এই ব্লগটি সন্ধান করুন

এই ব্লগটি সন্ধান করুন

এই ব্লগটি সন্ধান করুন

এই ব্লগটি সন্ধান করুন

এই ব্লগটি সন্ধান করুন

এই ব্লগটি সন্ধান করুন

শনিবার, ৩১ আগস্ট, ২০২৪

স্যানোরার সাথে বেড়ে ওঠা ১৯৭১। #গিফট_ইভেন্ট

 স্যানোরার সাথে বেড়ে ওঠা ১৯৭১।

#গিফট_ইভেন্ট


শীতকালটা বড্ড ছোট, ঝপ করে সন্ধ্যা হয়ে যায়। আমরা খেলার মাঠ থেকে  ঘরে ফিরে দেখি   ঝিঁঝিঁ পোকারা ততক্ষনে আসর জমিয়ে বসেছে। সচরাচর বাবাকে আমরা এই সময়ে হাতে বাজারের ব্যাগ আর খবরের কাগজ নিয়ে অফিস থেকে ফিরতে দেখি।  সেদিন হঠাত অফিস ফেরত বাবা হাতে  চৌকোনা এক বাক্স নিয়ে বাসায় ঢুকলেন। বাক্স রহস্য উদ্ধারে উন্মুখ ছেলে মেয়েদের সামনে বাবা আয়েশ করে বসে বাক্স খুললেন। 

হ্যারিকেনের মৃদু আলোর বৃত্তের ভেতরে গোল হয়ে বসা ভাই বোনদের বিস্ফারিত চোখের সামনে চৌকোনা বাক্স থেকে বের হলো মাখন রঙের ঝক ঝকে এক রেডিও। এক ব্যান্ডের রেডিও, নাম স্যানোরা। দাম একশত দশ টাকা। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে যোগ হলো প্রথম বিলাস সামগ্রী, আধুনিকতা। সত্তুরের শুরুর দিকের সেই শীত সন্ধ্যা আমাদের পরিবারে দারুণ উষ্ণতা নিয়ে এসেছিল। 

চান্দা ব্যাটারী ভরে অনেক রাত পর্যন্ত খবর আর গান শোনা হোল। মনে আছে মধ্যরাতে 'পাক শার জামিন' শুনে আমরা ঘুমাতে গিয়েছিলাম। 


অফিস থেকে ফিরে বাবার প্রথম এবং নিয়মিত কাজ  ছিলো রেডিওতে খবর শোনা। এ এক অদ্ভুত নেশা।  খবর শোনার ঐ সময়টায় আমাদের কোন রকম শব্দ করাও নিষেধ ছিল।

এখন মনে হয় বাবার ঐ একাগ্রতা সেই সময়েরই অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। অসহযোগ আন্দোলন, বিদ্রোহ আর মুক্তির জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষার সাথে শঙ্কা আর অনিশ্চয়তা বাবার মতন আরো অনেককেই খবরমুখী করে তুলেছিল। একাত্তরের যুদ্ধের সময় বাবার ঐ সম্পদ আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং মর্যাদাবান হয়ে উঠলো। মিডিয়াম ওয়েভে স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্র খুব ভালো ধরা যেত। আমরা এখান থেকে ওখানে পালিয়ে বেড়াই  সঙ্গে বাবার স্যানোরা। রাতের বেলায় ঘর অন্ধকার করে লেপের তলায়  রেডিও অন করে শোনা হত মুক্তিযুদ্ধের খবর। স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র।  মধ্য দুপুরে আকাশবানী কোলকাতায় নিলীমা সান্যাল 

স্কুলের হেড মিস্ট্রেসের মতন গুরু গম্ভীর গলায় পড়তেন বাংলা খবর, যার প্রায় পুরোটা জুড়ে থাকতো মুক্তিযুদ্ধ। আর সন্ধ্যায় দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায়ের  অসাধারন গলায় সংবাদ পর্যালোচনা । রাতে নিচু  ভলিউমে আপেল মাহমুদের দেশাত্নবোধক গান। আর ছিল চরমপত্র !  এতো কম ভলিউমে  যে রেডিওকে কেন্দ্র করে বাবা আর মামাদের চার পাচটা মাথা বৃত্ত তৈরী করে থাকতো। স্বাধীনতা- বিজয়, সে অন্য কাহিনি। 

১৬ ডিসেম্বর বিকেলে ঐ রেডিও তার দীর্ঘদিনের মিনমিনে গলা ভুলে পূর্ণ শক্তিতে বেজে ওঠে। বিজয় নিশান উড়ছে ঐ... সে এক সময় এসেছিল আমাদের জীবনে।


স্বাধীনতার পরে আমরা ফিরে এলাম পরিত্যক্ত ভাঙ্গাচোরা বাড়িতে। আমাদের সাথে ফিরে এলো স্যানোরাও। বছর খানেকের মধ্যেই কী এক অজানা কারনে বাবা তার অমূল্য সম্পদটি আমাদের দুই ভাইয়ের হাতে তুলে দিলেন। তুলে দিলেন মানে, আমরা একটু আধটু নিজের মতন করে স্টেশন বাছাই করতে পারি আর কী!  শর্ত ছিলো খবরের সময়টুকু  অবশ্যই তাকে দিতে হবে। আমরা তাতেই আনন্দে আত্মহারা। 

'দূর্বা ঘাসে বিচালি, সবার প্রিয় পূবালি' । বিজ্ঞাপন তরঙ্গের প্রায় সবকটা বিজ্ঞাপন মুখস্ত হয়ে গেল এক সপ্তাহের মধ্যে। আব্দুল জব্বার, খুরশিদ আলম, মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকি, সৈয়দ হাদী, আঞ্জুমান আরা, সাবীনা ইয়াসমিন, শাহনাজ রহমতুল্লাহ এদের  আমার তখন নিকটাত্মিয় মনে হতো। 


'৭৪ এর দুর্ভিক্ষ আমাদের হঠাত করেই বয়েসের চেয়ে বড় করে ফেললো।  সূর্য ওঠার আগে  বড়দের সাথে আমরাও 'ন্যায্যমূল্যের' দোকানে লাইন দেই। গুঁড়ো দুধ, টিনের কৌটায় সারডিন মাছ, বড় চারকোনা নোনতা বিস্কুট, কম্বল এসব পাওয়া যেত রিলিফ হিসেবে। পরে এসব কিনতে হতো সরকারী  কম দামের ( ন্যায্য মূল্যের দোকান) দোকান থেকে। সেটাও লাইন দিয়ে। টর্চ আর রেডিওর ব্যাটারীও কেনা হতো লাইন দিয়ে। দীর্ঘ, সর্পিল এবং ধীর গতির লাইনে দাঁড়িয়ে বড়দের খিস্তি খেউর আর পাশের চায়ের দোকানের লাল দোপাট্টা মল মলের মাঝে হঠাত করেই কানে আসে "ওগো নিরুপমা করিও ক্ষমা '। কিশোর কুমার।

কখনো হেমন্ত'র আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুব তারা'। আমাদের অনভ্যস্ত কানে দারুণ লাগে। আমরা তখন আব্দুল জব্বারের তুমি কি দেখেছ কভু' আর বশির আহমেদের  'হরিণ হরিণ নয়ন কেন ছলো ছলো'র মধ্যে পড়ে আছি। অতঃপর  এক সময়  রেডিওর নব ঘুড়িয়ে আমরাই পেয়ে যাই গুপ্তধন। বিবিধ ভারতী, আগরতলা আর কোলকাতার অনুরোধের আসর। মান্না দে, কিশোর কুমার, হৈমন্তী শুক্লা আর হেমন্ত'র গানের বন্যায় ভেসে যাতে থাকি আমরা দুই ভাই। কত সহজেই না বলে ফেলা গেলো কথাগুলো, অথচ এসব গান শোনা  সহজসাধ্য ছিলনা মোটেই। কোলকাতা আর আগরতলার অনুরোধের আসর গুলো হতো ঠিক সন্ধ্যা বেলায়। খেলার মাঠ থেকে ফিরে আমাদের তখন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে স্কুলের পড়া পড়তে হতো। চেঁচিয়ে, কারন পাশের ঘরের বাবাকে জানাতে হবে পড়ছি, ফাঁকি দিচ্ছি না। ওরই মাঝে কখনো অত্যন্ত নিচু ভলিঊমে শোনা হতো একটা বা দুটি গান। আসরের শেষ গানটি হতো সবচেয়ে 'দামী', সবচেয়ে বেশী অনুরোধ পাওয়া। অনেক সময়ই সেটা শোনা হতোনা। আরেকটা অনুষ্ঠান ছিল, পূর্বাঞ্চলীয় শ্রোতাদের অনুরোধের আসর। এটা হতো অনেক রাতে, সাড়ে দশটা এগারোটার দিকে। আমাদের জন্য সেটা ছিল অনেকটা সেহরী খাবার মতন। আমাদের ঘুমানোর বাঁধা সময় ছিল ন'টায়। যেদিন অনুরোধের আসর থাকতো সেদিন রাতে আমাদের পড়াশোনার পাট যেন আর শেষই হতে চাইতোনা। আসলে এটা ছিল জেগে থাকার এক কষ্টসাধ্য কসরত। তবুও কি ভালভাবে গান শোনার উপায় আছে ! বাবা ওপাশ থেকে ধমকাচ্ছেন এখনো কেন ঘুমাচ্ছিনা, রেডিও কেন এখনো অন ইত্যাদি। আমরা দুই ভাই তখন নেশাগ্রস্ত, আমাদের ঠেকায় কে? আমারা দুজন একই বিছানায় ঘুমাই। দুজনের বালিশের মাঝখানে রাখা হয়েছে রেডিও। দু'জনের দুই কান লেগে থাকে রেডিওর  দুই দিকের শরীরে। মিন মিন করে লতিয়ে ওঠে সুর ! লতা, হেমন্ত, অনুপ আমাদের কানে কানে গেয়ে যায় তাদের সেই সব গান। কিন্তু সমস্যা হলো, একেতো সস্তা মিডিয়াম ওয়েভ রেডিও তার উপর নিয়ন্ত্রিত শব্দ( বাবার ভয়ে), আবহাওয়া খারাপ থাকলে আরো করুন অবস্থা! শব্দ ক্ষীণ হতে হতে কোথায় যে হারিয়ে যায়। আবার যখন ফিরে আসে তখন মাঝ খানের লাইনগুলো গাওয়া হয়ে গেছে। হারিয়ে যাওয়া শব্দ আর সুর শুনতে আমাদের কি প্রানান্ত চেষ্টা বাড়ির এমাথা থেকে ওমাথা  লম্বা তার টেনে এরিয়েল বানানো হলো। তখন মনে হতো, আহা! একটা ভালো রেডিও যদি আমাদের থাকতো !


প্রযুক্তির সেরা হোম থিয়েটার এখন আমার বাড়িতে। হিন্দি আর ইংরেজির চাপে আমার বাংলা গানের অবস্থা ক্ষীণতোয়া নদীর মতন হলেও কখনো কখনো বান ডাকে। এখনো হেমন্ত, মান্না, হৈমন্তীর গান বাজে। শব্দের কোন ওঠা নামা নেই। আধুনিক শব্দ প্রযুক্তির গুনে ঘরের প্রতিটি কোনে স্পষ্ট সুরেলা আওয়াজ। কিন্তু প্রান নেই ! মনে হয়  কি যেন একটা নেই, অথচ থাকার কথা ছিল। আগের মতন আর উন্মাতাল করেনা। 

তালপাতার বাঁশীটি আর আগের মতন বাজেনা...


আমার বন্ধু ফখরুল প্রায়ই পুরানো গানের কথা বলে আমার বালকবেলা মনে করিয়ে দেয়। স্মৃতির এই টুকরোটুকু তার জন্য।         

       

গোলাম সারোয়ার খসরু।



কোন মন্তব্য নেই:

সৌন্দর্যের দেবী ক্লিওপেট্রাআত্মহনন করেন, একটি বিষাক্ত সাপ তুলে নিয়েছিলেন হাতে, আর সেই মুহূর্তে সাপ ছোবল মারে তাঁর বুকে।

 সৌন্দর্যের দেবী ক্লিওপেট্রাআত্মহনন করেন, একটি বিষাক্ত সাপ তুলে নিয়েছিলেন হাতে, আর সেই মুহূর্তে সাপ ছোবল মারে তাঁর বুকে। ক্লিওপেট্রা ....মিশ...