই থেকেই মানুষকে লুকিয়ে রাখতে পারবে।

.


শব্দ গোপন করার কৌশল


এই জায়গায় আমাদের চেয়ে প্রকৃতির কিছু প্রাণী অনেক বেশি এগিয়ে। এর একটা দুর্দান্ত উদাহরণ হল আফ্রিকান ক্যাবেজ ট্রি এম্পেরর মথ (African cabbage tree emperor moth)। এটি আফ্রিকার নির্জন বনাঞ্চলে পাওয়া যায়, এবং সাধারণত রাতে সক্রিয় থাকে। এর ডানার রঙ ধূসর আর বাদামির মিশেল, দেখতে সুন্দর হলেও সহজেই গাছের গায়ে মিশে যেতে পারে।


তবে এর আসল স্টেলথ গুণ লুকানো আছে তার ডানার গঠনে। এর ডানায় রয়েছে সূক্ষ্ম আঁশ ও লোম, যা শুধু দেখতেই হালকা নয়—এটি আসলে আশ্চর্য প্রাকৃতিক সাউন্ড ক্লোক (sound cloak) হিসাবে কাজ করে।


এই মথের শত্রু হল বাদুড়, যারা দেখতে পায় না, কিন্তু "ইকোলোকেশন" (echolocation) ব্যবহার করে শিকার করে। ইকোলোকেশন এক ধরনের জৈবিক সোনার প্রযুক্তি—বাদুড় নিজের মুখ দিয়ে উচ্চ-তরঙ্গ (আল্ট্রাসোনিক) শব্দ পাঠায়, আর সেই শব্দ কোনো কিছুর গায়ে লেগে ফিরে এলে বুঝে নেয় আশেপাশে কী আছে, কোথায় আছে।


কিন্তু ক্যাবেজ ট্রি এম্পেরর মথের ডানার আঁশ সেই শব্দ শুষে নেয়—ফলে কোনো প্রতিফলন হয় না, এবং শব্দ ফিরে না যাওয়ায় বাদুড় বুঝতেই পারে না যে সামনে তার প্রিয় শিকারটি উড়ছে!


ইউনিভার্সিটি অব ব্রিস্টল-এর প্রফেসর মার্ক হোল্ডারিড এই দারুণ ব্যাপারটি আবিষ্কার করেছেন। এটিই প্রথম প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া অ্যাকোস্টিক মেটাম্যাটেরিয়াল। এগুলি এমন ধরনের কাঠামো যা শব্দের তরঙ্গকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যেমন আলো নিয়ন্ত্রণে মেটাম্যাটেরিয়াল কাজ করে ইলেকট্রনের মাধ্যমে, তেমনি শব্দে এগুলি কাজ করে পিরিয়ডিক স্ট্রাকচার দিয়ে—মানে, ছোট ছোট একরকম গঠন বার বার সাজানো।


ইউনিভার্সিটি অব সাউথ্যাম্পটন-এর অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ড. ফেলিক্স ল্যাংফেল্ড বলছেন—“এগুলি এমনভাবে বানানো যায়, যেখানে গঠন, জ্যামিতি আর উপাদান সব নিয়ন্ত্রণ করে শব্দতরঙ্গ কীভাবে চলবে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। শব্দকে প্রতিফলিত, মোড়ানো বা শোষণ—সবই সম্ভব।” এই গঠনগুলি এতই দক্ষ যে খুবই পাতলা স্তরেও অনেক শব্দ শোষণ করা যায়, যা আগে করতে হলে পুরু ফোম দরকার হতো। “ভাবুন তো, একটা কাগজের মত পাতলা কিছু, যেটা কংক্রিটের দেয়ালের মত শব্দ আটকায়।”


এই স্ট্রাকচারগুলি ব্যবহার করা যেতে পারে বড় দালানে শব্দ কমাতে, বা বিমানগুলিকে নিঃশব্দ করতে—আর সেটাই এখন ল্যাংফেল্ডের গবেষণার বিষয়। শব্দ বা ভাইব্রেশন শুধু কানে বাজে না, এগুলি শক্তি। যদি মেটাম্যাটেরিয়াল দিয়ে এগুলির দিক ঠিকমত ঘুরানো যায়, তাহলে সেই শক্তিকে ধরে রাখা সম্ভব।


ইউনিভার্সিটি অব এক্সেটার-এর ড. গ্রেগরি চ্যাপলেইন এখন এই টেকনোলজি নিয়ে কাজ করছেন। তিনি বলেন, “গাড়ির মধ্যে অনেক শব্দ বা কম্পন হয়, যা আসলে অপচয় হওয়া শক্তি। আপনি যদি মেটাম্যাটেরিয়াল দিয়ে সেই শক্তির দিক ঘুরিয়ে দেন, আর সেখানে একটা যন্ত্র রাখেন যা শক্তি শুষে নেয়—তাহলে ওই অপচয় কাজে লাগানো যায়।” এই টেকনোলজি দিয়ে এমন ছোট ডিভাইস বানানো যাবে যেগুলি ভাইব্রেশন থেকে শক্তি নিয়ে চলবে—যেমন ব্রিজ, পারমাণবিক চুল্লি বা বিমানের ভেতরের নানা সেন্সর।


তাহলে ভাবুন, ভবিষ্যতের শহরগুলি এমন হতে পারে: একদম শব্দহীন, পরিবেশ থেকে শক্তি সংগ্রহে সক্ষম, ভূমিকম্প প্রতিরোধী, এমনকি হয়ত চোখে দেখা যায় না এমন—পুরোটাই মেটাম্যাটেরিয়ালের কল্যাণে!


সব দিক মিলিয়ে—আলো, তাপ আর শব্দ—এই তিন জায়গায় আমরা অনেকটাই এগিয়ে গেছি। যদিও এখনও ইনভিজিবিলিটি ক্লোক পরে হেঁটে বেড়ানো সম্ভব হয়নি, তবুও এটা নিশ্চিত যে আমরা আগের চেয়ে অনেক বেশি কাছে পৌঁছে গেছি। মেটাম্যাটেরিয়াল, গ্রাফিন, আর স্মার্ট ডিজাইন আমাদের এমন এক ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে, যেখানে অদৃশ্য হওয়া আর শুধু গল্পের বিষয় নয়—বরং একেবারে বাস্তবের প্রযুক্তি।


#অদৃশ্যকরণ #প্রযুক্তি #বিজ্ঞান

কোন মন্তব্য নেই:

সৌন্দর্যের দেবী ক্লিওপেট্রাআত্মহনন করেন, একটি বিষাক্ত সাপ তুলে নিয়েছিলেন হাতে, আর সেই মুহূর্তে সাপ ছোবল মারে তাঁর বুকে।

 সৌন্দর্যের দেবী ক্লিওপেট্রাআত্মহনন করেন, একটি বিষাক্ত সাপ তুলে নিয়েছিলেন হাতে, আর সেই মুহূর্তে সাপ ছোবল মারে তাঁর বুকে। ক্লিওপেট্রা ....মিশ...