রাজা রামমোহন রায়ের প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধা।
~~~ রাজা রাম মোহন রায় ও রংপুর ~~~
রাজা রাম মোহন রায় এক জন বাঙালি দার্শনিক ও বাংলার পূনর্জাগরণের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। রামমোহন রায় ছিলেন যুক্তিবাদী ও মুক্ত চিন্তার ধারক। হিন্দু সমাজের কুপ্রথা ও কুসংস্কার তিনি মেনে নিতে পারেননি। এক ঈশ্বরবাদে বিশ্বাস করতেন। তাঁর মতে নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা করাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। তাই দেব দেবীর পূজা করা হিন্দু ধর্মের বিরোধী। আর এই বিশ্বাস থেকে তিনি দ্বারকানাথ ঠাকুরের সহিত ব্রাহ্মসমাজ স্থাপন করেন। তিনি সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত হয়েছেন সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত করার প্রচেষ্টার জন্য। তাঁর জীবন ও কর্মের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় অধিকার করে আছে রংপুর। রাজা রাম মোহন রায়ের স্মৃতি ধারণ করে রংপুরের মাটি ধন্য।
১৭৭২ সালের ২২ মে হুগলী জেলার রাধানগর গ্রামে রামমোহন রায় জন্মগ্রহণ করেন এক সম্ভ্রান্ত কুলীন (বন্দোপাধ্যায়) ব্রাক্ষ্মণ বংশে। বারাণসী থেকে প্রথাগত সংস্কৃত শিক্ষার পর তিনি পাটনা থেকে আরবী ও পারসী ভাষা শেখেন। পরে তিনি ইংরাজী, গ্রীক ও হীব্রু ভাষাও শেখেন। ১৭৯৬ সালে রামমোহন অর্থোপার্জনে শুরু করেন। ১৮০৩ থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী ছিলেন। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাজে সিভিলিয়ান কর্মচারীদের মধ্যে জন ডিগবীর সঙ্গে তাঁর সর্বাধিক ঘনিষ্ঠতা হয়। জন ডিগবি রংপুরের কালেক্টর থাকাকালীন কোম্পানির কাজে ডিগবীর অধীনে তিনি দেওয়ানরূপে রংপুরে কাজ করেন ১৮০৯ এর ২০ অক্টোবর থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত। বিলুপ্ত তামপাট ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের স্থানেই ছিল তাঁর বাসভবন। তাঁরা কারণেই ঐ এলাকার নাম দেওয়ানটোলা। ২০০ বছর আগের সেই আবাস স্থানের আর কোন চিহ্ন অবশিষ্ট নেই।
রাজা রামমোহন রায়ের জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, রংপুরে অবস্থানকালেই তাঁর মধ্যে একেশ্বরবাদী চেতনার বিকাশ ঘটেছিল। সেই সময় রংপুরের মানুষের মধ্যে তিনি একেশ্বরবাদ প্রচারও করেছেন। প্রতিদিন সন্ধ্যা বেলা তাঁর বাড়িতে (মীরগঞ্জ, সাবেক তামফাট ইউপি) ব্রাহ্মণ পণ্ডিত, সাধু সন্ন্যাসী, মুসলমান মৌলভী, জৈন মাড়োয়ারি প্রভৃতি অনেক সম্প্রদায়ের মানুষের সমাগম হতো। তিনি রামমোহন পণ্ডিতদের সাথে ধর্মীয় বিতর্ক করতেন। তিনি তাঁদেরকে পৌত্তলিকতার অসারত্ব, ব্রহ্মজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে দিতেন। ওই বাড়িতে বসেই তিনি কয়েকটি ঐতিহাসিক ফারসি গ্রন্থ রচনা করেন। বিখ্যাত গ্রন্থ বেদান্তের সূচনা করেন মীরগঞ্জের বাড়িতে বসেই। এখানেই অধ্যয়ন করেছিলেন অন্যান্য জৈন ধর্মগ্রন্থগুলির। এই সময়টা ছিল তাঁর ভবিষ্যতের কাজের জন্য কঠোর প্রস্তুতির সময়। যার প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন তিনি রংপুর ত্যাগের এক যুগ পর। কোলকাতায় গড়ে তুলেছিলেন ব্রাহ্ম সভা, যা পরে ব্রাহ্ম সমাজে রূপান্তরিত হয়।
রংপুরে অবস্থানকালে ১৮১০ সালের ৮ এপ্রিল রামমোহনের বড় ভাই জগমোহন রায় মারা গেলে তাঁর স্ত্রী অলনমনি দেবী সহমরণে যান। লাশের সঙ্গে একটি জীবিত মানুষের করুণ মৃত্যুর বিবরণ শুনে রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা রদ করার দৃঢ় সংকল্প করেন, যা ছিল ব্রাহ্মধর্মের অন্যতম পদক্ষেপ।
১৮১৪ সালে কালেক্টরেট ডিগবি রংপুর থেকে চলে গেলে রাজা রামমোহন রায়ও সেখান থেকে কলকাতা চলে যান। দিল্লির বাদশাহ আকবর তাঁকে রাজা উপাধি দিয়েছিলেন। মূলত তাঁর নির্দেশেই রামমোহন ১৮৩১ সালের ৮ এপ্রিল বিলাতে যান। সেখানে তিনি বাদশাহ আকবরের পক্ষে রাজা চতুর্থ উইলিয়ামের সঙ্গে বৈঠক করেন। বিলাতে থাকাকালে অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি ১৮৩৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর সেখানে মারা যান। ব্রিস্টল শহরের সেলটিন গ্রেভে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
রাজা রাম মোহন রায়ের স্মরণে তাঁর মৃত্যুর প্রায় এক শত বছর পরে রংপুর কালেক্টরেটের কর্মচারীবৃন্দের উদ্যোগে ১৯২৬ সালে তাঁর স্মৃতিধণ্য রংপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় রাজা রাম মোহন ক্লাব। স্থাপনা নির্মাণের জন্য রাধাবল্লভ মৌজায় ৪০ শতাংশ জমি কেনা হয় এক হাজার ৫০০ টাকায়। আজকের রাজা রাম মোহন ক্লাস মার্কেট কমপ্লেক্সের স্থানেই ছিল সামনে ফাঁকা জায়গাসহ দেয়াল ঘেরা স্বাভাবিকের চেয়ে উঁচু টিনের চালাওয়ালা রাম মোহন ক্লাবের পাকা দালান। যা আমরা অনেকেই দেখেছি। সেই ক্লাব ভবন ভেঙে নব্বইয়ের দশকের শেষদিকে এসে নির্মাণ করা হয় রাজা রাম মোহন ক্লাস মার্কেট কমপ্লেক্সের। ২০০৯ সালের ২৫ আগস্ট দেশ বরেণ্য ভাস্কর এবং রংপুর কৃতি সন্তান অনীক রেজার Aneek Reza করা রাজা রাম মোহন রায়ের ম্যুরাল মার্কেটে স্থাপন করা হয়।
আজ ২৭ সেপ্টেম্বর, রাজা রামমোহন রায়ের প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধা।
তথ্য সূত্র :
মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়ের জীবনচরিত : নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়
২০১১ সালে রংপুর রাজা রামমোহন ক্লাব প্রকাশিত ‘স্মারকগ্রন্থ’
রাজা রামমোহন রায় ও রংপুর : এ্যাডঃ মোহাম্মদ জগলুল, রংপুর আইনজীবী সমিতির স্মরণিকা (২০০৭)।
ফেইসবুক থেকে কপি করে পেস্ট করলাম
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন