এই ব্লগটি সন্ধান করুন

এই ব্লগটি সন্ধান করুন

এই ব্লগটি সন্ধান করুন

এই ব্লগটি সন্ধান করুন

এই ব্লগটি সন্ধান করুন

এই ব্লগটি সন্ধান করুন

বৃহস্পতিবার, ২৭ মার্চ, ২০২৫

অসম্মান :~ সুপ্রিয় ভট্টাচার্য্য      চতুর্থ ও শেষ পর্ব

 অসম্মান :~ সুপ্রিয় ভট্টাচার্য্য

     চতুর্থ ও শেষ পর্ব


আপনার মটকা চা তো ভালোই খেতে এর দাম কত ? অতনুর বাবা সবার কাছ থেকে দাম নিয়ে আমাদের দিকে ঘুরে বললেন ৩০ টাকা করে। হাতে ধরে রাখা মাটির গ্লাসটার দিকে তাকিয়ে বললাম, এই গ্লাসগুলো কি আপনি অর্ডার দিয়ে বানান ? ওপাশের টেবিল দুটো পরিষ্কার করতে করতে অতনুর বাবা বললেন, সাধারণত মৃৎশিল্পীদের কাছে চালু মাপের ভাঁড় আর গ্লাস থাকে, আমার এই গ্লাসগুলো ১০০ এম এল এর বলে স্পেশালি অর্ডার দিতে হয়। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে গ্লাসে আবার চুমুক দিয়ে বললাম, আপনার একা হাতে দোকান সামলাতে অসুবিধা হয় না ? একা সামলাবো কেন গোপাল থাকে তো। সাথে সাথে জিজ্ঞেস করলাম গোপাল কে ? অতনুর বাবা বললেন, গোপাল আমার ছেলের মত ! ওই তো এই দোকান সামলায় !! অতনুর বাবার ছেলের মত কথা শুনে মা চা খাওয়া বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন আমি কিছু বুঝতে না পেরে বললাম, সে কোথায় ? অতনুর বাবা আমাদের দিকে ঘুরে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে বললেন, এখন ও ওর বাড়িতে, ১১ টার সময় ওকে ছেড়ে দিই আবার তিনটের দিকে আমি যখন বাড়ি যাই ও তার আগে এসে পাঁচটা পর্যন্ত একা দোকান সামলায় তারপর আমি আবার পাঁচটা সোয়া পাঁচটায় এসে দু'জনে মিলে রাত দশটা পর্যন্ত দোকান সামলাই।

চায়ের গ্লাসে পরপর দু'বার চুমুক দিয়ে একটু ভেবে বললাম, গোপালকে আপনার ছেলের মত বললেন আপনার নিজের কোন সন্তান নেই ! অতনুর বাবা আমার কথায় বোধহয় অসন্তুষ্ট হলেন তাই তিনি বললেন, আপনি হঠাৎ আমার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে জানতে চাইছেন কেন বলুন তো ? আমি তো আপনাকে চিনি না আগে কখনো দেখেছি বলেও তো মনে হয় না।

কথা ঘুরানোর জন্য তাড়াতাড়ি বললাম, না না ওই যে আপনি বললেন না আপনার ছেলের মত তাই হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে ফেললাম কিছু মনে করবেন না বলে গ্লাসের বাকি চাটা শেষ করে পকেট থেকে ১০০ টাকা বার করে ওনার হাতে দিয়ে মাকে বললাম চলো যাই। মা তখনো আস্তে আস্তে চা খাচ্ছেন,

ভদ্রলোক চেয়ার থেকে উঠে টেবিলের ড্রয়ার টেনে ১০০ টাকার নোটটা সেখানে রেখে ৪০ টাকা হাতে নিয়ে ড্রয়ারটা বন্ধ করে বললেন, আমার ২৭ বছরের একটা ছেলে আছে যে সকাল সন্ধ্যে টিউশনি করে আবার টোটোও চালায় আর গোপালতো বলে বললেন, ও শুনতেও পায় না কথাও বলতে পারেনা বলে আমার হাতে চল্লিশ টাকা ফেরত দিয়ে বললেন, ২০২২ সালের পুজোর আগে ও আমার দোকানে এসেছিল কাজ চাইতে। তখন গোপালের বয়স ১৭-১৮ বছর হয়তো ছিল, ও হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে অনেক কিছু বলার চেষ্টা করছিল কিন্তু আমি ওর সেই বলা কথা কিছুই বুঝতে পারছিলাম না বলে ওকে চলে যেতে বলি। ও তখন ওর পকেট থেকে একটা কাগজ আর পেন বার করে বেশ খানিকটা লিখে আমার হাতে সেটা ধরিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। দোকানে তখন খরিদ্দারের চাপটা কম ছিল বলে কাগজটা চোখের সামনে খুলে দেখি তাতে লেখা ছিল, আমি গোপাল, ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছি তারপর বাবা মারা গিয়েছিলেন বলে আর পড়া হয়নি। আজ দশ দিন ধরে মা খুব অসুস্থ হসপিটালের ডাক্তার দেখিয়েছি হসপিটাল থেকে যে ওষুধ দিয়েছে তাতে মার অসুখ সারছে না, বাজার থেকে যে ওষুধ কিনব তার টাকা নেই বাড়িতে খাবারও কিছু নেই ! আমি যেখানেই কাজ খুঁজতে যাচ্ছি কথা বলতে পারি না আর শুনতে পাই না বলে কেউ কাজ দিচ্ছে না !! আপনিও ফিরিয়ে দিলে মাকে বাঁচাতে পারবো না। কাগজটা সেদিন হাতে নিয়ে গোপালের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হয়েছিল, ২০২০ সালে আমার ছেলে অতনু তার মাকে হারিয়ে পাগলের মত হয়ে গিয়েছিল, অবশ্য তার কারণও ছিল বলে অতনুর বাবা বলতে লাগলেন, আমি বাইরে কাজ করতাম বলে বছরে তিন চারবার বড় জোর বাড়িতে আসতাম, ছেলের প্রকৃত গার্জিয়ান ছিল তার মা। আমাকে সব সময় দেখতো না বা দরকারের সময় পেতো না বলে ছেলের অভিমান ছিল আমার উপর !

সেই সব সময়ের সঙ্গী তার মা হঠাৎ করে করোনাতে মারা যাওয়াতে ছেলে আমার নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে মার ছবির সামনে রাত দিন বসে থাকতো !! ছেলের অবস্থা দেখে আমি বাইরের কাজ ছেড়ে দিয়ে আমার নিঃসন্তান বোনের শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে তাকে যখন বললাম, বিশ্বনাথ মারা যাবার পর (বিশ্বনাথ আমার ভগ্নিপতি) তোকে নিয়ে যেতে এসেছিলাম তখন তুই যেতে চাসনি।

আজ আমার অতনু তার মাকে হারিয়ে দিন দিন ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে, তুইতো ওর পিসিমা, আজ আর আমাকে ফিরিয়ে দিস না, চল বলে বোনের হাত দুটো ধরে বলেছিলাম, অতনু যদি তোর সন্তান হতো তাহলে এই সময় তুই তাকে অবহেলা করতে পারতিস ? সেদিন বোন আর কিছু না বলে কাপড়চোপড় গুছিয়ে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে এসে সব সময় ছেলের পাশে থেকে তার সাথে কথা বলে বলে আস্তে আস্তে সেই ডিপ্রেশন থেকে তাকে বার করে আনতে পেরেছিল শুধুমাত্র উপরওয়ালা সহায় ছিলেন বলেই বলে অতনুর বাবা আবারো বললেন, সেদিন গোপালের মা দশ দিন ধরে অসুস্থ সেটা সত্যি কি মিথ্যে যাচাই না করেই গোপালের লেখা কাগজটা পড়ে ভেবেছিলাম, যার বাবা এমনিতেই নেই তার যদি মা না থাকে তাহলে সন্তানকে সামলাবে কে ! সেদিন হাজার টাকা গোপালের হাতে দিয়ে গোপালের লেখা কাগজটার উল্টো পিঠে লিখে দিয়েছিলাম, আগে বাড়িতে গিয়ে মাকে একটা ভালো ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খাওয়াও তারপর চাল ডাল কিনে খাও, মা সুস্থ হয়ে উঠলে তখন তুমি কাজে এসো।

গোপাল সেদিন টাকাটা নিয়ে কাগজটা পড়ে কপালে ঠেকিয়ে ঝপ করে আমাকে একটা প্রণাম করে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কিসব খানিকটা বলে-টলে চলে গিয়েছিল।

চারদিন পর গোপালের কথা মাথা থেকে টোটালি আউট হয়ে গিয়েছিল, সেদিন সকাল ন'টা সাড়ে নটা হবে ঠিক পুজোর আগে বলে দোকানে চাপও বেশি আমি ব্যস্ততার সঙ্গে দোকানদারি করছি হঠাৎ দেখি গোপাল আমার দোকানের সামনে এসে পকেট থেকে একটা কাগজ বার করে আমার হাতে দিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে রইল। দোকানে তখন খদ্দেররা একটার পর একটা অর্ডার দিচ্ছে আমি তার মধ্যেও কাগজটা খুলে দেখলাম তাতে লেখা ছিল, মা এখন অনেকটা সুস্থ আমি কি আজ থেকে কাজ করতে পারি ? সেদিন আমি হেসে যেই মাথা নেড়েছিলাম গোপাল সঙ্গে সঙ্গে সেদিনই কাজে লেগে গিয়েছিল।

সেই থেকে গোপাল রয়ে গেছে, ও এখন ভোর পাঁচটায় এসে নিজে দোকান খুলে সকালে যারা হাঁটতে বেরোয় কিংবা বাস ট্রেনের প্যাসেঞ্জারদের চা করে খাওয়ায়। আমি বাড়ির বাজার করে টিফিন খেয়ে গোপালের টিফিন নিয়ে দোকানের যা মালপত্র লাগে সেসব নিয়ে দোকানে আসি যখন তখন সাড়ে আটটা নটা বেজে যায়।

গোপাল টিফিন খাওয়ার পর দু'জনে একসঙ্গে এগারোটা পর্যন্ত দোকানদারি করে ওকে ছেড়ে দিই। তিনটের আগে ও এসে দোকান সামলায় আমি বাড়ি চলে যাই আবার পাঁচটার পর দোকানে এসে রাত দশটা পর্যন্ত একসঙ্গে দু'জনে সামলাই। বললাম গোপালকে কত টাকা দেন ?

নিঃসংকোচে অতনুর বাবা যেটা বললেন আমি আর মা শুনে অবাক না হয়ে পারলাম না !

অতনুর বাবা বললেন, দোকানের বেচাকেনার বেশিরভাগটাই গোপাল করে বলে ওকে ১৩ হাজার টাকা করে দেই তবে নগদে ওর হাতে দেই মাসে ১১ হাজার আর দু হাজার করে প্রতিমাসে পোস্ট অফিসে ওর একটা পাঁচ বছরের রেকারিং অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছি সেখানে জমা দেই যাতে পাঁচ বছর পর ওই টাকাটা ওর কাজে লাগে। বললাম গোপালকি এখনো কাগজে লিখে লিখে তার বক্তব্য বলে ? অতনুর বাবা একটু হেসে বললেন, এখন ওর হাত নাড়া আর চোখের ইশারা দেখলেই বুঝতে পারি ও কি বলতে চায়।

অতনুর বাবার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো চুপ করে শুনতে শুনতে মনে হলো, চায়ের দোকানের মালিক কিংবা টোটো চালায় বলে কাউকে অসম্মান করা উচিত না কারণ, আমরা জানিই না সমাজের প্রতি তাদের অবদান কতটা।

এইজন্যেই বোধহয় নন্দিনী বলেছিল, অতনুর বাবার সাথে একবার দেখা করতে।


মা উঠে দাঁড়িয়েছেন দেখে আমিও চেয়ার ছেড়ে উঠে চা খাওয়া মাটির গ্লাস দুটো নিয়ে দোকানের বাইরে রাখা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে সামনের টেবিলে রাখা জলের জগ নিয়ে হাত ধুয়ে মাকে দোকান থেকে যখন হাত ধরে নামাচ্ছি তখন অতনুর বাবা বললেন, চা যদি ভালো লেগে থাকে আবার আসবেন। অতনুর বাবার দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম, এখন চা খেতে আপনার দোকানে প্রায়ই আসতে হবে। অতনুর বাবা কিছু না বুঝে হেসে বললেন, অবশ্যই আসবেন।

যেখানে অতনু আমাদের টোটো থেকে নামিয়ে দিয়েছিল সেই পর্যন্ত হেঁটে আসতে আসতে মা বললেন, অতনুর বাবার কথা শুনে তোর কি মনে হলো ? একটুখানি চুপ করে থেকে বললাম, দু'জনের কথা শোনার পর আমার মনে হয়েছে, বাবা এবং ছেলে দু'জন দু'জনকে খুবই ভালোবাসে কিন্তু সেটা কখনোই একে অন্যের সামনে প্রকাশ করে না ! সম্পর্কটা বোঝা যায় তখন যখন ওরা একে অন্যের ব্যাপারে অন্য কাউকে বলে !! এছাড়াও আমার মনে হয়েছে, দু'জনের মানসিকতাও খুব ভালো তার প্রমাণ, আজ অতনুর বাবার দোকানটা ছিল বলে গোপালের মত একটা ছেলের ভবিষ্যৎ...

মা আমাকে মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে বললেন, সেটাতো ঠিকই কিন্তু বাড়িতে গিয়ে বৌমাকে কি বলবি ? কি আবার বলবো বলে বললাম, বলবো, এর আগে আমি নিজে যেসব ছেলের সম্বন্ধ নিয়ে এসেছিলাম এ ছেলে বা তার পরিবার তাদের থেকে অনেকাংশে ভালো বলে মিনুকে এও বলবো, তুমি তোমার মেয়ের সাথে কথা বলে বুধবারের জায়গায় দিন ১৫ সময় নিয়ে নাও, আমাদের একমাত্র মেয়ের বিয়েটা আমরা অনুষ্ঠান করেই করব আর কাল-পরশুর মধ্যে মেয়েকে বল অতনুর বাবা আর তার পিসিমাকে আসতে বিয়ের ফাইনাল কথা বলার জন্য।

         সমাপ্ত   

  ।সুপ্রিয় ভট্টাচার্য্য।

কোন মন্তব্য নেই:

সৌন্দর্যের দেবী ক্লিওপেট্রাআত্মহনন করেন, একটি বিষাক্ত সাপ তুলে নিয়েছিলেন হাতে, আর সেই মুহূর্তে সাপ ছোবল মারে তাঁর বুকে।

 সৌন্দর্যের দেবী ক্লিওপেট্রাআত্মহনন করেন, একটি বিষাক্ত সাপ তুলে নিয়েছিলেন হাতে, আর সেই মুহূর্তে সাপ ছোবল মারে তাঁর বুকে। ক্লিওপেট্রা ....মিশ...