এক সময় ময়মনসিংহের প্রতিটি গ্রামেই ফক্সটেইল মিলেট বা কাউনের চাষ হতো। কাউন ছিলো গরীবের খাবার। কাউন চালের ভাত এবং জাউ বেশ জনপ্রিয় ছিল। চৈত্র বৈশাখ মাসে ক্ষেতে ক্ষেতে কাউনের ছড়া দুলতো। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে ইরি,বোরো ধানের আবাদ শুরু হয়। এরপর থেকে ক্রমেই কমতে থাকে কাউন চাষ। ইরি বোরো চাষ যত বিস্তার লাভ করে কাউনের চালের চাহিদাও পড়তে থাকে। কৃষকেরা ততই কাউন চাষ কমিয়ে দেয়। কাউনের চাল বাজারে সহজলভ্য হলে অগণিত মানুষ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, অবেসিটি, অভারওয়েট ইত্যাদি ভয়াবহ সমস্যা থেকে প্রতিকার পাবে।
গরিবদের খাবার কাউন এখন উচ্চ দামে বিক্রি হয়।কাউনের চাল এখন ধনীদের বিলাসী খাবারে পরিণত হয়েছে। কাউন চাষে আবার কৃষকদের আগ্রহ বাড়ছে। কারণ এখানে খরচ কম লাভ বেশি। কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী এক বিঘা জমিতে কাউন চাষে মোট ব্যয় হয় ৭-৮ হাজার টাকা। ফলন ভালো হলে এক বিঘা জমিতে উৎপাদন হয় ১৫-১৮ মণ। ফসল পরিপক্ব হতে সময় লাগে প্রায় তিন মাস। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলে কাউনের চাষ হয়ে থাকে। প্রায় সব ধরণের মাটিতেই কাউনের চাষ করা যায়। তবে পানি জমে না এরকম বেলে দো-আঁশ মাটিতে ফলন ভালো হয়।
জোয়ার, বাজরা, রাগি, শ্যামাচাল, কাউন, চিনা, ঢেমসি ইত্যাদি দানাশস্যগুলোকে মিলেট বলা হয়। মিলেট গ্লুটেন মুক্ত, ডায়েটারি ফাইবার সমৃদ্ধ এবং পুষ্টিগুণে ভরপুর। প্রতিকূল ও শুষ্ক পরিবেশে এই ফসল আবাদ হতে পারে। অল্প বৃষ্টিপাতে অনুর্বর মাটিতেও মিলেটের ফলন ভাল হয়! তাই একে বলা হয় 'অলৌকিক শস্য' বা 'মিরাকল মিলেট'। এই ফসলের উৎপাদন রাসায়নিক সারের উপর নির্ভরশীল নয়। গম ও ধানের চেয়ে মিলেট প্রায় ৩-৫ গুণ বেশি পুষ্টিকর। ভারতের হরপ্পা সভ্যতার যুগে, চীনের নবপ্রস্তরযুগে ও কোরিয়ার মুমুন যুগে খাদ্যশস্য হিসেবে মিলেট চাষ হতো। অনুমান করা হয় প্রাগৈতিহাসিক যুগে ধানের চেয়ে মিলেট চাষই বেশি হতো।
ফক্সটেইল মিলেট হিন্দিতে কাংনি নামে পরিচিত। ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ১৬ রকমের মিলেট চাষ হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- সরঘাম (জোয়ার), পার্ল মিলেট (বাজরা), ফিংগার মিলেট (রাগি), বার্নইয়ার্ড মিলেট (শ্যামা চাল), ফক্সটেল মিলেট (কাউন চাল), বাকহুইট (কুট্টু), লিটল মিলেট (কুটকি), প্রোসো মিলেট (চীনা), কোডো মিলেট (কোড়ো), অ্যামারান্থাস (চৌলাই), ব্রাউনটপ মিলেট ইত্যাদি। গুজরাট, রাজস্থান সহ ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে মিলেট থেকে তৈরি খাবার খাওয়ার চল বেশি।
বিস্কুট, পোরিজ, উপমা, খিচুড়ি, পোহা এবং সালাদ তৈরি করা যায় কাউন দিয়ে। অতিথি আপ্যায়নে, উৎসব-পার্বণে কাউনের পায়েশের বেশ প্রচলন আছে। কাউনের চালে নানা রকমের রেসিপি তৈরি করা যায়। সাধারন চালের মতই কাউনের চাল দিয়ে পোলাও, বিরিয়ানী, ভাত, জাউ, খিচুরি, পায়েশ, বেকারিজ ইত্যাদি করা যায়। এই খাবারগুলো খেতে যেমন সুস্বাদু তেমনি পুষ্টিগুণে ভরপুর। বিশেষ করে কাউনের পায়েস খেতে খুবই সুস্বাদু হয়। কাউন চালের ভাত খেতে খুব সুস্বাদু। এই ভাত সবজি সিদ্ধ দিয়ে খেলে পরম তৃপ্তি পাওয়া যায়। ভাতের স্বাদের কারণে উপকরণ হিসাবে তরিতরকারী, মাছ-মাংস কম খেলেও তৃপ্তি আসে।
ফক্সটেইল মিলেট রান্না করার পদ্ধতি—
• মিলেট ভুল পদ্ধতিতে রান্না করলে অনেক সময় লাগবে। আর প্রেশার কুকারে বহুবার সিটি দিয়েও শক্তই থেকে যাবে। চাল বা গম ভিত্তিক খাবার রান্না করতে কম সময় লাগে। আর মিলেটের ক্ষেত্রে সময় বেশি লাগাই স্বাভাবিক। একটি পাত্রে মিলেট নিয়ে জলে ভিজিয়ে রাখুন। ৮-১০ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে পারলে খুব ভাল। আগের রাত থেকে ভিজিয়ে রাখা যেতে পারে। রান্নার সময় কমিয়ে আনার জন্য দানাশস্য ভিজিয়ে রাখা জরুরি।
• কাউনের পায়েস শিশুদের সবচেয়ে পছন্দের খাবার।
পায়েসের জন্য নিতে হবে কাউন চাল ৩৫ গ্রাম, দুধ ১ কেজি, গুড় পরিমাণমতো ও ঘি এক টেবিল চামচ। কাউনের চাল ধুয়ে ভিজিয়ে রাখতে হবে ছয় ঘণ্টা। এরপর দুধ ফুটিয়ে তাতে ভিজানো চাল ছেড়ে দিন। চাল ফুটে গেলে গুড় দিতে হবে। শেষে ঘি দিয়ে কিছুক্ষণ চুলায় রেখে ভালোমতো নেড়ে নামিয়ে ফেলতে হবে। পায়েস ঠান্ডা করে কাজুবাদাম, কাঠবাদাম, পেস্তাবাদাম দিয়ে সাজিয়ে পরিবেশন করুন।
• কাউনের মাখা ভাত তৈরির জন্য পোলাওয়ের মতো করে অল্প তেলে কাউন চাল ভেজে নিয়ে পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ, হলুদ, লবণ দিয়ে রান্না করুন। এরপর ঠান্ডা করে থেতো করা রসুন, ভাজা শুকনামরিচ আর সরিষার তেল দিয়ে ভালোভাবে মাখিয়ে নিন। বিভিন্নরকম ভর্তা, ডিম ভাজি দিয়ে পরিবেশন করতে পারেন মজাদার কাউন চালের মাখা ভাত।
ফক্সটেইল মিলেট এর উপকারিতা—
• ফক্সটেইল মিলেট রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করে, ত্বকের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায় এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি কমায়।
• উদ্ভিদ ভিত্তিক প্রোটিনের একটি ভাল উৎস মিলেট। পাশাপাশি এটিতে নিরামিষাশীদের জন্য দরকারী আয়রন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, নিয়াসিন, থায়ামিন এবং ভিটামিন রয়েছে।
• কাউন হজমে সহায়তা করে, কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
• কাউনের গ্লাইসেমিক সূচক নিম্ন। অর্থাৎ খাওয়ার পর রক্ত প্রবাহে গ্লুকোজ ছেড়ে দেয় ধীরে ধীরে। যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপকারী খাদ্য।
• কাউনের ফাইবার উপাদান এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট স্বাস্থ্যকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বজায় রাখতে সহায়তা করে।
• কাউনে ক্যালসিয়াম, জিংক, ফসফরাস এবং ম্যাগনেসিয়ামের মতো প্রয়োজনীয় খনিজ রয়েছে যা সুস্থ হাড় ও দাঁত এর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
• গ্লুটেন ইনটলারেন্ট ব্যক্তি বা যারা গ্লুটেন-মুক্ত ডায়েট ফলো করে তাদের জন্য কাউন একটি চমৎকার অপশন।
• কাউনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরকে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস থেকে রক্ষা করে। ইনফেকশন, হৃদরোগ, ক্যান্সার এবং ক্রনিক রোগের ঝুঁকি কমায়।
• ফক্সটেইল মিলেট ফ্ল্যাভোনয়েড ও ফেনোলিক যৌগ সমৃদ্ধ যা শরীরের ক্ষতিকারক ফ্রি র্যাডিকেলগুলোকে নিউট্রালাইজ করতে সাহায্য করে।
• মিলেটে পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালসিয়াম, আয়রন, জিঙ্ক, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম,পটাসিয়াম, ডায়েটারি ফাইবার, ফলিক অ্যাসিড, বিটা ক্যারোটিন, নিয়াসিন, লেসিথিন ইত্যাদি রয়েছে। তাই নিয়মিত খেলে অপুষ্টি দূর হয়।
• মিলেটে গ্লুটেন থাকে না। তাই শরীরে বাড়তি মেদ জমে না। মিলেট ওজন, বিএমআই এবং উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে।
• কাউন সহজে হজমযোগ্য সুপারফুড। কাউনের চালে আঁশ বেশি। তাই যেকোনো খাবার বানিয়ে খেলে পাকস্থলী ভালো থাকে।
• কাউনের চালে পর্যাপ্ত পরিমাণ মিনারেলস থাকায় নারীদের জন্য বিশেষভাবে উপকারি খাদ্য।
• ডায়াবেটিক রোগীর ঘনঘন খাওয়ার বদঅভ্যাস থাকে। ঘনঘন খাওয়া থেকে নিজেকে বাঁচাতে ডায়েটে কাউনের চাল রাখুন। আঁশযুক্ত শস্যদানা একবার খেলে দীর্ঘক্ষণ শক্তি সরবরাহ করে।
• গর্ভবর্তী মহিলাদের শরীরে আয়রনের অভাব দেখা যায়। কাউনের চালে আয়রন থাকে যা আয়রনের অভাব দূর করে।
• শারীরিক সৌন্দর্য ও ওজন ঠিক রাখার জন্য কাউনের চাল রোজকার ডায়েটে রাখুন। ফক্সটেইল মিলেট শরীর-মন সতেজ ও প্রানবন্ত রাখে।
• কাউনের চাল কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। যাদের সকালটা অনেক কষ্টের হয় তাদের জন্য কাউন চালের খাবার ভীষণ উপকারী।
• কাউনের চাল এনার্জির ঘাটতি পূরণ করে। শরীরকে কর্মক্ষম রাখতে প্রতিদিন নির্দিষ্ট মাত্রায় ভিটামিন এবং মিনারেলের প্রয়োজন। যা রোজ সকালের নাস্তায় কাউনের তৈরী খাবার খেলে সহজেই পাওয়া যায়।
ফক্সটেইল মিলেট খাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা—
• মিলেটে কারো কারো অ্যালার্জি বা সংবেদনশীলতা থাকতে পারে। ফক্সটেইল মিলেট খেলে যদি চুলকানি, ফুসকুড়ি, শ্বাস নিতে অসুবিধা এসব হয় তাহলে হেলথকেয়ার প্রফেশনালের পরামর্শ নিন।
• কাউনে ফাইটিক অ্যাসিড এবং ট্যানিনের মতো অ্যান্টিনিউট্রিয়েন্ট রয়েছে যা শরীরের পুষ্টি শোষণে বাধা দিতে পারে। ভিজানো, গাঁজানো কিংবা রান্না করলেই এ্যান্টিনিউট্রিয়েন্টগুলো আর থাকেনা।
• মিলেটের গোইট্রোজেনিক ইফেক্ট থাকতে পারে। ফক্সটেইল মিলেটে গয়ট্রোজেন থাকে। এই যৌগগুলি থাইরয়েড ফাংশনে হস্তক্ষেপ করতে পারে। যদি কারো থাইরয়েড রোগ থাকে তাহলে ডায়েটে মিলেট অন্তর্ভুক্ত করার আগে ডাক্তারের সাথে কথা বলে নিন।
• বাচ্চাদের জন্য যখন কাউন চালের রেসিপি করবেন সেগুলোতে সাদা লবণ, সাদা চিনি যোগ করবেন না। কাউনের তৈরি খাবার থেকে শিশুদের কোনও অসুবিধা হচ্ছে কিনা লক্ষ্য রাখতে হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন