বিদ্যাসাগরেরও আগে তিনি বিধবা বিবাহের জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন। তাঁর দেওয়া জমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে কলকাতা মেডিকেল কলেজ। কে তিনি?
আজ শোনাব এমন একজনের কাহিনি যাঁর সম্পর্কে হিন্দু ইন্টেলিজেন্সার লিখেছিল দি মোস্ট ভারচুয়াস বাবু। বলা যায় তিনি ছিলেন ‘রথসচাইল্ড অফ ক্যালকাটা‘। শিবনাথ শাস্ত্রীর মতে তাঁর মতো সত্ ও বিনয়ী ব্যবসায়ী ছিলেন বিরল। তিনি মতিলাল শীল। ১৭৯২ সালে, কলকাতায়, এক সুবর্ণবণিক পরিবারে জন্ম তাঁর। পিতা চৈতন্যচরণ শীল ছিলেন চীনাবাজারে কাপড়ের ব্যবসায়ী। কিন্তু মাত্র পাঁচ বছরে পিতৃহীন হয়ে পড়ায় বেশিদূর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের সুযোগ হয়নি তাঁর। খুব অল্প বয়সেই ইংরেজ কোম্পানির অধীনে সামান্য বেতনের চাকরি দিয়ে জীবন শুরু। সতেরো বছর বয়সে ১৮০৯ সালে বিয়ে হল সুরতী বাগানের মোহন চাঁদ দে-র কন্যা নাগরী দাসীর সঙ্গে। শ্বশুরের পরামর্শে ১৮১৫ সালে ফোর্ট উইলিয়ামে কর্মচারী হয়ে যোগ দেন। পরে গুদাম-সরকার হন। এরপরে ফোর্ট উইলিয়ামের চাকরি ছেড়ে কিছুদিনের জন্য বালিখালের কাস্টমস দারোগার চাকরি করেন। কিন্তু বাণিজ্য তাঁর জন্মগত। তাই ১৮১৯ সালে পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা সামান্য কিছু মূলধন নিয়ে শুরু করলেন ব্যবসা। কীসের? বোতল-ছিপির কারবার। বিয়ার রপ্তানীকারী হাডসন সাহেবকে বোতল ছিপি জোগাতেন মতিলাল। পাশাপাশি সুতির কাপড় আর লোহা আমদানির বিনিময়ে ব্রিটিশদের রপ্তানি করতেন নীল, চিনি, রেশম, চাল, নুন। এইভাবে মতিলাল এদেশীয় ও বিদেশীয় বাণিজ্যিক লেনদেনে একটা যোগসূত্রের কাজ করে অর্থ রোজগার করেছিলেন প্রচুর। তাঁর দক্ষতার কারণে ব্রিটিশরা তাঁকে 'বানিয়ান' পদে নিয়োগ করল। আপন উপার্জিত অর্থে কিনে ফেললেন প্রায় বারো-তেরোটা কার্গো জাহাজ যা পাড়ি দিত সূদুর অস্ট্রেলিয়ার উপকূল পর্যন্ত। শুধু তাইই নয়, তিনিই এদেশে প্রথম স্টিম ইঞ্জিন তৈরি করিয়ে ছিলেন।
মতিলাল শীল শুধু উপার্জনই করেননি, তাঁর খ্যাতির কারণই ছিল অকাতরে দান করার জন্য। ঊনবিংশ শতকের বাংলায় সমাজকল্যাণে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে বেলঘরিয়ায় তৈরি করেছিলেন ভিক্ষাজীবীদের জন্য আশ্রম। দৈনিক পাত পড়ত অন্তত পাঁচশো জনের। এখনও আছে সেই আশ্রম, যেমন আছে হুগলীর গঙ্গাপাড়ে বাবু মতিলাল শীল ঘাট। অন্যদিকে শেয়ার কেনাবেচা, নগদ ও সুদের কারবারও করতেন কিন্তু তা মোটেও সমকালীন সুদখোরদের বাণিজ্যের মতো ছিল না। বরং মতিলালের টাকা ধার দেওয়ার পদ্ধতিটি ছিল অনেকটাই আজকের ব্যাঙ্কিং ও বিমা ব্যবস্থার পূর্বসূরী। ব্যাঙ্ক অফ ইণ্ডিয়ার প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যেও মতিলাল ছিলেন অন্যতম উদ্যোক্তা। মিশনারী-বিমুখ হিন্দু ছাত্রদের শিক্ষিত করে তোলার জন্য স্বনির্ভর উদ্যোগে ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে গড়ে তোলেন বাবু মতিলাল শীল ফ্রি কলেজ। পরে এর সঙ্গে যোগ হয় স্কুল। শিক্ষাদান ও পাঠ্যক্রম কিন্তু ছিল আধুনিক। প্রথমে ফাদার ফ্রান্সিস জেভিয়ারের (আজকের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ) প্রতিষ্ঠান দেখত এর পঠন-পাঠন। কিন্তু নির্দেশ ছিল ধর্মের দিক দিয়ে ছাত্রদের প্রভাবিত করা যাবে না। কাজেই পরে যখন অভিযোগ ওঠে যে জেসুইট পাদ্রীরা সে নিয়ম মানছেন না তখন মতিলাল শীল পরিচালনার দায়িত্ব দেন রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন ব্যানার্জিকে। কলেজের ব্যয় তখনকার দিনে বার্ষিক ১২ হাজার টাকা আসত মতিলাল শীলের ট্রাস্ট থেকে। পড়ুয়া পিছু নেওয়া হত বার্ষিক এক টাকা সাম্মানিক ব্যয়।
বিদ্যাসাগরের আবির্ভাবের পূর্বেই মতিলাল শীল নিজের মতো করে বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের চেষ্টা করেছিলেন। ১৮৩৭ সালে ঘোষণা করেছিলেন প্রথম বিধবা বিবাহকারীকে তিনি বিশ হাজার টাকা পুরস্কার দেবেন। সোচ্চার হয়েছিলেন বাল্যবিবাহ রোধে। ছিলেন সতীদাহ প্রথার ঘোরতর বিরোধী। নারীকল্যাণ ও নারীশিক্ষার সমর্থক ছিলেন প্রবলভাবে। হীরা বুলবুল নামে এক পতিতার পুত্রের হিন্দু কলেজে ভর্তি হওয়াকে কেন্দ্র করে তৎকালীন সমাজে বেশ আলোড়ন উঠেছিল। তখন মতিলাল শীল বউবাজারের রাজা রাজেন্দ্র দত্তের সঙ্গে পরামর্শ করে গড়ে তুললেন হিন্দু মেট্রোপলিটান কলেজ। কতটা ব্যতিক্রমী ও নিজের সময়ের থেকে এগিয়ে থাকলে একজন মানুষ এই দুঃসাহসিক পদক্ষেপ নিতে পারেন!
মতিলাল শীলের কাছে কলকাতাবাসী তথা বাঙালির যে কতখানি ঋণ, তার জ্বলন্ত প্রমাণ কলকাতা মেডিকেল কলেজ। যে জমির ওপর বর্তমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল অবস্থিত, সেই পুরো ভূখণ্ডটাই এবং সঙ্গে এককালীন ১২ হাজার টাকা দান করেছিলেন মতিলাল শীল। পরিবর্তে তাঁর নামাঙ্কিত ওয়ার্ডে দেশীয় লোকজনের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিল ব্রিটিশ সরকার। পরে ফিমেল ওয়ার্ড শুরু করার জন্য আবারও দিয়েছিলেন এক লক্ষ টাকা। কুষ্ঠরোগীদের পৃথক চিকিৎসার জন্য গড়ে তুলেছিলেন ডিস্ট্রিক্ট চ্যারিটেবল ট্রাস্ট।
১৮৫৪ সালের ২০ মে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই বঙ্গসন্তান। কিন্তু শেষ জীবনে নানা প্রকার আইনি ঝামেলায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তবুও তাঁর ভূমিকার কথা শিরোধার্য। তিনি ছিলেন রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের মধ্যবর্তী কালের মানুষ। তৎকালীন সমাজ গঠনে তাঁর ভূমিকা ছিল অনেকটাই। সমাজকল্যাণ থেকে চিকিৎসার উন্নতি, নারীকল্যাণ থেকে শিক্ষাক্ষেত্রে স্বনির্ভর উদ্যোগ - বঙ্গজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছিল মতিশীলের অবদান। আর তাঁর এই অর্থের উৎস ছিল দাপুটে বাণিজ্য। ব্রিটিশ বণিকদের সাথে আপন বুদ্ধির জোরে সমানে সমানে পাল্লা লড়ে এই বাঙালি ব্যবসাকে দিয়েছিলেন সাফল্যের নতুন সংজ্ঞা। তবুও ব্যবসায়ী মতিলাল শীলের থেকে দানবীর মতিলাল শীল সর্বদাই অধিক স্মরণীয় কারণ আজও তাঁর ট্রাস্টের টাকাতেই বেলঘরিয়ার আশ্রম ও মতিলাল শীল ফ্রি কলেজ পরিচালিত হয়।
তথ্যসূত্র -
ক্যালকাটা, দ্য লিভিং সিটি -সুকান্ত চৌধুরী (সংকলিত)
হিস্ট্রি অফ দি বৈশ্যজ অফ বেঙ্গল-প্রমথনাথ মল্লিক
উইকিপিডিয়া
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন