💔 মাইকেল মধুসূদন দত্তের দাম্পত্য জীবন: প্রেম, পলায়ন ও পরিণতির এক করুণ কাব্য
তিনি ছিলেন শুধু কবি নন—একজন বিদ্রোহী আত্মা। বাঙালি সমাজের প্রচলিত ধ্যানধারণা, শাস্ত্র, পারিবারিক অনুশাসন—কোনো কিছুই বাঁধতে পারেনি তাঁর মন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, যিনি বিশ্বাস করতেন প্রেম হতে হবে প্রথম দর্শনে, বিয়ে হতে হবে ভালোবেসে—not সমাজ বা পরিবার দ্বারা নির্ধারিত পাত্রীতে।
তাঁর দৃষ্টিতে বাঙালি নারীরা ছিলো অশিক্ষিত, সীমাবদ্ধ, আর পশ্চিমা নারীদের মতো স্বাধীন বা আত্মবিশ্বাসী নয়। এমন নারীর সঙ্গে সংসার তাঁর কল্পনায় আসতে পারেনি। কিন্তু বাস্তব বড়ই কঠিন—ঊনিশ বছর বয়সেই তাঁর জন্য পরিবার পাত্রী ঠিক করে ফেলে।
তিনি জানতেন, সরাসরি প্রতিবাদ করলে হয়তো সমাজচ্যুত হবেন, কিন্তু ভেতরে ভেতরে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছিল। সেই আগুন তাঁকে ঠেলে দিলো ধর্মান্তরের পথে। ১৮৪৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি, বিয়ের ১৫ দিন আগে, তিনি খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। এ যেন এক নাটকীয় মুক্তি—ধর্ম বদলে পরিবার ও সমাজের পছন্দের বিয়েকে প্রত্যাখ্যান!
এভাবেই "মধুসূদন দত্ত" থেকে হয়ে উঠলেন "মাইকেল মধুসূদন দত্ত"।
🌹 প্রথম প্রেম: রেবেকা—এক অনাথ কিশোরীর প্রেমে কবি
নবধর্ম গ্রহণের পর তিনি গিয়ে উঠলেন মাদ্রাজে, যেখানে শিক্ষকতা করতে গিয়ে পরিচয় হলো এক শ্বেতাঙ্গ অনাথ তরুণী, রেবেকা ম্যাকটাভিশ-এর সঙ্গে। তাঁর সেই স্বপ্নের "নীল নয়না" যেন এসে দাঁড়াল বাস্তবে।
সমাজের কটাক্ষ, বর্ণবিদ্বেষ উপেক্ষা করে ১৮৪৮ সালের ৩১ জুলাই, রেবেকাকে বিয়ে করলেন কবি। এটা ছিল সাহসের চূড়ান্ত প্রকাশ—দেশি কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ তখন কোনো শ্বেতাঙ্গ নারীকে বিয়ে করে এমন দৃষ্টান্ত ছিল না।
দু’জনেই নিঃস্ব, কিন্তু ভালোবাসায় ছিল না কোনো অনটন। সংসারে আসলো চারটি সন্তান—কিন্তু জীবন দিতে লাগলো চেপে। মাত্র ৪৬ টাকার চাকরি দিয়ে চার সন্তান ও স্ত্রীর ভরণপোষণ, আর কবির শিল্পীসুলভ বিলাসিতা একসঙ্গে চলছিল না।
রেবেকা অসুস্থ হয়ে পড়ে সন্তান প্রসবের পর। তখন সে তার স্বজনদের বাড়ি চলে যায়। আর ঠিক সেই সময়েই কবি ভালোবেসে ফেলেন আরেকজনকে।
🌑 দ্বিতীয় অধ্যায়: হেনরিয়েটা—সহানুভূতির ছায়ায় জন্ম নেয় নতুন প্রেম
জর্জ হোয়াইট ছিলেন কবির সহকর্মী ও বন্ধু। হোয়াইটের স্ত্রী মারা যাওয়ার পর, তার বড় মেয়ে হেনরিয়েটার জীবন হয়ে ওঠে অস্থির—বিমাতা, দুঃখ, অবহেলা। আর সেই দুঃখ-ছায়ায় কবির মনে জন্ম নেয় এক নতুন সহানুভূতি, যেটি প্রেমে পরিণত হয়।
রেবেকা তখন তৃতীয় সন্তানের গর্ভে, চতুর্থ সন্তানের অপেক্ষায়। আর মাইকেল নতুন প্রেমে বিভোর।
কলকাতা থেকে পিতার মৃত্যুর সংবাদ আসে। একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে ফিরে আসেন মাইকেল। আর ফিরে আসার আগেই তাঁর প্রেমের খবর জানাজানি হয়। রেবেকা সেই বিশ্বাসঘাতকতায় এতটাই আহত হন যে আর কখনো কবির কাছে ফেরেননি।
🥀 ভেঙে পড়া দুটি সংসার, নতুন সংসারে বিলাস আর বিচারের পালা
হেনরিয়েটা কলকাতায় এলে কবি তাঁর সঙ্গে নতুন সংসার শুরু করেন। কবি তখন খ্যাতিমান, পৈতৃক সম্পত্তিও কিছুটা উদ্ধার করেন। কিন্তু হেনরিয়েটা তাঁর স্ত্রী নন—কারণ রেবেকা তাঁকে তালাক দেননি, আর খ্রিষ্ট ধর্মে একাধিক স্ত্রী বৈধ নয়। এ ছিল এক অসম্পূর্ণ, কিন্তু গভীর সম্পর্ক।
পরে, ব্যারিস্টারি পড়ার আশায় কবি বিলেতে রওনা দেন। হেনরিয়েটা সন্তানদের নিয়ে পেছনে পড়ে থাকেন। দেশে স্বার্থান্বেষী আত্মীয়রা সম্পত্তি থেকে তাদের উচ্ছেদ করতে উঠেপড়ে লাগে। বাধ্য হয়ে হেনরিয়েটা সন্তানদের নিয়ে লন্ডনে কবির কাছে চলে যান। সেখানে শুরু হয় কবির ঋণের পাহাড়, হেনরিয়েটার মাদকাসক্তি ও নিদারুণ দারিদ্র্য।
ফিরে আসেন দেশে—ধার করে থাকা, ঘন ঘন বাসা বদল, মদ্যপান, অসুস্থতা—সব মিলিয়ে কবির পতনের শেষ অধ্যায় শুরু হয়। গলায় ঘা, রক্তপাত, জ্বর, চলাফেরা করতে না পারা। আশ্রয় মেলে বস্তিতে। আরেকবার কবি কন্যার বিয়ের ব্যবস্থা করে কষ্টের ভার লাঘব করতে চান। কিন্তু ভাগ্য সেখানে থেমে থাকেনি।
🖤 অন্তিম দিন ও চিরবিদায়: যখন কবিতা আর প্রেম শেষ অবধি পৌঁছায়
১৮৭৩ সালের ২৬ জুন, হেনরিয়েটা ৩৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তার মাত্র তিনদিন পর, কবি নিজেও মৃত্যুবরণ করেন ২৯ জুন—এক অশ্রুমাখা, অর্থহীন প্রতিজ্ঞার মতো।
এ যেন পরিণতি নয়, এক দীর্ঘশ্বাসের নাম।
রেবেকা, যিনি কবির প্রেমে সমস্ত সমাজের প্রতিবাদ উপেক্ষা করেছিলেন, পরে আর কখনো তাঁর কাছে ফিরলেন না—তবু তিনিই বেঁচে থাকলেন দীর্ঘদিন, ১৮৯২ সাল পর্যন্ত। হয়তো রেবেকা ছিলেন তাঁর বাস্তব সংসারের প্রতীক, হেনরিয়েটা তাঁর কল্পনার রাজরানী।
🕯️ শেষ কথা
মাইকেল মধুসূদন দত্তের দাম্পত্য জীবন যেন এক ট্র্যাজিক মহাকাব্য—ভালোবাসা, প্রতারণা, আত্মতৃষ্ণা, বিদ্রোহ, বিলাসিতা ও চূড়ান্ত নিঃস্বতার এক দীর্ঘ অভিসার। এখানে প্রেম আছে, ত্যাগ আছে, কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে যে বেদনার দীর্ঘ রেখা ছড়িয়ে আছে, তা তাঁর কাব্যকেও ছুঁয়ে যায়।
একজন কবির অন্তরের গভীরে যে আর্তনাদ ছিলো—তা শুধু শব্দে নয়, জীবনে ফুটে উঠেছে।
যেন সত্যিই তিনি জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন—
"বিধাতা, তুমি একই সাথে আমাদের দু’জনকে নিলে না কেন?"
✍️ লেখাটি ভালো লাগলে—লাইক, শেয়ার ও অনুসরণ করুন
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন