*হোমিওপ্যাথিতে ওষুধ নির্ধারণ কীভাবে করবেন?* - ২য় পর্ব
--------------------------------------------------
লেখক: মার্গারেট লুসি টাইলার
একজন চিকিৎসকের ব্যক্তিগত কষ্ট তাকে অন্যের কষ্ট বুঝতে ও সহানুভূতি দেখাতে সহায়তা করে। বড় কিছু করতে হলে কঠোর পরিশ্রম ও আত্মত্যাগ করতে হয়। হোমিওপ্যাথি অলস বা মনোযোগহীনদের জন্য নয়।
আমাদের হাতে অসংখ্য ওষুধ থাকলেও, সেগুলোকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হলে রেপার্টরি ও লক্ষণ বিশ্লেষণের কৌশল জানতে হয়।
লক্ষণগুলোর গুরুত্ব বোঝা (grading of symptoms) হলো মূল চাবিকাঠি। শুরুতে যে ক্ষেত্রে তিন ঘণ্টা লাগত, অভিজ্ঞ চিকিৎসকের হাতে সেটাই ১০-১৫ মিনিটে হয়ে যায়।
অথবা, যদি চিকিৎসক ওষুধগুলো ভালোভাবে জানেন, এবং অভিজ্ঞতা ও আত্মবিশ্বাস অর্জন করেন, তাহলে হয়ত চোখের এক ঝলকেই তিনি ওষুধ চিনে ফেলেন—এক-দু’টি প্রশ্ন করলেই তা নিশ্চিত হয়। যেমন Sulphur, Calcarea বা Sepia রোগীদের ধরতে ভুল হয় না। এটাই বহু রোগী দেখা সম্ভব করে তোলে।
আমরা “TOTALITY OF SYMPTOMS” কথাটা সহজে বলি, কিন্তু এর মানে কী? এর মানে কি সব ছোট-বড় লক্ষণ এবং প্যাথোলজিক্যাল (রোগতাত্ত্বিক) উপসর্গও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে? এত বিশাল কাজ, অথচ ফলাফল সামান্য।
আপনি আপনার বন্ধুদের হাতের আঙুল গুনে চিনে নেন না। বরং তাদের লিঙ্গ, উচ্চতা, রঙ, কণ্ঠস্বর, অভিব্যক্তি, মন-মানসিকতা দিয়ে চিনেন—অর্থাৎ যেগুলো অন্যদের থেকে আলাদা।
একইভাবে একটি ওষুধের চিত্র গঠিত হয় এর বিশেষ, মানসিক এবং পার্থক্যসূচক লক্ষণ দিয়ে— যে লক্ষণ হাজারো ওষুধে সাধারণভাবে পাওয়া যায়, সেগুলো দিয়ে নয়।
হ্যানিম্যান বলেছেন, “যে লক্ষণগুলো ওষুধ নির্বাচনে মুখ্য ভূমিকা রাখে, সেগুলো সাধারণত সেই ওষুধের জন্যই বিশেষভাবে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এবং রোগের লক্ষণের সঙ্গে তাৎপর্যপূর্ণ সাদৃশ্যপূর্ণ ( mostly peculiar to that remedy, and of marked similitude to those of the disease.)।”
হাজার ওষুধের উপসর্গের একটি বিশাল অংশ সাধারণ এবং তাই কোন ওষুধ নির্ধারণে সহায়ক নয়। আপনি যদি এসব উপসর্গকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেন, তাহলে আপনি যেন ওষুধ নির্বাচন করার জন্য লটারির টিকিট টানছেন।
“প্রতিটি ওষুধের প্রভাব অন্যান্যদের থেকে আলাদা”— বিষয়টি হলো, যে বৈশিষ্ট্যগুলো আলাদা, তা-ই আমাদের প্রধান বিবেচ্য, না যে বৈশিষ্ট্যগুলো একরকম।
হ্যানিম্যান অস্পষ্ট উপসর্গ যেমন, ক্ষুধামন্দা, ঘুমের অভাব, দুর্বলতা ইত্যাদিকে "প্রায় সব ওষুধ এবং প্রায় সব রোগে সাধারণ" বলে অকেজো হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
তিনি আরও বলেন: "রোগের উপসর্গগুলোকে পরীক্ষিত ওষুধগুলোর উপসর্গের সঙ্গে তুলনা করার সময়, কেসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ (characteristic) দিকগুলোকে বিশেষভাবে খেয়াল করতে হবে, যেগুলোর সঙ্গে ওষুধের উপসর্গগুলো সবচেয়ে বেশি মিল রয়েছে— ওষুধটিই তখন নিরাময়কারী হবে।”
আবারও তিনি বলেন: “রোগীর মানসিক অবস্থা ও মেজাজ ওষুধ নির্বাচনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের একটি।” এবং তিনি “বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উপসর্গগুলোর সমষ্টি”-র কথাও বলেন। আমরা যেন বুঝি যে “TOTALITY” বলতে বোঝানো হয়েছে “CHARACTERISTIC TOTALITY”— শুধু উপসর্গ গণনা করলেই হবে না।
কেন্ট ছিলেন একজন যিনি হ্যানিম্যানের কাছে ফিরে গিয়েছিলেন এবং বিশাল কাজ করেছিলেন। ১৯১২ সালে কেন্ট আমাকে যা লিখেছিলেন, তা হলো:
“আপনার পদ্ধতিগুলো কঠিন ও শ্রমসাধ্য, এবং আমার পদ্ধতি থেকে অনেকটাই ভিন্ন। আপনি আপনার কেসগুলিতে আমার চেয়ে অনেক বেশি কাজ করেন। একটি উপসর্গ তালিকা দেখে প্রথমেই খুঁজে বের করুন ৩, ৪, ৫ বা ৬টি উপসর্গ যা ‘অদ্ভুত, বিরল ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।’ এগুলিই হলো সর্বোচ্চ স্তরের সাধারণ (general) উপসর্গ, কারণ এই ‘অদ্ভুত, বিরল ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ’ উপসর্গগুলো রোগীর নিজস্ব বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরে।
যখন এসব উপসর্গ বিশিষ্ট ৩-৪টি বা ৬টি ওষুধের নাম আপনার কাছে আসে, তখন দেখুন এদের মধ্যে কোনটি বাকি উপসর্গগুলোর সাথে সবচেয়ে বেশি সাযুজ্যপূর্ণ— সাধারণ এবং পার্টিকুলার উভয়ের ক্ষেত্রেই।
কেস নেওয়ার পর আপনাকে নির্ধারণ করতে হবে কোন উপসর্গগুলো সেই রোগীর ক্ষেত্রে ফেলা যাবে না— মানে বাদ দেওয়া যাবে না।
যে ওষুধে সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তার সব ছোটখাটো উপসর্গ থাকা জরুরি নয়। যদি সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো ওষুধে থাকে, তবে সব ছোট উপসর্গ খোঁজার পেছনে সময় নষ্ট করার দরকার নেই।
অদ্ভুত, শক্তিশালী, বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উপসর্গগুলো ধরুন— তারপর নিশ্চিত হন যে কেসে এমন কোনো সাধারণ উপসর্গ নেই যা সেই ওষুধের বিপরীত বা বিরোধী।
উদাহরণ:
যদি আপনি আর্সেনিকামের কী-নোট দেখেন, দেখুন রোগী ঠান্ডা-প্রবণ, ভীতু, অস্থির, দুর্বল, ফ্যাকাসে, এবং দেয়ালের ছবি টানটান করে ঝুলিয়ে রাখতে হবে— তাহলে আর্সেনিকাম সঠিক ওষুধ হবে।
অথবা যদি লক্ষণগুলো পালসেটিলার মতো মনে হয়, তাহলে নিশ্চিত হোন যে সে ঠান্ডা-প্রবণ নয়, জানালা খোলা পছন্দ করে, ঠান্ডা হাওয়া ভালো লাগে, হাঁটাহাঁটি ভালো লাগে, তৃষ্ণাহীন, কাঁদে, কোমল স্বভাব— তাহলেই পালসেটিলা কাজ করবে।
কী-নোট-এর সমস্যা হলো এগুলো অনেক সময় অতিরিক্ত ব্যবহার করা হয়। যদিও কী-নোট অনেক সময় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উপসর্গ, তবে যদি শুধুমাত্র এগুলোর উপর ভিত্তি করে ওষুধ নির্বাচন করা হয় আর সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো তার সঙ্গে না মেলে, তাহলে ফলাফল ব্যর্থতাই হবে।
ওষুধ খোঁজার অন্যতম উপায় হলো বিস্তারিত রেপার্টরি ব্যবহার করা, যা বেশিরভাগ কেসেই ভালো ফল দেয়। মানসিক ও সাধারণ/সার্বদৈহিক উপসর্গগুলোকে গুরুত্বের ভিত্তিতে বিবেচনা করে আপনি উপযুক্ত ওষুধে পৌঁছাতে পারেন, যদি -
(a) ওষুধটি ভালোভাবে পরীক্ষিত হয়;
(b) ওষুধটি রেপার্টরিতে ভালোভাবে উপস্থাপিত হয়।
এই শর্তগুলো বহু ওষুধের ক্ষেত্রে সত্য, কিন্তু সংখ্যায় সীমিত।
এটি কঠিন কাজ, কিন্তু অভিজ্ঞতা বাড়লে ধীরে ধীরে সহজ হয়। এর জন্য সাহস ও পরিশ্রম প্রয়োজন।
কিন্তু যদি আপনি অতিরিক্ত সহজভাবে উপসর্গ গ্রহণ করেন, তাহলে আপনি বারবার সেইসব ওষুধেই ফিরে যাবেন যেগুলো ভালোভাবে প্রমাণিত, এবং রেপার্টরিতে ভালভাবে স্থান পেয়েছে— অর্থাৎ "পলিক্রেস্ট"-গুলো।
তাহলে কী হবে সেই গুরুত্বপূর্ণ ওষুধগুলোর, যেগুলো হয়তো অর্ধেক প্রমাণিত, এবং রেপার্টরিতে ঠিকভাবে নেই? এদের মধ্যে কোন একটি হয়তো আপনি ছয় বছরে একবারই ব্যবহার করবেন, কিন্তু তখন সেইটিই একমাত্র পন্থা হবে।
কিছু ওষুধের তথ্য পাওয়া গেছে দুর্ঘটনাজনিত বিষক্রিয়া থেকে। আবার কিছু এসেছে সাপের কামড় বা পোকামাকড়ের দংশন থেকে।
এদের মধ্যে কিছু একটিমাত্র রুব্রিকে থাকে— কিন্তু থাকে কালো হরফে (অর্থাৎ ফার্স্ট গ্রেডে)।
যদি কোনো কালো হরফে থাকা, বিরল ওষুধের উপসর্গ রোগীর উপসর্গের সাথে মিলে যায়, তবে সরাসরি ম্যাটেরিয়া মেডিকায় যান এবং দেখুন পুরো কেসের সাথে ওষুধটি কতটা মিলে যায়। এভাবে শিখে নেওয়া ওষুধ কখনো ভুলবেন না। এটা যেন কষ্টের বিরুদ্ধে আপনার ঝুলিতে আরও একটি তীর।
একটি উদাহরণ:
একজন বিষণ্ন রোগী, যার মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ভয় ছিল। পালসেটিলা ও ইগনেশিয়া কিছুটা মিললেও সে ধীরে ধীরে খারাপ হচ্ছিল। হাসত না, একাকী থাকত, কিছুতেই আগ্রহ ছিল না, খেত না, ঘুমাত না, রং ও ওজন হারাচ্ছিল, সব চিন্তা একটাই— "আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি"।
ম্যানসিনেলা (Mancinella) ওষুধটি পুরো কেসের সাথে মিলে গেল এবং রোগী দ্রুত সেরে গেল। রেপার্টরিতে ম্যানসিনেলা হয়তো মাত্র দুই জায়গায় আছে, কিন্তু সেখানে তার একটাই বড় উপসর্গ কালো হরফে: পাগল হয়ে যাওয়ার ভয়।
মাত্র দুই-তিনটি ডোজ, তাও দীর্ঘ বিরতিতে, মাঝে মাঝে হালকা রিল্যাপ্স হলে দেওয়া হয়— এবং তাও চলে যায়। এরপর সে ১২ বছর ধরে পুরোপুরি সুস্থ।
আরেকটি উদাহরণ: Latrodectus mactans — এনজাইনা পেক্টরিসের জন্য। রেপার্টরিতে এর একটি রুব্রিকে কালো হরফে লেখা আছে: “হৃদয়ের ব্যথা, যা বাম হাতে ছড়িয়ে পড়ে”— এখান থেকেই আপনি ম্যাটেরিয়া মেডিকায় যান এবং এটার ভয়ানক উপসর্গের নিখুঁত চিত্র দেখতে পাবেন— এবং এটা কাজ করে।
অনেক ওষুধ আপনি শুধু পড়াশোনার মাধ্যমে জানবেন। এক প্রবীণ চিকিৎসকের নিয়ম ছিল: “প্রতিদিন একটি ওষুধ পড়ো, আর রবিবারে (ছুটির দিনে)দুটো।”
কিন্তু পড়ার সময় চিহ্নিত করুন বা আন্ডারলাইন করুন সেই শক্তিশালী, বিরল ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উপসর্গগুলো। পরে শুধু চিহ্নিত অংশগুলো দেখলেই পুরো ওষুধের ছবি মনে পড়বে।
যে কোনো ওষুধ পড়ার সময় লক্ষ্য করুন:
এর স্থানীয় (LOCAL) প্রভাব।
যেসব টিস্যু ও অঙ্গ এটি বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। (Dr. Burnette, Rademacher-কে অনুসরণ করে, অঙ্গ-ভিত্তিক ওষুধ অনেক ব্যবহার করতেন, ঠিক যেমন পলিক্রেস্টগুলোও করতেন।)
সেই ওষুধের মানসিক ও শারীরিক বিশেষ অনুভূতিগুলো। ক্লার্কের ডিকশনারিতে প্রতিটি ওষুধের আগে যেসব মন্তব্য আছে, সেগুলোতে এসব বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
Nash's Leaders, Allen's Keynotes, Boger's Synopsis — এই বইগুলো সবই ওষুধের বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে এবং অত্যন্ত সহায়ক।
যদি আপনার কাছে ’অ্যালেনের সাইক্লোপিডিয়া’ থাকে, তাহলে শুধু কালো হরফের উপসর্গগুলো এবং ইটালিকগুলো দেখেই অনেক ভালো ও উপকারী পড়াশোনা করা যায়। এমনকি সাধারণ হরফেও মাঝে মাঝে এমন উপসর্গ পাবেন যা বিরল; সেগুলো আন্ডারলাইন করে রাখুন।
যেসব কেসে একটি শক্তিশালী মানসিক উপসর্গ স্পষ্ট এবং গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়, আপনি তা দিয়েই অন্য উপসর্গগুলো বাছাইয়ের কাজ সহজ করতে পারেন। রেপার্টরির অন্য রুব্রিকগুলোতে খুঁজুন শুধু সেই ওষুধগুলো যেগুলোর সাথে এই মানসিক উপসর্গ মেলে।
আর যেসব কেসে আপনাকে মানসিক উপসর্গ থেকে শুরু করে জেনারেল সবকিছু গুরুত্ব অনুসারে বিশ্লেষণ করতে হয়, তখন এইভাবে সময় বাঁচানো যায়:
রোগীর সাধারণ উপসর্গ (তাপমাত্রা, আবহাওয়া, খাবার, পরিবেশ ইত্যাদির প্রতি প্রতিক্রিয়া) যদি খুব দৃঢ়ভাবে প্রকাশ পায়, তবে সেগুলো ব্যবহারযোগ্য। তখন সেগুলো রেপার্টরির কালো হরফ বা ইটালিকে রয়েছে এমন ওষুধগুলোর মধ্যেই দেখতে চেষ্টা করুন।
এবং এমনকি বড় রুব্রিকের ক্ষেত্রেও, শুধুমাত্র কালো হরফ ও ইটালিকের ওষুধগুলো (black type and italics) লিখে রাখাই যথেষ্ট।
(চলবে.....)
Source: Different ways of Finding a Remedy
by Margaret Lucy Tyler
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন