⚪সদ্যজাত নয়, সদ্যোজাত⚪
‘সদ্য’ মানে সবে, এইমাত্র, ইদানীং; আর ‘জাত’ (উচ্চারণ ‘জাতো’) মানে জনিত, জন্মিত, যে জন্মেছে। তাই এইমাত্র জন্মেছে অর্থে কেউ কেউ লেখেন ‘সদ্যজাত’ (সদ্য+জাত=সদ্যজাত), এইমাত্র মরেছে বুঝাতে লেখেন ‘সদ্যমৃত’ (সদ্য+মৃত=সদ্যমৃত)। ভুল লেখেন। শুদ্ধ শব্দ হল ‘সদ্যোজাত’ ও ‘সদ্যোমৃত’। ও-কার লাগবে। কী কারণে ও-কার লাগবে, এই লেখায় সেটাই আমরা বুঝে নেবার চেষ্টা করব।
‘সদ্য’ শব্দটি আসলে ‘সদ্যঃ’। শেষে বিসর্গ (ঃ) আছে। এটা সংস্কৃত ভাষার শব্দ। অবশ্য বাঙলায় লেখার সময় আমরা বিসর্গ বাদ দিই। কেননা আধুনিক বাঙলা বানানের নিয়ম বলে—শব্দের অন্তে অবস্থিত বিসর্গ বর্জনীয়; যেমন ক্রমশঃ>ক্রমশ, প্রায়শঃ>প্রায়শ, কার্যতঃ>কার্যত, মূলতঃ>মূলত, প্রথমতঃ>প্রথমত, মনঃ>মন, ছন্দঃ>ছন্দ, সদ্যঃ>সদ্য।
দেখা যাচ্ছে, সংস্কৃত ‘সদ্যঃ’ শব্দকে বাঙলায় আমরা ‘সদ্য’ করে নিয়েছি। লিখছি—আবেদনপত্রের সঙ্গে সদ্য তোলা দুই কপি ছবি জমা দিতে হবে। সদ্য প্রয়াত নূরুল ইসলাম ছিলেন একজন কীর্তিমান অর্থনীতিবিদ। কানাডার সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী বাইসাইকেল চালিয়ে বাজার করতে যান।
তা হলে বাঙলা ‘সদ্য’ শব্দকে ‘জাত’ শব্দের সঙ্গে সন্ধি করে ‘সদ্যজাত’ লিখলে কী সমস্যা? সমস্যা হল, ‘জাত’ শব্দটিও তৎসম বা সংস্কৃত। আর সংস্কৃত শব্দের সঙ্গে কেবল সংস্কৃত শব্দেরই সন্ধি হতে পারে, এবং অবশ্যই সংস্কৃত সন্ধির নিয়মে। তাই যখন আমরা সংস্কৃত ‘জাত’ শব্দের সঙ্গে ‘সদ্য’ শব্দকে সন্ধিবদ্ধ করতে যাই, তখন শ্রেণির টানে ফিরে আসে তার মূল রূপ ‘সদ্যঃ’; কেননা ‘সদ্য’ সংস্কৃত না হওয়ায় ‘জাত’ শব্দের সঙ্গে তার সন্ধি হবার নয়। তাই সন্ধি হবে সদ্যঃ+জাত। আর নিয়ম বলে, সন্ধির সময় ‘সদ্যঃ’ শব্দশেষের বিসর্গ (ঃ) ও-কারে রূপান্তরিত হবে। অতএব সদ্যঃ+জাত=সদ্যোজাত।
এই রূপান্তর অস্বাভাবিক বা উদ্ভট কিছু নয়। এটা প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত। আমরা যারা সন্ধির নিয়মটিয়ম বড় একটা খেয়াল করি না, তারাও এতে অভ্যস্ত। মনের ভাব বুঝাতে আমরা লিখি ‘মনোভাব’, মনের যোগ অর্থে ‘মনোযোগ’, মনের রোগ ‘মনোরোগ’, মনের নিবেশ ‘মনোনিবেশ’, মনের বিজ্ঞান ‘মনোবিজ্ঞান’। ও-কার ছাড়া ‘মনযোগ’, ‘মনরোগ’, ‘মনবিজ্ঞান’ ইত্যাদি কেউ লিখি না। কারণ ‘মন’ শব্দটি মূলত ‘মনঃ’, পরের শব্দের সঙ্গে সন্ধির সময় তার বিসর্গ ফিরে এসেছে এবং বদলে গিয়ে ও-কার হয়েছে।
পদের শেষের এই বিসর্গ আদতে র্ ও স্, যা বিসর্গরূপে লিখিত হয় এবং কিছুটা হ-ধ্বনিরূপে উচ্চারিত হয়। অর্থাৎ বিসর্গ হল র্ এবং স্-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। তাই বিসর্গকে দুভাগে ভাগ করা হয়: ১. র্-জাত বিসর্গ, ২. স্-জাত বিসর্গ।
১. র্-জাত বিসর্গ: পদের শেষে র্-এর স্থানে যে বিসর্গ হয় তাকে বলে র্-জাত বিসর্গ। যেমন: অন্তর্=অন্তঃ; প্রাতর্=প্রাতঃ; পুনর্=পুনঃ; নির্=নিঃ; স্বর্=স্বঃ; দুর্=দুঃ।
২. স্-জাত বিসর্গ: পদের শেষে স্-এর স্থানে যে বিসর্গ হয় তাকে বলে স্-জাত বিসর্গ। যেমন: মনস্=মনঃ; পুরস্=পুরঃ; শিরস্=শিরঃ; বয়স্=বয়ঃ; যশস্=যশঃ; আশিস্=আশিঃ; তেজস্=তেজঃ; জ্যোতিস্=জ্যোতিঃ; ধনুস্=ধনুঃ; চক্ষুস্=চক্ষুঃ।
সন্ধির সময় এই দুই প্রকার বিসর্গ কখনো ‘শ্’ হয় (নিঃ+চিহ্ন=নিশ্চিহ্ন), কখনো ‘ষ্’ হয় (চতুঃ+টয়=চতুষ্টয়), কখনো ‘স্’ হয় (নিঃ+তার=নিস্তার), কখনো ‘র্/রেফ’ হয় (নিঃ+অক্ষর=নিরক্ষর, অন্তঃ+গত=অন্তর্গত, কখনো তার পূর্বস্বর দীর্ঘ হয় (নিঃ+রব=নীরব), কখনো কিছুই হয় না (মনঃ+কষ্ট=মনঃকষ্ট), কখনো বিসর্গ গায়েব হয়ে যায় (অতঃ+এব=অতএব) এবং দুটি স্থানে বিসর্গ ও-কার হয়ে যায় (ততঃ+অধিক=ততোধিক, ছন্দঃ+বদ্ধ=ছন্দোবদ্ধ)। আমাদের আলোচ্য শব্দ ‘সদ্যোজাত’, যাতে বিসর্গটি ও-কার হয়েছে। কাজেই এখানে আমরা বিসর্গসন্ধির শুধু সেই দুটি নিয়মই আলোচনা করব, যেখানে বিসর্গটি ও-কার হয়ে যায়।
এক. অ-কার ও বিসর্গের পরে অ-কার এলে সেই অ-কার ও বিসর্গ মিলে ও-কার হয় (অ+ঃ+অ=ও); ও-কার পূর্ববর্ণে যুক্ত হয় এবং পরবর্তী অ-কার লুপ্ত হয়। যেমন—
ততঃ+অধিক=ততোধিক; বয়ঃ+অধিক+বয়োধিক; মনঃ+অভিলাষ=মনোভিলাষ; যশঃ+অভিলাস=যশোভিলাস, যশঃ+অভীপ্সা=যশোভীপ্সা।
দুই. অ-কার ও (স্-জাত) বিসর্গের পরে বর্গের ৩য়, ৪র্থ, ৫ম বর্ণ অথবা য, র, ল, ব, হ-এর কোনো একটি এলে অ-কার ও বিসর্গ মিলে ও-কার হয়; ও-কার পূর্ববর্ণে যুক্ত হয়। যেমন—
মনঃ+গত=মনোগত; মনঃ+গ্রাহী=মনোগ্রাহী; মনঃ+জ=মনোজ; মনঃ+জগৎ=মনোজগৎ; মনঃ+জ্ঞ=মনোজ্ঞ; মনঃ+দুঃখ=মনোদুঃখ; মনঃ+নয়ন=মনোনয়ন; মনঃ+নিবেশ=মনোনিবেশ; মনঃ+নীত=মনোনীত; মনঃ+বল=মনোবল; মনঃ+বাঞ্ছা=মনোবাঞ্ছা; মনঃ+বাসনা=মনোবাসনা; মনঃ+বিকার=মনোবিকার; মনঃ+বিজ্ঞান=মনোবিজ্ঞান; মনঃ+বৃত্তি=মনোবৃত্তি; মনঃ+বেদনা=মনোবেদনা; মনঃ+ভাব=মনোভাব; মনঃ+মতো=মনোমতো; মনঃ+মালিন্য=মনোমালিন্য; মনঃ+যোগ=মনোযোগ; মনঃ+রম=মনোরম; মনঃ+হর=মনোহর; অধঃ+গত=অধোগত; তপঃ+বন=তপোবন; তপঃ+ভঙ্গ=তপোভঙ্গ; তিরঃ+ধান=তিরোধান; তিরঃ+ভূত=তিরোভূত; সদ্যঃ=জাত=সদ্যোজাত; সদ্যঃ+মৃত=সদ্যোমৃত; সদ্যঃ+মুক্ত=সদ্যোমুক্ত; অধঃ+মুখ=অধোমুখ; ছন্দঃ+বদ্ধ=ছন্দোবদ্ধ; পুরঃ+হিত=পুরোহিত; বয়ঃ+বৃদ্ধ=বয়োবৃদ্ধ; সরঃ+জ=সরোজ; নভঃ+মণ্ডল=নভোমণ্ডল; যশঃ+লিপ্সা=যশোলিপ্সা; শিরঃ+রত্ন=শিরোরত্ন। এভাবেই ত্রয়োদশ, ভূয়োদর্শী, শিরোদেশ, যশোগাথা, যশোগান, যশোদা, যশোভাগ, যশোমতী, যশোরশ্মি, যশোরাশি, যশোলাভ, যশোহানি, শিরোধার্য, শিরোমণি, শিরোরুহ, পুরোধা, তেজোদৃপ্ত, শ্রেয়োধর্মী, সর্বতোভাবে, তেজোগর্ভ, তেজোদীপ্ত, তেজোদৃপ্ত, তেজোবান, তেজোময়, তেজোহীন, সরোবর, সরোরুহ, অকুতোভয়, পয়োদ, পয়োধি, পয়োধর, অধোরেখ, অধোগতি, অধোগামী, অধোদৃষ্টি, অধোদেশ, অধোনমিত, অধোবদন, অধোবাস, অধোমুখ, স্বতোবিরুদ্ধ ইত্যাদি।
──────────────
⚪হকের বকবক ॥ #ভাষা, #ব্যাকরণ, #শুদ্ধিপত্র ॥ ১৪-০৪-'২৫।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন