ঢাকা থেকে বিলুপ্ত/ প্রায় বিলুপ্ত কিছু আদি পেশা।
(ষষ্ঠ পর্ব)
সারপোষ কারিগর:
ঢাকায় বিশেষ প্রক্রিয়ায় পান, তামাক ও হুক্কা তৈরি হতো। হুক্কা অনেকের ঘরেই থাকতো, থাকতো পানের দোকানেও। বড়লোকেরা ব্যবহার করতেন স্ফটিক বা বিদরী হুক্কা, আর গরিবেরা তামা থেকে শুরু করে মাটির হুক্কা। চিলিমের আগুন ঢাকবার ধাতব পদার্থের তৈরি নকশা করা ছিদ্র বিশিষ্ট ঢাকনাকে বলা হতো সারপোষ। তিন রকমের সারপোষ ছিল। যেমন- তন্দুরি, ডিমের আকার এবং কাবায়ি। কাবায়ি এর একটি বিশেষ গুণ ছিল। তাওয়ার উপর রাখলে তার রং পরিবর্তিত হতো। উনিশ শতকের শেষের দিকে ঢাকায় মাত্র একজন কারিগর অবশিষ্ট ছিলেন বলে জানা যায়। তাকে ডাকতে হতো মহারানী পুত্র বলে, তা না হলে তিনি সাড়া দিতেন না।
সিয়াহিওয়ালা:
ঢাকায় যারা লেখার কালি তৈরি করতেন এদের বলা হতো সিয়াহিওয়ালা। মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরা এই পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। জেমস ওয়াইজ এর বর্ণনা অনুযায়ী ১৮৮০ সালের দিকে ঢাকায় ১০ ঘর সিয়াহিওয়ালা ছিলেন।
বর্তমানে এ পেশাটি ঢাকা থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
শানদার:
বেদেদের একটি শাখা শানদার। বেদেদের আদি যে ব্যবসা অর্থাৎ ফেরি করা, পাখি ধরে বিক্রি করা, খেলা দেখানো এগুলোতে তারা অভ্যস্ত। কিন্তু ঢাকায় তারা বিশেষ একটি পেশা বেছে নেয়। ফারসি শাহানা থেকে এসেছে শানদার শব্দটি। এর অর্থ চিরুণি। নলখাগড়ার নরম কাঠ দিয়ে চিরুণির মতো ছোট একটি যন্ত্র তৈরি করতো তারা। ঢাকাবাসীরা যাকে বলতো হানা, উচ্চ বর্গীয়রা শাহানা। এর ভিতর দিয়ে সুতা চালানো হতো যে কারণে তাঁতি ও জেলেদের কাছে এ যন্ত্রের খুব চাহিদা ছিল। শাহানা থেকেই শানদার শব্দের উৎপত্তি। শানদারদের মতো এত ভালো শাহানা বা হানা কেউ তৈরি করতে পারত না। উনিশ শতকের দিকে বেদেদের এ বৃহৎ অংশ মুসলমান হয়ে যায়। শানদারারা ১৯০০ থেকে বসবাস করতেন ঢাকার দয়াগঞ্জে।
তেলি:
ঢাকা শহরে যে এককালে তেলি বা কলু নামের পেশার মানুষ বসবাস করত সেটি প্রায় অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে এখন। ঘানিতে ভেঙে তেল তৈরির কাজে নিয়োজিত এই পেশাজীবীদের মধ্যে যারা হিন্দু সম্প্রদায়ের ছিল তারা চণ্ডাল শ্রেণিভুক্ত। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ পেশার কিছু মানুষ দেখা গেলেও ঢাকায় এটি প্রায় অনুপস্থিতই বলা যায়।
রাঙ্গাওয়ালা:
নিম্নবর্ণের সোনার বণিকদের মধ্যে ছিল রাঙ্গাওয়ালাদের স্থান। উনিশ শতকের শেষ দিকে ঢাকায় চার পাঁচটি পরিবার ছিল রাঙ্গাবালা। এরা দস্তার পাত কলকাতা থেকে আমদানি করে সেই পাত গলিয়ে কাজ করতেন। দুর্গাপূজার প্রতিমা সাজানোর কাজ ছিল তাদের। অলংকার তৈরি করে তা দিয়ে প্রতিমা সাজাতেন বা সাজ বিক্রি করতেন এ রাঙ্গাওয়ালারা। এ পেশাটি বর্তমানে দেখা যায় না।
তাঁতি
ঢাকা শহরে যে বিপুলসংখ্যক তাঁতির বসবাস ছিল তা ভালোভাবেই জানা যায়। হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ এই পেশায় যুক্ত থাকলেও তদানিংতন সময়ে প্রধানত হিন্দু সম্প্রদায়ের তাঁতিরা ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিল। পুরান ঢাকার তাঁতিবাজার এলাকাটি এ পেশার মানুষদের স্মৃতি বহন করে চলেছে। তবে বিশেষ বিশেষ পদবি দেখে ঢাকার তাঁতিদের আবাসস্থল সম্পর্কে অনুমান করা যায়। বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁতিদের দেখা গেলেও ঢাকায় তাদের তেমন দেখা যায় না।
রাজমহল্লিয়া কুমহার:
ঢাকায় কুমারদের চারটি শাখা ছিল। রুদ্রপাল বড় ভাগী কুমার ছোট ভাগি কুমার ও মগী কুমার। এদের থেকে স্বতন্ত্র আরেক শ্রেণি কুমার বাস করতেন ঢাকায় এদের বলা হতো রাজমহল্লিয়া কুমহার। কুমহার নারীরা পাত্র গোল করতে সাহায্য করতেন আর পুরুষেরা পাত্রের উপর অংশ তৈরি করতন। জেমস ওয়াইজ এর তথ্য অনুযায়ী, গত শতকের আশির দশকে ঢাকার জাফরগঞ্জ, সুলতানগঞ্জ, কাওরান বাজার ও রায়ের বাজারে ২০০ কুমহার বসবাস করতেন। হিন্দি ও বাংলার মিশ্রণে এক নতুন ভাষা তৈরি করেছিলেন তারা।
রংরেজ:
ঢাকায় রংরেজ পেশা বেশ মর্যাদাকার ছিল বলে জেমস ওয়াইজ জানিয়েছেন। রংরেজকে ঢাকায় সাফি অর্থাৎ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতীক বলে গণ্য করা হযতো। এরা নিজেদের পেশার বাইরে বিয়ে করতেন না। বস্ত্র রঞ্জনে রংরেজরা অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। তাদের রঙের প্রধান উপকরণ ছিল কুমকুম। রং হতো দু'রকমের, গোলাপিও লাল। অন্যান্য রং মিশিয়ে মিশ্র রংও তারা তৈরি করতেন। তবে তাদের রং পাকা হতো না। বর্তমানে এ রংরেজ পেশাজীবীদের দেখা যায় না।
ঘাসি
ঘাস কাটার পেশায় একসময় এক শ্রেণির মানুষ নিয়োজিত ছিল। এরা চণ্ডাল শ্রেণির ছিল। নগরায়ণের চাপে উন্মুক্ত প্রান্তরের বিনাশ ঘটায় এখন এই পেশাজীবী শ্রেণিটি নেই। তবে ঘাস কাটার জন্য ঢাকার বিভিন্ন বাগান, অফিস বা সড়কে পরিচ্ছন্নতাকর্মী বা মালিরাই কাজটি করে থাকে। তাছাড়া, পশুখাদ্যে জন্য অনেকে শ্রমজীবী মানুষের দ্বারস্থ হলেও ঘাসি নামটি আমাদের মধ্য থেকে হারিয়ে গেছে।
তথ্যসূত্র:
ক। নোটস অন রেসেস, কাস্টস অ্যান্ড ট্রেডস অব ইস্টার্ন বেঙ্গল, জেমস ওয়াইজ।
খ। ঢাকা: স্মৃতি-বিস্মৃতির নগরী: মুনতাসীর মামুন।
![]() |
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন