সাদি মহম্মদঃ তবু সে দেখিল কোন ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেল তার?
শোনা গেল লাসকাটা ঘরে নিয়ে গেছে তারে;কাল রাতে— ফাল্গুনের রাতের আঁধারে যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ মরিবার হ’লো তার সাধ;
যেন জীবনানন্দের আট বছর আগের সেই কবিতা দ্বিতীয়বার লিখে গেলো সংগীতের পরম গুরু সাদি মহম্মদ।
গত পরশু রাতে যখন সে ভয়ানক সংবাদ শুনলাম, হঠাৎ ঝড়ে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলাম। বন্ধু জ্যেতি (জ্যেতি জয়েন উদ্দীন) টেলিফোনেই হাউমাউ করে কেদেঁ উঠলো।ছুটলাম সাদির বাড়ি। শিবলী, নাসরিন, ইয়াসমিন (ওরা তিনজনই সাদির ছোট) ওদের মুখ দেখে শঙ্কায় ফ্যাকাসে হয়ে গেলাম। মানতে পারছিলাম না সাদি চলে যাবার জন্য সব থেকে কঠিনতম পথটি বেছে নেবে।এমন নরম মনের নিরব এক মানুষ কি করে তা পারে। কি ব্যথা ছিলো, কি অভিমান ছিলো? জীবন কতটা দুসঃহ ভার হয়ে উঠেছিলো যে এমন ভাবে ঘুমিয়ে পড়তে হলো
“কোনোদিন জাগিবে না আর
জানিবার গাঢ় বেদনার
অবিরাম— অবিরাম ভার
সহিবে না আর—’
মন ভেঙে যাচ্ছিল তবু ভেবেছি যেহেতু এটি তার নিজের সিদ্ধান্ত তাকে সম্মান জানানো উচিত। কিন্তু মেনে নিলেই কি তার কাছে আমার দীর্ঘ মেয়াদি ঋণ পরিশোধ হয়ে যাবে? যে সিদ্ধান্ত তার মতো একজন শিল্পী নিতে বাধ্য হলো সে সিদ্ধান্ত নেবার পেছনে কি আমার বা আমাদের দায় নেই? নিশ্চয় আছে। স্বল্প সময়ের মধ্যে সাদি তার বড় আপাকে (পারভিন আপা,শাওনের মা ) হারায়। তার কিছুদিন পর তার প্রিয়তম মা চলে যান। একাকী হয়ে পড়তে থাকে সাদি।নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়ে ভেতরে বাইরে কিন্তু কাউকে বুঝতে দেয় নি।সাদি ছিল অসম্ভব নরম মনের এক হৃদয় খোলা মানুষ। চাপা স্বভাবের সে ছিলো না।সেই মানুষ কোন অভিমানে এমন পাথর
হয়ে গেলো। খ্যাতির লোভ তার কোনদিন ছিলো না। অন্যের প্রাপ্তিতে নিজেকে উজার করে আনন্দ করতে দেখেছি ।জীবনের সব প্রাপ্তিই তার ছিলো। খ্যাতি ছিলো, অর্থ ছিল কিন্তু তারপরেও কেন?
‘জীবনের এই স্বাদ– সুপক্ব যবের ঘ্রাণ
হেমন্তের বিকেলের–তোমার অসহ্য বোধ হ’লো;মর্গে কি হৃদয় জুড়োলো মর্গে— গুমোটে থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো রক্তমাখা ঠোঁটে।”
তাকে যতো কাছ থেকে আমি জেনেছি দেখেছি আর কেউ তাকে সে ভাবে দেখেছে বলে আমার মনে হয় না।
সাদি যখন খ্যাতির কৈশরে তখন আমি এবং আমরা
তার ছায়া সঙ্গী ছিলাম।আমরা বলতে বন্ধু জ্যোতি, কামরুল আহসান ( এখন আমেরিকা প্রবাসী) কামরুল হাসান মন্জু , হাসান আরিফ, সুজন এবং হায়দার। সুজন ও হায়দার সাদির গানের ছাত্র ছিলো ।
সাদির গানের ক্যাসেট প্রথম এরাই প্রকাশ করেছিলো।সাদির সাথে আমার প্রথম পরিচয় ঘটেছিল বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে সাদির প্রথম এবং একক রবীন্দ্র সংগীত অনুষ্ঠানে।ততদিনে সাদি কবি আসাদ চৌধুরীর উপস্থাপনায় , খ, ম হারুন ভাইয়ের প্রযোজিত বিটিভির প্রচ্ছদ অনুষ্ঠানে পুরানে দিনের গান গেয়ে হৈচৈ ফেলে দিয়েছে। বিশেষ করে শাকিলা জাফরের সাথে গাওয়া “সুরের এই ঝরঝর ঝর্ণা
তখন তুমুল জনপ্রিয় । সেই সময় তার রবীন্দ্র সংঙ্গীতের অনুষ্ঠান আমাদেরকে বেশ আগ্রহী করে তোলে।বাংলাদেশে তখন পাপিয়া সারোয়ার আর কাদেরী কিবরিয়া খ্যাতির মধ্য গগনে। বন্যাদিও তখন বেশ ঝড় তুলেছেন।এমন সময় নতুন এক আবেদন নিয়ে এলো সাদি। বিরল শ্রুত গানে মন্ত্র মুগ্ধ করে রাখলো গোটা শ্রোতা দর্শক। সেই অনুষ্ঠানে আমি এক গানের অনুরোধ করেছিলাম। সেই থেকেই সাদির সাথে আমার পরিচয় শুরু । বলেছিল “বাসায় এসো আরো আনকমন গান গেয়ে শোনাব।”
এরপর সাদির বাসায় বহুবার গেছি। সে সময় প্রায়শই
আমার খাবার পয়সা থাকতো না। সাদি গান শুনাতো
খাবার খাওয়াতে। সাদির তখন নিজেরও উপার্জন তেমন ছিলো না তবু আসবার সময় জোর করেই আমার পকেটে টাকা ভরে দিত।আমি থাকতাম জাকির হোসেন রোডে। সাদির বাড়ি তাজমহল রোডে। খুব দূরে নয় তবু সেখান থেকে আমাকে নিয়ে যেয়ে ওদের বাড়ির নীচের তলার বড়ো একটা রুমে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে । পরে সেখানে মন্জু ভাইও উঠে আসেন।সেই থেকে আমার সাথে সাদির বন্ধুত্ব এক পরম বন্ধুর রূপ নেয়। তার মানে এই নয় যে আমার মধ্যে সাদি গানের প্রতিভা দেখেছিলো, একদম তা নয়। সাদি সব সময় একটু শান্ত আশ্রয় খুঁজতো আমরা হয়তো তাকে সেই ছায়াটুকু দিতে সমর্থ হয়েছিলাম। এমন এক সময় সাদির মাধ্যমেই আমার পরিচয় হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাঈম আলীর সাথে। সাদি ডাকতো মিঠু আপা বলে । আমি ডাকা শুরু করলাম মিঠু আপা ।সাদি ততদিনে গানের সংগঠন রবিরাগের প্রতিষ্ঠা করেছে । মিঠু আপা সেই রবিরাগের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। নিজেও সাদির কাছে রবীন্দ্র সংগীতের তালিম নিতেন।সাদি মিঠু আপাকে বলে আমার জন্য তার বাসায় একটা টিউশনির ব্যবস্থা করে দেয়। মিঠু আপা তার তিন ছেলে মেয়েকে পড়ানোর বিনিময়ে আমাকে যে টাকা দিতেন
তা ছিলো আমার জন্য আলাদীনের প্রদীপের মতো।এটা আমার একার বলে নয় এরকম কতো মানুষের জন্য সাদির অবদান আছে তা সংখায় নিরুপন করা যাবে না।সাদি শুধু গানের শিল্পী বা সুরকার ছিলো না। সাদি বোধহয় প্রবাদ প্রতিম শিল্পী শ্রদ্ধেয় ওয়াহিদুল হকের পর দ্বিতীয় যে নিজস্ব ঘরানা আর অসংখ্য রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী সৃস্টি করেছেন।
সাদি দেশের মধ্যে যেখানে গান গাইতে যেতো আমি আর জ্যোতি তার সফর সঙ্গী হতাম।আমাদের উপর
তার একটায় একান্ত অনুরোধ ছিলো তার অনুষ্ঠানের দিন আমরা যেন গান না গাই।আমরা গাইলে নাকি সাদি গানের আসল সুর হারিয়ে ফেলতো।
দ্রততম সময়ের মধ্যে সাদি খ্যাতির মধ্য গগণ স্পর্শ
করে। নিজের কলেজের শিক্ষকতা, গান, সংগঠন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।আমরাও ধীরে ধীরে জীবনের ব্যস্ততায় দূরত্ব রচনা করে তুলি।দূর থেকেই বেশী দেখি
খুব বেশী কাছে যাইনি। কখনো ভুলেও ভাবিনি ভেতরে ভেতরে মানুষটা এতো একা। এতো নিসংগ।
সব থেকেও কোন কোন শিল্পী মানুষের কিছু থাকে না ।
“অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়—আরো-এক বিপন্ন বিস্ময় আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে; আমাদের ক্লান্ত করে
ক্লান্ত— ক্লান্ত করে; লাসকাটা ঘরে সেই ক্লান্তি নাই; তাই লাসকাটা ঘরে চিৎ হ’য়ে শুয়ে আছে টেবিলের ’পরে।”
আমরা সেটা বুঝতে বড়ো দেরী করে ফেললাম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন