ইমপালস সিদ্ধান্ত নেয়া থেকে সাবধান।
বাসায় ওভেন নেই। কেনার টাকাও নেই, উদ্দেশ্য ও নেই। অর্থাৎ ওভেন কেনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিনা। দোকানে ঢু মারলাম ঘুরার উদ্দেশ্যে। শুরুতেই বিক্রেতা বললেন একটা অফার আছে, যদি সময় থাকে তাহলে বলি। কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম কি অফার? এবার উনার বক্তব্য তুলে ধরছি।
এখানে প্রেস্টিজ ব্রান্ডের যেসব ওভেন আছে সেগুলা থেকে আপনার পছন্দের যেটি খুশী একটি কিনলেই পাবেন ১০ টি পুরস্কার ফ্রি। আমি ভাবলাম হয়ত উপহার গুলি হবে টেবিল চামচ, প্লাস্টিক বা মেটাল বক্স ইত্যাদি। অনাগ্রহ নিয়েই জিজ্ঞেস করলাম কি উপহার। উনি দৃঢ় ভাবে বললেন, সময় থাকলে বলি। বললাম বলতে থাকেন। শুরুতেই উনি দেখালেন একটা অটোমেটিক গ্যাসের চুলা এবং সেটার বর্ণনাতে গেলেন। চুলাটা আসলেও সুন্দর। চুলাটার দাম ৩২,৫০০/-। হ্যা। ওভেন কিনলে এই চুলা ফ্রি। এবার আমার ইমপালস ক্লিকিং। ক্যামনে কি। ৩২,৫০০/- টাকা দামের এত সুন্দর চুলা ফ্রি? মাথায় ক্যালকুলেশন শুরু হয়ে গেছে অজান্তে ওভেন কেনার টাকা কোথা থেকে ম্যানেজ করা সম্ভব কিনা।
অত:পর শুরু হল বাকি ৯ টি গিফটের বর্ণনা। এর ভেতর অটোমেটিক স্টোস্ট মেকার, ইলেক্ট্রিক হ্যান্ড মিক্সার, ফুল সেট দামি নন স্টিকি ৫ টা পাত্র, ওয়াটার হিটার কেটলি, আর বাকি গুলা মনে নেই। মনে থাকলেও জিনিস গুলির নাম জানিনা যে লিখব। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ওভেনের ওয়ারেন্টি আছে। উনি কার্ড বের করে বললেন কিসের ওয়ারেন্টি? পাক্কা ২ বছরের গ্যারান্টির। এবার দামের ব্যাপারে আসি। ওভেনের দাম ৩৪,৫০০/- আছে, ৩২,৫০০/- আছে আবার কোনটা ৪৪,৫০০/-। উনি বললেন পরিস্কার করেই বলি এখানে যে দাম দেয়া আছে অনলাইন প্রাইসের থেকে ৫০০ টাকা বেশি। আপনি নিলে আমার লোক সব মাল আপনার বাসায় পৌছে দিবে তারপর টাকা।
যেটা বুঝলাম যে গিফট আইটেমের দাম উনাদের মূল্য অনুযায়ী ওভেনের থেকে অন্তত দেড় গুণ বেশি।
কি যে ভয়ানক একটা ইমপালস যাদের এই বিষয়গুলিতে ধারনা নেই তারা বুঝতে পারবেন। আমি তখন ভাবতেছি ৩৪ হাজারের ওভেনে এত টাকার গিফট! এটা কিভাবে সম্ভব। নিজের ভেতর ইমপালস বুঝতে পারছি। ইচ্ছে হচ্ছে সব কিছুর বিনিময়ে অন্তত এই সুযোগ হাত ছাড়া করা যাবেনা।
তৎক্ষনাৎ ভাবলাম আমি যেটা ভাবছি সেটা ইমপালসিভ। ইমপালস বা ঝোকের বসে কোন সিদ্দান্ত নেয়া ঠিক নয়। এরকম ক্ষেত্রে আমি সাধারণত এক পা পিছিয়ে যাই এবং নিজেকে ভাববার সময় দেই। এর প্রেক্ষিতেই উনাকে বললাম, আচ্ছা একটু পরে পরে ভাবলাম ওভেনের যে দাম তা তো পুরা রেফ্রিজারেটরের সমান। মোবাইলে নেট পাচ্ছিল না বলে বললাম একটু ঘুরে এসে জানাচ্ছি নিব কিনা। উনি বললেন তাহলে হয়ত পাবেন না৷
কেন?
উনি সুন্দরমত ক্যাশ মেমো বের করে দেখালেন আজকের ৪ জন ইতোমধ্যে এই অফার নিয়ে ফেলেছে। প্রতিদিন আমরা মাত্র ৫ জনকে এই অফার দিতে পারি। আপনি ঘুরে আসতে আসতে এই অফার পাবার চান্স কম।
ততক্ষণে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করে একটু পাশে দাঁড়িয়ে নেটওয়ার্ক পেলাম। সার্চ করে দেখলাম প্রেস্টিজ ব্রান্ডের ৩৫ লিটারের ওই ওভেনের দাম ৭,৫০০ টাকা মাত্র। আর গ্যাসের যে চুলা দেখিয়েছে সেটার দাম ৬,০০০ এর আশে পাশে। বাকি সব মিলিয়ে দাম সর্বোচ্চ হতে পারে ১৮-২০ হাজার।
এই যে, যেই জিনিসের কোন চাহিদা আমার ভেতর ছিলনা সেটিকে আমার ভেতর সৃষ্টি করে ইমপালস তৈরি করে ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার এই কৌশলকে ইমপালস মার্কেটিং বলে। তবে বিষয়টাতে অনৈতিকতা নেই। তবে আমাদের দেশে বাণিজ্য মেলায় যেটার সম্মুখীন হয়েছি এটাকে ইমপালস মার্কেটিং বলেনা। এটাকে বলা যায়, প্রতারণা, গলা কাঁটা, পকেট কাটা, ছিনতাই, ডাকাতি ইত্যাদি।
প্রথমবারের মত কনভেনশন সেন্টারের স্থায়ী বাণিজ্য মেলায় গেলাম গতকাল। মেলায় গেলে উদ্দেশ্য থাকে দেশের অর্থনীতির হাল হাকিকত কোন দিকে যাচ্ছে সেটা বুঝা। বরাবর আমার প্রধাণ আকর্ষণ প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। এবার মেলায় গিয়ে আমার মনে হয়েছে
১. এটি হল নিউ মার্কেটের সামনের রাস্তার ফুটপাথের হকারদের মেলা।
২. এই মেলার প্রধান পণ্য হল- মেয়েদের ২০ টাকা ৫০ টাকার অলঙ্কার ১৫০ টাকা বিক্রি। আর ব্লেজারের বাজার। পুরো গুলিস্তান, নিউমার্কেট আর কক্সবাজারের বিচের পাশের বাজার হল আমাদের বাণিজ্য মেলা। তবে এখানে নতুন সংযুক্তি হল ফটকাবাজি।
৩. এখানে বড় কোন কোম্পানির ফুটপ্রিন্ট নেই। এটা যে একটি দেশের প্রেস্টিজিয়াস বিজনেস ব্রান্ডিং, সেই বিবেচনায় এরকম মেলা আসলে না থাকাটাই আমাদের ব্রান্ডিং এর জন্য ভাল হত।
৪. দেশের অর্থনীতি ভয়ংকর চাপে আছে।
৫. গত দু দিন ধরে বলছিলাম আমাদের দেশের বাজার ব্যবস্থার সমস্যার গোড়া নিয়ে কেউ কাজ করেনা। কিন্তু দ্রব্যমূল্য কমানোর অঙ্গিকার করেনি এমন কোন দল নেই। আসলে আমাদের বাজার ব্যবস্থায় একটি ওভেনের দাম নির্ধারণ করবে কত দামে কত উপায়ে আপনাকে ঠকাতে সক্ষম সেটার উপর।
এদেশের পোশাক ব্রান্ড থেকে শুরু করে প্রতিটা পণ্যে দাম নির্ধারনে নির্দিষ্ট কোন নিয়ম কেউ মানেন না। অনেক লেখায় বলেছি, আবারো বলেছি এখানে কস্ট বেইজড প্রাইসিং নেই বললেই চলে। এখানে ধোকা বেইজড প্রাইসিং। এদেশের ভোক্তারা তটস্থ থাকেন আসলে পণ্যের দাম কত সেটা জানতে। কোন ভোক্তা অধিকারের মাধ্যমেও আপনি সেটা জানতে পারবেন না। এদেশে একি পণ্য নিউমার্কেটে বিক্রি হবে ৬০০ টাকায়, চক বাজারে ১২০ টাকায়, ফুটপাথে ২৫০ টাকায়, বসুন্ধরায় ১৮০০ টাকা ফিক্সড প্রাইসে। আপনি বুঝতে পারবেন না পণ্য গুলি আসলেও একি নাকি কোনটা আসল কোনটা নকল। আপনার একটাই আস্থা, টাকা যেহেতু বেশি এটাই আসল।
আমাদের বাজার ব্যবস্থার পুরোটাই ধোয়াসা। এখানে সিন্ডিকেটের উপর দোষ চাপাবে বিক্রেতা নিজেই, ক্রেতাও দোষ চাপাবে, সরকারো চাপাবে। সিন্ডিকেট এমন একটা কমন শব্দ যেটা অনেকটাই বায়বীয়। দোষ চাপালে কারো গায়ে লাগেনা। উলটা সিন্ডিকেটের কেউ আপনার সামনে থাকলে সেও সিন্ডিকেটের উপর দোষ চাপাতে পারে।
এই যে অরাজকতা, এর সুযোগ সকলে নেয়। জনগণের অপশন হল, দেখি ওরে দিয়ে আমাদের এই দুর্দশার কোন উন্নতি হয় কিনা। আসলে এযাবৎকালে কখনো সেটা হয়নি। হবে বলেও আমার মনে হয়না।
শুধু দ্রব্যমূল্য বা সিন্ডিকেট ইস্যু নয়। এদেশে আমরা সাধারণ মানুষ এতটায় অসচেতন যে, অধিকাংশ বিষয়ে এরা সঠিক যুক্তি কোনটা আর কোনটা বেঠিক সেটা বুঝেনা। শুধুই অজানার ভেতর থেকে তর্ক আর চায়ের কাপে চুমুক।
ইদানিং একটা কথা বার বার মনে হয়,
কোনটি সত্য এবং কোনটি মিথ্যা এটা নির্ভর করে আপনার আমার জানার পরিধির উপর।
-wasi mahin
জানুয়ারি ২৫, ২০২৪
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন