শর্করা— মানুষের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আলু, ধান, ভুট্টা, গম, চিনি— এমন সব জনপ্রিয় তারকাদের আড়ালে অনেকটা বিস্মৃতপ্রায় এক আদি শর্করার উৎস। মানকচু। বনে–জঙ্গলে বেড়ে ওঠা মানকচু দেখেই আমরা অভ্যস্ত। তবে এর চাষের নিদর্শন পাওয়া গেছে এশিয়ার অনেক প্রাচীন জনগোষ্ঠীর মধ্যে।
পলিনেশিয়া ও অস্ট্রোনেশীয়ার আদি কৃষিতে শর্করার উৎস হিসাবে যে চারটি প্রধান কচুর প্রজাতি চাষ করা হতো তার মধ্যে মানকচু একটি। এখনও ওশেনিয়া, মাদাগাস্কার, তাইওয়ানের অনেক এলাকায় মানকচুর চাষ হয়। এবং সেসব এলাকায় বিয়ে থেকে শুরু করে সামাজিক উৎসব এমনকি ধর্মীয় উৎসবেও মানকচু থেকে তৈরি করা খাবারের চল রয়েছে।
আজ বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত ভাত বা ধান যেভাবে আমরা দেখি এই পর্যায়ে আসতে বুনো ধানকে নিয়ে অনেক সাধনা করতে হয়েছে। বুনো ধানকে পোষ মানানোর এই কঠিন শ্রম ও সময়সাধ্য প্রক্রিয়া বলে দেয়, শর্করার জন্য দানা শস্যের আগে কন্দ জাতীয় শস্য মানুষের খাদ্য তালিকায় স্থান করে নিয়েছিল। কারণ তার চাষ প্রক্রিয়া সহজ। আবার চাষ না করলেও অনুকুল পরিবেশে আপনা আপনিই জন্মায় এসব উদ্ভিদ।
খনার বচনে আছে— ‘ওলে কুটি মানে ছাই, এইরূপে কৃষি করগে ভাই’। খনার বিস্তৃতি অনুযায়ী ধারণা করা যায় শ্রীলঙ্কা, বাংলা, আসাম, উড়িষ্যা এসব অঞ্চলেও মানকচুর চাষের প্রচলন ছিল। তবে খাদ্য তালিকায় কচু বা মানকচুর নিচু জাতে নেমে আসার কারণটা বোধহয় উপমহাদেশে একের পর এক দুর্ভিক্ষ। যখন শোষকের গ্রাসে হারানো চাষের ফসলের নাগাল না পেয়ে মানুষকে প্রাণ ধারণ করতে হয়েছিল আপনজালা এসব উদ্ভিজ্জ খাদ্যের ওপর। পুর্বজদের অভিজ্ঞতার সেই বিতৃষ্ণা আমাদের স্মৃতিতেও প্রবাহমান। তাই শাকপাতা–কচুঘেঁচু এত বৈচিত্রময় সম্ভার ও গুণাগুণ নিয়েও এদেশে আভিজাত্য বিরোধী বলে বিবেচিত হয়। অতিথি আপ্যায়ন কিংবা উৎসবের খাবার হিসেবে এদের ব্যবহার সাধারণত দেখা যায় না।
বুনো মানকচু চাষের প্রাচীন নথি পাওয়া গেছে ইন্দোচীন অঞ্চলে, খ্রিস্টের জন্মেরও ১৩০০ বছর আগে। ফিলিপাইনে কচু জাতীয় ফসলকে বলা হতো ‘বিমা ফসল’। ঝড়, বন্যা, খরা তথা প্রাকৃতিক দুর্যোগ কালীন শর্করার চাহিদা মেটাতো বলেই এমন নাম। বাংলাদেশেও কৃষি জমির আইলে মানকচুর পাতা বা গাছ পুঁতে দিয়ে ভূমি পূজা করার চল আছে। প্রার্থনা করা হয় ফসল যেন মানকচুর মতো পুষ্ট ও বড়সর হয় আর ঝড়–জলেও টিকে থেকে খাদ্য জোগায়।
পুর্ণিমার রাতে ভরা জোয়ারের সময় বীজ বুনলে মানকচুর ফলন ভালো হয় বলে বিশ্বাস করেন অনেক কৃষক। আবার বীজ রোপনের সময় কৃষক যদি নিজের শরীর না চুলকান তাহলে সেই কচু খেলে গলাও চুলকাবে না এমন ধারনাও রয়েছে অনেক আদিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যে। ঋতুস্রাবের সময় কোনো নারীর প্রচণ্ড পেট ব্যাথা হলে তাকে মানকচুর একটা বড় পাতার ওপর বসিয়ে রাখা হয়। এতে ব্যাথা কমে আসে বলে মনে করেন নেগরিটোস জাতির নারীরা। এ ছাড়া দাঁতে ব্যাথা, কোষ্ঠকাঠিন্য চিকিৎসায়, ক্ষত নিরাময়ে, সন্তান প্রসবে, প্রসুতি মায়েদের পথ্য হিসেবে মানকচুর নানা রকম ব্যবহার সমগ্র এশিয়া জুড়েই প্রচলিত। তাগবানোয়া আদিবাসীদের মধ্যে বাতের ব্যাথার চিকিৎসায়ও মানকচুর ব্যবহার দেখা রয়েছে। আসাম, ঝাড়খণ্ড ছাড়াও অনেক এলাকায় মানকচুর পাতার ডাঁটার রস দিয়ে সাপে কাটার চিকিৎসা করা হয়।
মৃণালিনী দেবী আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত রেসিপি মানকচুর জিলাপি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় খাবার। এ ছাড়াও মানকচুর ভর্তা, তরকারি সহ নানান উপাদেয় পদের অভাব নেই আমাদেরও।
নবপত্রিকার অষ্টম পত্রিকা মানকচু। মানকচুর অধিষ্ঠাত্রী দেবী চামুণ্ডা বা চামুণ্ডেশ্বরী। চণ্ড ও মুণ্ড নামক অসুর বধের জন্য সন্ধিক্ষণে তিনি আবির্ভূত হন। সার্বজনীন দুর্গাপূজায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লগ্ন ধরা হয় এই সন্ধি পূজার লগ্নটিকে। মানকচুর গাছকে প্রতীক হিসেবে রেখে এই সময় সেই আদিম দেবী চামুণ্ডার আরাধনা করেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।
চামুণ্ডা মূলত তন্ত্রের দেবী। অষ্টমাতৃকা তথা আদি মাতৃশক্তির প্রত্যেকের আট জন করে সহচরী ছিলেন। যাদের বলা হয় ৬৪ যোগিনী বা ডাকিনী। আবার বৌদ্ধ ধর্মেও ৬৪ যক্ষিণীর কথা উল্লেখ আছে। ডাক বা যোগ শব্দের আক্ষরিক অর্থ প্রজ্ঞা বা আধ্যাত্মিক জ্ঞান। এই ডাকিনীদের একজন হিসেবে চামুণ্ডার আরাধনা করা হতো। প্রতিমার দিক থেকেও অন্য দেবীদের সঙ্গে চামুণ্ডার পার্থক্য স্পষ্ট। অস্থিচর্মসার, ভেতরে ঢুকে যাওয়া পেট, কোটরাগত চোখ— যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুদুত! ভারতের হিমাচল প্রদেশে চামুণ্ডার একটি বিখ্যাত মন্দির রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বড় কালীতলা মন্দিরেও চামুণ্ডার পূজা করা হয়। কথিত আছে, এই মন্দিরে দেবীর সামনে ইংরেজদের তাড়ানোর শপথ নিতেন বিপ্লবীরা। অন্য আরেক মতে, চামুণ্ডাকে সরাসরি আদি মাতৃকা বা সপ্ত মাতৃকার অংশ বলে মনে করা হয়। ভারতের বিন্ধ্য অঞ্চলের অরণ্যচারী আদিবাসীদের মধ্যে অন্যতম প্রধান দেবী হিসেবে পূজিত হন চামুণ্ডা।
বেশ কিছু শিলালিপি থেকে জানা যায়, ১৬ শতাব্দীর আগে আনুষ্ঠানিক ভাবে ডাকিনী বিদ্যা বা শক্তি সাধনা শেখানো হতো ভারতবর্ষে। পরবর্তীকালে ভারতীয় প্রাতিষ্ঠানিক সনাতন ধর্ম থেকে এর বিচ্যুতি ঘটে। চামুণ্ডার আরাধনা হয়তো শাক্ত ও তন্ত্রের শেকড়ের সঙ্গে আধুনিক ধর্মের সেই সন্ধিকেই প্রতিষ্ঠা করে অষ্টমী ও নবমীর মহালগ্নে। আর মানকচু দুর্যোগকালীন শর্করা হয়ে জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রক্ষা করে অনাহারী মানুষের প্রাণ।
লেখক ও গবেষক— নুসরাত জাহান
তথ্যসূত্র: এথনোবোটানিকাল সার্ভে অফ এডিবল এরোয়েড, চিরঞ্জীব বনৌষধি, যোগিনী কাল্ট ইন ওডিশা
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন