।। কৃষি ও যৌনতা ।।
প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ ও নিদর্শন অনুযায়ী কৃষিকাজের উদ্ভব হয়েছিল প্রায় ১২,০০০ বছর পূর্বে। তার পূর্বে প্রায় ২০ লক্ষ বছর মানুষ ছিল মূলত শিকারী ও সংগ্রাহক, যা জনপ্রিয় ভাবে “হান্টার-গ্যাদারার সোসাইটি” নামে পরিচিত। এই হান্টার-গ্যাদারার সমাজের মানুষের কাজ ছিল মূলত বিভিন্ন ভক্ষণযোগ্য উদ্ভিদ, ফল, কীটপতঙ্গ, পাখির ডিম ইত্যাদি সংগ্রহ করা এবং বিভিন্ন পশু, পাখি ও মাছ শিকার করা।
এই হান্টার-গ্যাদারারদের কিন্তু কিছু নিজস্ব রিচুয়ালিস্টিক প্র্যাকটিস বা আধ্যাত্মিক চর্চাও ছিল। মোটা দাগে একে “ধর্ম” বলছি না, কারণ বর্তমান সময়ে আমরা যে সকল অর্গানাইজড রিলিজিয়ন দেখতে পাই, মানব ইতিহাসে তার আবির্ভাব ঘটতে তখনও ঢের বাকি। কিন্তু কেন? কারণ তখনও অর্গানাইজড রিলিজিয়নের প্রয়োজন হয়ে ওঠেনি মানুষের। বরং প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল মানুষের তখন প্রকৃতিকেন্দ্রিক কিছু বিশ্বাস গড়ে ওঠে, যাকে সহজ ভাষায় আমরা এ্যানিমিজম বা সর্বপ্রাণবাদ বলে থাকি।
সর্বপ্রাণবাদ। অর্থাৎ সব কিছুরই প্রাণ বা স্পিরিট আছে। যেমন ধরুন সুউচ্চ কোন পাহাড় কিংবা সুবিশাল কোন সমুদ্র। এদের কৃপা প্রাপ্তির প্রয়োজন হলে এদেরকেই সম্মান জানাতে হবে। আবার এই সর্বপ্রাণবাদের অংশ হিসেবেই উদ্ভব হয় জাদুবিশ্বাসের, যাকে বর্তমান অর্গানাইজড রিলিজিয়নের আদিমতম রূপও বলা যায়। এই জাদুবিশ্বাসের সাথে কিন্তু জাদুটোনার কোন সম্পর্ক নেই। বরং প্রাকৃতিক যেকোনো বিষয়, যার উপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ নেই, তাকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা থেকেই জাদুবিশ্বাসের উদ্ভব। যেমন ধরুন স্পেনের আলতামিরার কোন গুহাবাসী শিকারে যাওয়ার পূর্বে গুহার দেয়ালে একটি বাইসনের ছবি আঁকলেন এই বিশ্বাস থেকে যে এর মাধ্যমে তিনি বাইসনটির স্পিরিটের উপর নিয়ন্ত্রণ পেয়েছেন। ফলস্বরূপ আজ রাতে তিনি সহজেই এর শিকার করতে পারবেন।
জাদুবিশ্বাসকে অর্গানাইজড রিলিজিয়নের আদিমতম রূপ বলার অনেক গুলো কারণের মাঝে একটি হলো- এতে রিচুয়াল থাকলেও তা জটিল নয়। বাইসন চাই, তাই বাইসনের ছবি আঁকবো। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে আরেকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান বা বিষয়ের আন্তঃসম্পর্ক। যেমন আকাশ, বৃষ্টি ও জলের সম্পর্ক। অনেক সংস্কৃতিতে আজও বৃষ্টির প্রার্থনা স্বরূপ আকাশের দিকে জল ছুঁড়ে দেওয়ার চর্চা দেখা যায়। অর্থাৎ নিচে থেকে জল ছুঁড়ে দিলে জলের স্পিরিট আকাশের স্পিরিটকে প্রভাবিত করবে। এর ফলে আকাশও জল স্বরূপ বৃষ্টি দান করবে। মনে রাখতে হবে, এই আন্তঃসম্পর্কই কৃষির সাথে যৌনতাকে জুড়ে দিয়েছে পুরো পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে।
কৃষির উদ্ভাবন মানব সভ্যতার বেড়ে ওঠার ইতিহাসের যে সুউচ্চ পর্যায়ে আছে, খুব কম বিষয়ই সেই উচ্চতাকে অতিক্রম করতে পেরেছে বোধহয়। হয়তো আগুন আবিষ্কারের পর এটিই ছিল মানব ইতিহাসের সর্বোচ্চ মাইলফলক। কিন্তু একই সাথে ফসল উৎপাদনের প্রক্রিয়াটি বুঝতে মানুষের বেশ মুশকিলও হয়েছে। “শুধু বীজ বুনলেই কি ফসল হয়?” – হয়তো এমন প্রশ্ন মানুষকে ভাবিয়েছে দীর্ঘ সময়। অর্থাৎ সে যে বীজ বুনছে, তা থেকে ফসল ফলছে কীভাবে? কোন অতিপ্রাকৃতিক স্পিরিট কি এটি নিয়ন্ত্রণ করছে?
২০ লক্ষ বছর ধরে হান্টার-গ্যাদারার সোসাইটিতে বাস করে আসা মানুষ শিকার ও সংগ্রহ সম্পর্কে প্রায় সবকিছু জেনে থাকলেও কৃষি সম্পর্কে তার ধারণা শূন্য। শিকার যোগ্য প্রাণী চোখের সামনেই ঘুরে বেড়াচ্ছে, চোখের সামনেই গাছে ঝুলছে ফল। কিন্তু ফসলটা ফলছে চোখের আড়ালে, অনেকটা অদৃশ্য থেকেই। আবার ফল কিংবা প্রাণীর যোগান সহজেই চাহিদা মোতাবেক নিশ্চিত করা সম্ভব হলেও, ফসলের ফলনের পরিমাণ নিশ্চিত করার কোন উপায় ছিল না। তাই ঠিক কী ধরণের জাদুচর্চার মাধ্যমে ফসলের ফলন বৃদ্ধি কিংবা নিশ্চিত করা যায়, তার সম্পর্কেও সে জ্ঞানশূন্য।
আর এখানেই ঘটে অদ্ভুত এক বিষয়। মানুষের সৃজনশীল মস্তিষ্ক কৃষির সাথে এমন একটি বিষয়ের আন্তঃসম্পর্ক স্থাপন করে যার সাথে এর সরাসরি কোন সম্পর্ক না থাকলেও বৈশিষ্ট্যগত কিছু মিল ছিল। আর তা হলো নারীর প্রজনন।
প্রথমত, কৃষির মতো প্রজননের পুরো বিষয়টিও মানুষের কাছে অদৃশ্য ছিল। দ্বিতীয়ত, একটি অদৃশ্য প্রক্রিয়া থেকে ফসলের জন্ম এবং একই রকম অদৃশ্য প্রক্রিয়া থেকে শিশুর জন্মের মাঝে সে খুঁজে পেয়েছিল অদ্ভুত রকম সাদৃশ্য। এই দুই অদৃশ্যের মাঝে যে সাদৃশ্য, তা থেকে আরও কিছু সম্পর্ক স্থাপিত হয়। যেমন ফসলী জমি বা ভূমির সাথে যোনী ও মাতৃত্বের সাদৃশ্য। অপরদিকে হলকর্ষণের সাথে পুরুষত্বের সম্পর্ক। অর্থাৎ পুরুষের লিঙ্গ ও নারীর যোনীর মিলন বা যৌনক্রিয়ার ফলস্বরূপ যেমন শিশুর জন্ম হয়, তেমনি কৃষি জমিতে হলকর্ষণের ফলে ফসলের ফলন হয়।
এই বিষয়ে আলোকপাত করে লোকসংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ সুধীর চক্রবর্তী তাঁর “নির্বাচিত প্রবন্ধে” লিখেছেন-- “কৃষিভিত্তিক সমাজে জমিতে শস্য উৎপাদন আর নারী গর্ভে সন্তান আগমন একই জাদুবিশ্বাসে গৃহীত হয়।”
এভাবেই উদ্ভব ঘটে যৌনতা ভিত্তিক বিভিন্ন জাদুবিশ্বাসের। এমন ধারণারও জন্ম হয় যে, নারী পুরুষের যৌনক্রিয়া যত বেশি হবে, ভূমিও ততই যৌনসক্রিয় ও উর্বর হয়ে উঠবে। প্রাচীনকালে ইন্দোনেশিয়ার জাভা সহ পৃথিবীর আরও বিভিন্ন অঞ্চলে এই ধারণা এতটাই তীব্র ছিল যে অনেক সময় কৃষির জমিতেই নারী-পুরুষ যৌনক্রিয়ায় অংশ নিতেন। আবার মধ্য আমেরিকার পিপাইল জাতির কৃষকেরা জমিতে বীজ বোনার প্রায় চার দিন আগে থেকেই সঙ্গম থেকে বিরত থাকতেন। কারণ তারা বিশ্বাস করতেন, বীজ বপনের ঠিক আগের রাতে তীব্র যৌনক্রিয়া করতে পারলে জমির উর্বরতা তার দ্বারা প্রভাবিত হবে।
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। হান্টার-গ্যাদারার সমাজের প্রাথমিক পর্যায়ে লিঙ্গভিত্তিক শ্রেণীবিভাজনের বিষয়টি তুলনামূলক কম ছিল। শিকার হোক অথবা ফলমূল সংগ্রহ, নারী পুরুষ উভয়ই সে কাজে অংশগ্রহণ করতেন। কিন্তু এই দৃশ্যপট আবার বদলে যায় বল্লম আবিষ্কারের পর। বল্লম নিক্ষেপের দক্ষতা পুরুষদের শিকারে পারদর্শী করলে তারা ফলমূল সংগ্রহের কাজ ধীরে ধীরে ছেড়ে দেন। অর্থাৎ নারীরা একাই সংগ্রহের কাজটি অব্যহত রাখেন। আর এই ফল সংগ্রহের কাজ করতে করতেই কিন্তু তার বীজ থেকে নারীরাই প্রথম কৃষির উদ্ভাবন করেন। এর প্রমাণস্বরূপ পৃথিবী জুড়ে অসংখ্য লোকগল্পের দেখা মেলে। যেমন আমেরিকার চেরোকি আদিবাসীরা এখনও বিশ্বাস করেন, শস্য আবিষ্কার করেছিলেন পৃথিবীর প্রথম নারী, ঘন জঙ্গলের ভেতরে। গবেষক রবার্ট ব্রিফল্ট এই বিষয়টিকেই গুরুত্ব দিয়ে মন্তব্য করেন— "The art of cultivation has developed exclusively in the hands of women."
তাই নারীদের হাতে কৃষিকাজের সূচনা হওয়া কিন্তু কৃষির সাথে নারী ও মাতৃত্বের সম্পর্ক জোরদার হওয়ার আরেকটি বড় কারণ। এর ফলে পরবর্তীতে কৃষিভিত্তিক যত গুলো রিচুয়ালের উদ্ভব ঘটে, তার সাথে নারী ও মাতৃত্বের বিশেষ সম্পর্ক দেখা যায়। বিশেষত এমন ধারণা করা হয় যে, যেসব বিষয় বা পূর্বশর্ত নারীকে প্রজননক্ষম বা উর্বর করে, তা ভূমিকেও উর্বর করে।
এখানে উদাহরণ হিসেবে ঋতুস্রাবের কথা উল্লেখ করা যায়। নারীরা যেমন একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ঋতুমতী হন, একই ভাবে ভূমি বা ধরণীরও ঋতুপর্ব চলে। গ্রীষ্মের তাপদাহের পর তপ্ত পৃথিবীর বুকে যখন আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টি নামে, তখন আমাদের উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে পালিত হয় অম্বুবাচীর পারণ। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, এ কয়দিন ধরণীর ঋতুপর্ব চলে। এ সময় একজন ঋতুমতী নারীর মতোই ধরণীর প্রতিও অধিক যত্নবান হতে হবে। তাই এই নির্দিষ্ট সময়কালে জমিতে হলকর্ষণ এবং চাষাবাদ তো নিষিদ্ধই, এমনকি অন্য কোন কারণেও মাটি খোঁড়া যাবেনা।
আবার সন্তানসম্ভবা নারীকে যেমন সাধ খাওয়ানোর রীতি আছে, তেমনি কৃষি জমিকেও সাধ খাওয়ানোর রীতি দেখা যায় আমাদের উপমহাদেশে। শিবায়ন কাব্যে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে, ভোর রাতে কৃষক স্নান করে ভিজে কাপড়ে জমিতে সাধভক্ষণের অনুষ্ঠান করে থাকেন। এখানে সাধের উপকরণ হলো– আতপ চালের গুড়ো, কাঁচা তেঁতুল, কাঁচা হলুদ, ডাবের জল, কাঁচা দুধ, গঙ্গা জল, খেজুরের নতুন গুড়।
কিছু নেটিভ আমেরিকান জাতিগোষ্ঠীর বিশ্বাস অনুযায়ী, নারীরা যেহেতু সন্তানের জন্ম দিতে পারেন, তাই তারা ফসলের জন্মও দিতে পারবেন। নারীর উর্বরতাশক্তি কোন এক অতিপ্রাকৃতিক শক্তির বলে বীজের ভেতর ঢুকে যায়। তাই সেখানে নারীরাই সর্বদা ফসলের বীজ বুনতেন। তারা ধারণা করতেন, নারীরা ভুট্টা বুনলে প্রতি বৃন্তে তিনটি করে ভুট্টা ফলবে।
ধীরে ধীরে অর্গানাইজড রিলিজিয়ন এবং বিভিন্ন দেবদেবীর উত্থান হতে শুরু করলে দেখা যায়, কৃষি ও প্রজনন উভয়ের জন্য একই মাতৃকা শ্রেণীর দেবীর ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে। তবে জানা যায়, প্রাচীন সর্বপ্রাণবাদী সমাজে এই দেবীদের উত্থান শুরু হলে প্রাথমিক পর্যায়ে তাদের প্রতিকৃতি তৈরি হতো জমির ফসল দিয়েই। কারণ মানুষের বিশ্বাস ছিল ফসল কাটা শুরু হলে তার ভেতরের স্পিরিটটি দ্রুত ফসলের গোড়ার দিকে চলে যায়। তাই একবার ফসল কর্তন শেষ হলে সেই গোড়ার অংশ গুলো দিয়েই তৈরী হতো প্রতিকৃতি। অতঃপর তাকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যেই আয়োজিত হতো নানা উৎসব-পার্বণ। কালের বিবর্তনে পৃথিবীর নানা প্রান্তে উদযাপিত এই উৎসব গুলোই ধীরে ধীরে “নতুন ফসলের উৎসব” হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
সময়ের সাথে সাথে মাতৃকা শ্রেণীর এই দেবীরা আরও স্বতন্ত্র রূপ এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। হরপ্পা সভ্যতা থেকে অজস্র নগ্ন মাতৃমূর্তি পাওয়া গিয়েছে। গবেষকদের ধারণা, এর সাথে কৃষিভিত্তিক জাদুবিশ্বাসের সম্পর্ক রয়েছে। আবার একটি শিলে দেখা যায়, এক নারী ভূমিতে মাথা ঠেকিয়ে দু’ পা প্রসারিত করে রেখেছেন এবং তাঁর যোনী থেকে বেরিয়ে আসছে শাক-লতা-পাতা।
প্রাচীন সুমেরীয় অঞ্চলের উর্বরতা ও প্রজননের দেবী ইশতার। জানা যায়, প্রায় ছয় হাজার বছরের প্রাচীন এই দেবীর মন্দিরে গণিকারা অবস্থান করতেন। তাদের মনে করা হতো উর্বরতার এই দেবীর প্রতিনিধি। সেখানকার গম চাষিরা ব্রোঞ্জের মুদ্রার বিনিময়ে মন্দিরে থাকা গণিকাদের সাথে সঙ্গম করতে পারতেন। তবে এই সঙ্গম কেবল মনোরঞ্জনের কারণেই নয়, বরং তখনকার বিশ্বাস অনুযায়ী এটি ছিল ফসল উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্ববহ। আবার অনেক গবেষক দাবী করেন, আদিতে দেবী দুর্গাও ছিলেন শস্যদেবী। দুর্গাপূজার সাথে জড়িত নবপত্রিকা সে বিষয়টিই হয়তো নির্দেশ করে। এমনকি দেবী ইশতারের মতো দেবী দুর্গার পূজা উৎসবেও গণিকাদের উপস্থিতি ছিল বলে মনে করেন গবেষক নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। এর উল্লেখ পাওয়া যায় কালিকাপুরাণেও। মূলত শবর জাতিগোষ্ঠী একসময় দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে দশমীর রাতে ‘শাবরোৎসব’ আয়োজন করতেন, যেখানে নর্তকী ও গণিকারা উপস্থিত থেকে সকলের মনোরঞ্জন করতেন।
একই ভাবে প্রাচীন ভারতের ভূমি দেবী বা বসুন্ধরাও কিন্তু একাধারে কৃষিজমির উর্বরতা এবং প্রজননের জন্য পূজিত। বসুন্ধরা দেবীর সমকক্ষ গ্রীক দেবী হলেন গাইয়া। গাইয়াও একই ভাবে জমির উর্বরতা এবং সন্তান সন্ততি লাভের জন্য পূজিত হতেন।
তবে এখানে আরও চমকপ্রদ একটি বিষয় আছে। আমাদের এই উপমহাদেশের দেবদেবীরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপে বর্ণিত হয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তাঁরা তাঁদের মূল থেকে অনেকটাই সরে গিয়ে অন্য কোন রূপ ধারণ করেছেন। ঠিক তেমনটাই দেখা যায় রামায়ণের অন্যতম মূল চরিত্র “সীতা”র ক্ষেত্রে।
প্রাচীন ভারতে সীতা একসময় স্বয়ং কৃষিদেবী হিসেবেই পূজিত হয়েছেন। ঋগ্বেদে কৃষিদেবী হিসেবে উল্লেখিত আছে সীতার নাম। আবার অথর্ববেদে আছে সীতার স্তবক মন্ত্র–
"সীতা বন্দামহে ত্বাবর্চীসুভগে ভব
যথাঃ নঃ সুমনা অসো যথাঃ নঃ সুফলা ভব"
মৌর্য যুগে সীতা ছিলেন রাষ্ট্রীয় কৃষিদেবী। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের একটি অধ্যায়ের নাম 'সীতাধ্যক্ষ'। এই শব্দের অর্থ হলো– উচ্চপদস্থ কৃষি কর্মচারী।
তবে যদি রামায়ণের সীতার জন্মকথাকে একটু ভেঙে দেখি, তবে দেখবেন সেখানেও কৃষি ও যৌনতার অভাবনীয় একটি সম্পর্কের অস্তিত্ব আছে।
বলা হয়, মিথিলার রাজা জনক সন্তান লাভের আশায় আচার-প্রথা হিসেবে জমিতে লাঙ্গল দিলে জমি থেকে সীতার আবির্ভাব হয়। “সীতা” শব্দের অর্থই হলো জমিতে লাঙ্গল দেওয়ার ফলে সৃষ্ট দাগ। অর্থাৎ জমি আর লাঙ্গলের মিলনের চিহ্ন, ঠিক যেমন নারী পুরুষের মিলনের চিহ্ন হলো তাদের সন্তান। শাস্ত্র অনুযায়ী সীতা কিন্তু ভূমি দেবীরই কন্যা, আর রাজা জনক তাকে পেয়েছিলেন লাঙ্গল দিয়ে জমি কর্ষণ করতে গিয়েই।
আবার লাঙ্গল শব্দটির ধাতু হলো 'লঙ্গ'। লিঙ্গ শব্দের ধাতুও কিন্তু তা-ই। অর্থাৎ পুরুষের লিঙ্গ আর কৃষির লাঙ্গলকে সমতুল্য হিসেবে দেখা হয়েছে। তাই ভূমি যদি যোনী হয়, তবে লাঙ্গল হলো পুরুষাঙ্গ। লাঙ্গল দিয়ে হলকর্ষণের ফলে ভূমি যেমন উর্বর হয়, নরের সাথে মিলনে তেমনি নারীও হয় সন্তানসম্ভবা। সীতার জন্মকাহিনীতেও হয়তো এই বিষয়টিই প্রতিকীরূপে দেখা যায়।
শেষ করছি বাংলায় এসে। এখানেও ঘটেছে চমকপ্রদ আরেকটি ঘটনা। বাংলার কোচ সম্প্রদায় থেকে শুরু করে আরও অসংখ্য সম্প্রদায়, অঞ্চল ও সেখানকার লোক আচারে শিব ঠাকুরকে তাঁর বৈদিক ও পৌরাণিক রূপ থেকে সরিয়ে লৌকিক কৃষক হিসেবে দেখা হয়। ধর্মমঙ্গল কাব্যে শিবের এই কৃষক রূপ আরও উদ্ভাসিত হয়। শূন্য পুরাণে এই আলাপ আরও বিস্তর। শিব সেখানে আরও সাধারণ, একজন ভিক্ষুক। সংসার যখন অভাবে আর চলছে না, তখন তাঁর স্ত্রী গৌরী তাঁকে চাষাবাদ করার পরামর্শ দিলেন।
চাষের জন্য তিনি বলদ, লাঙ্গল, মই, দড়ি সবই সৃষ্টি করলেন। কিন্তু বীজ পাবেন কোথায়? সেই নিয়ে আকুল হয়ে ভাবতে ভাবতে একদিন গৌরীর প্রতি শিবের কামভাব জাগ্রত হলো। আর সেই কামভাব থেকেই জন্ম নিলো পৃথিবীর প্রথম ধান “কামোদ”, যার থেকে ধীরে ধীরে পৃথিবীর সকল ধানের সৃজন হলো–
“কৌতুক করিতে শিবে উপজিত কাম।
কামে উপজিল ধান কামোদ বলি নাম।।
একধানে হইবাক সহস্রেক নাম।
ইহাতে আসিয়া লক্ষ্মী করিবে বিরাম।।”
— মুহাইমিনুল নীলয়
তথ্যসূত্র:
১। উপমা অধিকারী, “মাতৃকাশক্তির উপাসনা - পর্ব ১”, ফোকলোর এক্সপেডিশন বাংলাদেশ (২৬ ডিসেম্বর, ২০২৩)
২। স্বপনকুমার ঠাকুর, “বাংলার কৃষিকাজ ও কৃষিদেবতা”, খড়ি প্রকাশনী (২০২০)
৩। Sir James Frazer, “The Golden Bough”, Macmillan Publishers (1890)
৪। নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, “ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস”, জেনারেল প্রিন্টার্স (১৯৭৭)
৫। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, “লোকায়ত দর্শন”, নবশক্তি প্রেস (১৯৫৯)
৬। “আত্মা, শস্য, যৌনতা ও দেবত্ব”, ক্যানভাস (১ অক্টোবর, ২০২১)