আমি বল্লভ। বিক্রমপুরের জমিদারদের উত্তরসূরী ছিলেন আমার বাবা, আমি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। বাবার প্রাণের কবি ছিলেন রবিঠাকুর তাই কতকটা রবিঠাকুরের টানে আর কিছুটা চাকরিসূত্রে বাবা বোলপুরে থাকার সিদ্ধান্ত নেন আর জায়গা কিনে বাড়ি তৈরি শুরু করেন। আমরা সপরিবারে উঠি সেখানে, পরিবার বলতে আমি বাবা আর মা। আমি বোলপুরের স্কুলেই ভর্তি হই এখনকার মতো শহুরে হাওয়া লাগেনি তখন বোলপুরে, আনমনে মেঠো পথ ধরে হেঁটে যেতো বাউল একতারা বাজিয়ে গাইতে গাইতে। আমি শাল মহুয়া সোনাঝুরির জঙ্গলে একা একাই ঘুরে বেড়াতাম পিঠে থাকতো আঁকার সরঞ্জাম, ভালো সিনারি পেলেই আঁকতে শুরু করতাম সেখানে বসে। সন্ধ্যায় হাত পা কেটে বাড়ি ফিরলে মা বকতে বকতে ওষুধ লাগিয়ে দিতো। তারপর সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে যখন পড়তে বসতাম ছমছম করে নূপুর পায়ে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াতো আমাদের বাড়ির রান্নার লোক মালু মাসির মেয়ে কাজল, সাঁওতাল পল্লিতে ওদের ঘর বড় গরীব ওরা তাই রাতের খাবার খেয়ে ওরা মা মেয়ে বাড়ি যেতো। আমার বাবা বলেকয়ে মাস ছয়েকের মধ্যে কাজলকে একটা স্কুল ভর্তি করিয়ে দেয়। কোনো কঠিন অঙ্ক বা পড়া বুঝতে না পারলে কাজল খাতা হাতে আমার কাছে এসে বড় বড় চোখ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতো আমি তখন মাষ্টার মশাইয়ের মতো গম্ভীর হয়ে পড়া বোঝাতাম, ওর চোখে তখন ভয় আর সমীহ। আমার মনে মনে হাসি পেলেও ওকে তা বুঝতে দিতাম না। কাজল আমার চেয়ে বছর তিনেকের ছোট ছিল কিন্তু বেজায় ভক্ত ছিল আমার, কখনো মাছের চার করে দেওয়া কিংবা আমার ঠিক করা আঁকার জায়গা পরিষ্কার করে দেওয়া এমন সাহায্য সে করেই থাকতো। আমি যখন আঁকতাম ও মুগ্ধ হয়ে দেখতো একটা শব্দ অব্দি করতো না, মাঝে মাঝে জলের বোতল নিঃশব্দে এগিয়ে দিয়ে বুঝিয়ে দিতো অনেকক্ষণ জল খাইনি আমার তেষ্টা পেয়েছে। একটু একটু করে কাজল আমার ছায়াসঙ্গী হয়ে উঠলো আমি ওকে পড়াতাম বকতাম কিন্তু কষ্ট পেলে যখন ওর চোখ ভরে জল আসতো সহ্য করতে পারতাম না আমি, দুহাত দিয়ে মুছিয়ে দিতাম ওর চোখের জল। এই ভাবে একটু একটু করে আমরা বড় হতে থাকলাম।
যতো বড় হতে থাকলাম একটু একটু করে কাজলের প্রতি আমার অধিকারবোধ বাড়তে লাগলো, মনে হতে লাগলো ওকে বকার বা আগলে রাখার অধিকার শুধু আমারই আছে। কাজল যে আমাকে নিয়ে সচেতন তা আমিও বুঝতাম সেবার যখন সোনাঝুরির জঙ্গলে পড়ে গিয়ে চোট পেলাম পা কেটে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছিল দেখেছিলাম কাঁদতে কাঁদতে কাজল ওড়না দিয়ে আমার কাটা জায়গা বেঁধে দিচ্ছে তখন অবশ্য এটা ভাবিনি যে কেনো ও কাঁদছে, আমার মতো চঞ্চল ছেলের তখন সে সময় ছিল না। তখন আমার বয়স তেরো একবার কাজলকে একটা ছেলে খারাপ কথা বলেছিল, শান্ত লাজুক কাজল সেসব আমায় না বললেও আমি ওর মুখে কষ্টের ছাপ দেখে আন্দাজ করে নিয়েছিলাম। সেবার প্রচন্ড রাগ হয়েছিল আমার, প্রথমবার আমাকে কারো সাথে মারামারি করতে দেখে অবাক হয়েছিল বটে আমার বাবা মা। এইভাবে আমরা আরও বড় হয়ে গেলাম, আমি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম আমার আঁকা আর লেখাপড়ার জগত নিয়ে। কাজল আমার জন্য ভালো ভালো রান্না করে আনলে এখন চুপচাপ খেয়ে নিই তারিফ করার কথা মনে থাকে না। মাঝে মাঝে দেখি কাজল আমার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে, আমার চোখে চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নেয়। কাজলের উপস্থিতির গুরুত্ব না বুঝলেও অনুপস্থিতিতে বড় অস্থির লাগতো। সেবার শুনলাম কাজলের জ্বর ওর মা কাজে আসেনি তাই, ফল আর ওষুধ নিয়ে নিজে গেছিলাম ওদের বাড়ি। সাঁওতাল পল্লিতে ঢুকতেই দেখলাম পর পর মাটির কুঁড়েঘর মাথায় খড়ের ছাউনি, বাড়িতে বাড়িতে মুরগির ছানা ঘুরছে, একদল লোক মহুয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে মাদল বাজিয়ে গান ধরেছে, খালি গায়ে খালি পায়ে একদল বাচ্চা খেলে বেড়াচ্ছে। মালু মাসি আমাকে আদর যত্ন করে ঘরে নিয়ে গিয়ে খাওয়ালেও, কাজলের অসুস্থ শুকনো মুখটা দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেছিল।
বছর ঘুরলো ডাক্তারিতে চান্স পেলাম, বাবা মায়ের মন খারাপ থাকলেও কলকাতায় কলেজে পড়তে হবে তাই তাদের ছেড়ে যেতেই হতো। বাবা বললেন আমার পড়া শেষ হলে যদি সেরকম হয় মাকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসবেন। বোলপুর ছেড়ে যাওয়ার দিন তিনেক বাকি তখন জঙ্গলের একটা স্কেচ মন দিয়ে আঁকছি শুনলাম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ, তাকিয়ে দেখি কাজল। বললাম কেঁদো না, আমি তো ফিরে আসবো। সেদিন আঁকা বন্ধ করে হয়তো আমি ওর সাথে একটু কথা বলতে পারতাম, ওর মনের কথা শুনতে পারতাম কিন্তু শুনিনি, পরে সেই কথা গুলো শোনার জন্য হাহাকার করে বেড়িয়েছি। বাবার সাথে কলকাতা এলাম হোস্টেল ঠিক করে বাবা ফিরে গেলেন। এখন বাড়ির কথা খুব মনে পড়ে সেই রাঙামাটির গ্রামটাকে মনে পড়ে, বাবা মাকে মনে পড়ে আর স্মৃতিতে ভেসে আসে ওই শ্যামলা সাঁওতাল মেয়ের কালো দীঘল চোখগুলো। আমি বুঝি আমার মন ছটফট করছে কাজলের জন্য এটা কি ভালোবাসা, আচ্ছা কাজল আমাকে নিয়ে কি ভাবে! কতো প্রশ্ন ভিড় করে মনের মধ্যে, আমার আঁকা প্রতিটা নারীর ছবির সাথে যেনো কাজলের মিল পাই, আঁকতে আঁকতে কতো ছবিই কাজলের এঁকে ফেললাম। তাহলে তো আমিও কাজলকে দেখেছি মনের অজান্তেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। মাস ছয়েক লেখাপড়ার ধরন আয়ত্তে আনতেই কেটে গেলো, ঠিক করলাম বাড়ি যাবো। অনেক আশা নিয়ে বাড়ি ফিরলাম ভাবলাম কাজলকে মনের কথা জানাবো, কিন্তু বাড়ি ফিরে শুনলাম মালু মাসি মেয়েকে নিয়ে বোনের বাড়ি গেছে দিন দশেকের ছুটি নিয়ে মন ভেঙে গেল, এতোদিন থাকা সম্ভব ছিল না বাড়িতে।
এরপর আরও মাস ছয়েক কাটলো বাড়ি ফেরার আগে একজোড়া নূপুর নিলাম কাজলের জন্য, ভাবলাম নিজের হাতে পরিয়ে মনের কথা বলবো ওকে। দুপুরে বোলপুরের বাড়ি ফিরে বেরোলাম আঁকার সরঞ্জাম নিয়ে। সেবার পলাশ গুলো গাছে লালে লাল হয়ে ফুটেছিল মাদল বাজিয়ে একদল ছেলেমেয়ে নাচগান করছিল আমি সেটা আঁকার কথা ভেবে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু গিয়ে চমকে উঠলাম ওদের মধ্যে কাজল নাচছে। উঁচু করে পরনে লাল পাড় শাড়ি, মাথায় পলাশ ফূল, হাতে চুড়ি আর কপালে সিঁদুর ওর। সে যে কি ভীষণ যন্ত্রণা চোখ ফেটে জল এলো আমার, কাজল বিয়ে করে নিলো! তবে কি ভালোবাসা একতরফা ছিল! আমি অনেক কষ্টে নিজেকে আটকালাম, মনে হচ্ছিল ওর হাত ধরে টেনে এনে বলি তুমি শুধু আমার, তোমাকে ভালোবাসার অধিকার একমাত্র আমার। বুঝলাম ওর পাশে মাদল বাজিয়ে গান গাওয়া লোকটা ওর বর মাঝে মাঝে হাসতে হাসতে ওকে দেখছে, দেখবেই তো সদ্য বিয়ে হয়েছে মনে হচ্ছে। খুব জানতে ইচ্ছে করছিল লোকটা কি আমার থেকে বেশি কাজলকে ভালোবাসে? আর কিছু জানা হয়নি পরের দিন ফিরে এসেছি কলকাতায় একরাশ কষ্ট বুকে নিয়ে, তারপর আর যাইনি বোলপুর। বাবা মাকে নিয়ে চলে এসেছে কলকাতায় বছর কয়েক পর। পড়া শেষ হয়েছে, ডাক্তার তকমা পেয়েছি। মা বহুবার বলার পরেও বিয়ে করতে ইচ্ছে করেনি, কাউকে ভালোবাসার কথা ভাবিওনি। এই করে বছরের পর বছর গড়াল বয়স বাড়লো, মা মারা গেল বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লো। দিন দিন বড় একা হয়ে পড়লাম আমি, সব থাকার পরেও মনে হতো কিচ্ছু নেই।
বাবার মৃত্যুর পর ফিরলাম বোলপুরের বাড়িতে ওখানেই নিজের চেম্বারে রুগী দেখা শুরু করলাম, গরীব বা আদিবাসী সম্প্রদায়ের জন্য চিকিৎসা করতাম বিনামূল্যে। নিজের পেট চালানো ছাড়া বেশি টাকার দরকার ছিল না। একদিন আমার মালি বললো রান্নার কাজের জন্য একটা সাঁওতাল মেয়ে এসছে। বললাম পাঠাও একমাথা ঘোমটা দিয়ে সে এলো আমার ঘরে। সেই মুখ, সেই চোখ, আমি অস্ফুটে বললাম কাজল! কাজল মৃদু গলার বললো -"মা তো আর বেঁচে নেই, আমাকে কাজে নেবেন?"
তুমি থেকে আপনিটা বড় অদ্ভুত শোনালো।
বললাম -"ছেলে হয়েছে নাকি মেয়ে? কোন ক্লাসে পড়ে?" সে চোখ মুছে বললো -"মা হতে পারিনি আমি সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতাই ছিল না আমার, বিয়ের দুবছরের মাথায় স্বামী মারা গেল সেই থেকে মায়ের ঘরে থাকি।" আমি নিশ্চুপ রইলাম। কাজল রয়ে গেল আমার রান্নার লোক হিসাবে অথচ আমি ওকে ঘরনী বানাতে চেয়েছিলাম।
মাস তিনেক পর একবার প্রচন্ড বর্ষা। আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা তিনদিন ধরে বৃষ্টি হয়েই চলেছে, তার মধ্যে আমি জ্বরে বেঁহুশ। যখন একটু ঠিক হলাম দেখলাম কাজলের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আমি। ক্লান্ত গলায় বললাম -"বাড়ি যাওনি তুমি?"
বললো -"দুদিন লাগলো আপনার ঠিক হতে, আপনাকে এই অবস্থাতে ছেড়ে যাই কি করে!"
বললাম -"একা মেয়ে একটা ছেলের ঘরে রয়ে গেলে, বদনাম হয়ে যাবে তো।"
-"হলে হোক তাও আপনাকে ছেড়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না।"
জিজ্ঞেস করলাম -"কেনো?"
বললো-"যে কারণে আপনি এতোদিন বিয়ে না করে জীবনটা নষ্ট করেছেন সেই কারণে।"
ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম -"বাসতে ভালো আমাকে?"
-"প্রচন্ড।"
-"তাহলে বিয়ে কেনো করলে?"
-"অনেক অপেক্ষা করেছি আপনার জন্য, জোর করে বিয়ে দিল পাশের পল্লির ছেলের সাথে। মুখ ফুটে বলতে পারিনি আপনাকে ভালোবাসি, কোথায় আপনি আর কোথায় আমি!"
কি যে শান্তি পেলাম মনে! শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম -"অনেক ভালোবাসি তোমায়, ঠিক যতোটা ভালোবাসলে অন্য কাউকে ভালোবাসার ইচ্ছে চিরকালের মতো মরে যায়।"
আলমারি থেকে বের করে আনলাম ওর জন্য আনা নূপুর, ওর পায়ে পরিয়ে দিলাম। ও লজ্জা পেয়ে আমার বুকে মুখ গুঁজলো।
অনেক বছর কেটে গেছে আমাদের দাম্পত্য জীবনের, ভীষণ খুশি আছি আমরা। বয়স হয়েছে বলে কাজল নূপুর পরতে চায় না, আর আমি ওর পা থেকে নূপুর খুলতে দিই না। এখন রোজ সকালে আমার রান্নাঘর থেকে শোনা যায় সাঁওতালি গান, বেলায় কাজল গরীব বাচ্চাদের পড়ায় আমাদের কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে। আমি বিনামূল্যে চিকিৎসা করি আর বিকালে হাতে হাত রেখে ঘুরে বেড়াই দুজনে। এখন আঁকতে বসলে যখন কাজল আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, আমি আর আঁকাতে মনোনিবেশ করতে পারি না ওর কপালে চুমু খেয়ে বলি আমার শুধু তোমাকেই চাই যতোদিন পৃথিবীতে আছি।
ছবি : সংগৃহীত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন