🌍 তক্ষশীলা: হারিয়ে যাওয়া এক শহর ও বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা।
তক্ষশিলা ছিল বর্তমান পাকিস্তানের ইসলামাবাদ থেকে ৩২ কিমি দূরে অবস্থিত। পৌরাণিক কাহিনী মতে, দশরথের পৌত্র এবং ভরত গান্ধার জয় করে নিজের পুত্র তক্ষের নামানুসারে তক্ষশীলা নগর স্থাপন করেন। মহাভারত মতে, এই স্থান তখন গান্ধারের অন্তর্গত ছিল। অনেকের মতে এ স্থানে তক্ষ নামক এক জাতি বাস করতো। এই জাতির 114 এই স্থানের নাম হয়েছিল তক্ষখণ্ড। কালক্রমে নামটি তক্ষশীলা নামে পরিচিত হয়।
পারস্য সম্রাট কাইরাসের ৩য় উত্তরসূরী সম্রাট ১ম দারায়ুস এবং পরে জারেক্সিস এই অঞ্চলে আধিপত্য বজায় রাখেন। এ সময় এই অঞ্চলের অন্যান্য এলাকার সাথে তক্ষশিলাও পারস্য অধিকারে ছিল।
খ্রি.পূ ৩২৬ অব্দে আলেকজান্ডার সিন্ধু পার হয়ে তক্ষশিলায় প্রবেশ করেন। এ সময় তক্ষশিলার রাজা অম্ভি তার কাছে বশ্যতা স্বীকার করেন। আলেকজান্ডার তক্ষশিলা থেকে আরও পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে ঝিলম নদী পার হয়ে পুরুর রাজ্য আক্রমণ করেছিলেন। ৪০৫ অব্দের দিকে চৈনিক পরিব্রাজক ফা-হিয়েন তক্ষশীলা পরিদর্শন করে এই স্থানকে পবিত্র এলাকা হিসাবে উল্লেখ করেন।
চন্দ্রগুপ্তের গুরু ও অর্থনীতিবিদ কৌটিল্যের পৃষ্ঠপোষকতায় তক্ষশিলায় রাজত্বের পত্তন করেন চন্দ্রগুপ্ত। চন্দ্রগুপ্ত তাঁর পুত্র বিন্দুসারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর তক্ষশীলাবাসী রাজশক্তির অত্যাচরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। বিন্দুসার কঠোরভাবে বিদ্রোহ দমন করেন। খ্রি.পূ. ২৭৩ অব্দের দিকে বিন্দুসার পুত্র অশোক রাজত্ব লাভ করলে তক্ষশিলা বৌদ্ধ সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। অশোক পাটালিপুত্র থেকে তক্ষশিলার ভিতরে ১৬০০ কিমি রাস্তা তৈরি করেন।
তক্ষশিলাকে বিশ্বের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের একটি বিবেচনা করা হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণত ছাত্র ভর্তি হতো ১৬ বৎসর বয়সে। ১৮ বছর থেকে শেখানো হতো শিল্পকলা, তীর নিক্ষেপ, শিকার, আইন, চিকিৎসা এবং সমরবিদ্যা। উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রগুলো ছিল বেদ, ভাষা, ব্যাকরণ, দর্শন, চিকিৎসাশাস্ত্র, ধনুর্বিদ্যা, রাজনীতি, যুদ্ধবিদ্যা, জ্যোতিঃশাস্ত্র, হিসাব বিজ্ঞান, গণিত, অর্থনীতি, সঙ্গীত ও হস্তশিল্প।
প্রায় ১০ হাজারের উপর ছাত্র-শিক্ষক ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্রদের কাছ থেকে শিক্ষা এবং থাকা-খাওয়ার জন্য অর্থ নিতো বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু শিক্ষক ও বিশ্বদ্যালয়ের অন্যান্য খরচ আসতো রাজকোষ ও ছাত্রদের কাছ থেকে। দরিদ্র ছাত্ররা তক্ষশীলায় নানা রকম কাজ করে পড়াশুনার খরচ মেটাতো। এখানে নারী শিক্ষার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
চাণক্য প্রকৃতপক্ষে প্রাচীন তক্ষশীলা বিহারের অর্থনীতি ও রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অধ্যক্ষ ছিলেন। এই বিজ্ঞ ও প্রতিভাধর ব্রাহ্মণের জন্ম সেকালের তক্ষশীলার 'চানকা' গ্রামে খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে , যা থেকে তার অপর নাম 'চানক্য এর উদ্ভব । বিষ্ণু গুপ্ত ও কৌটিল্য নামেও পরিচিত ছিলেন তিনি।
আরেক মহামানব গৌতম বুদ্ধের চিকিৎসক, নাম জীবক কোমার ভচ্চ। বুদ্ধকে কয়েকবার তিনি দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে সারিয়ে তোলেন। চিকিৎসাবিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জনের জন্য জীবক সেই সময়ের আয়ুর্বেদ শিক্ষার পীঠস্থান তক্ষশিলায় যান। সেখানে তিনি ছিলেন ৭ বছর।
বিখ্যাত চিকিৎসক চরক তক্ষশীলার বিস্ময়কর অবদান। যোগসাধনা চর্চার জন্য তাকে চরক মুনিও ডাকে। তিনি বিখ্যাত চিকিৎসা শাস্ত্র “চরক সংহিতা” রচনা করেন। আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় এই বই এনে দিয়েছে বিপ্লব। প্রাচীন ভারতের চিকিৎসা শাস্ত্রে প্রথম প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসাবে বিবেচিত হয় “চরক সংহিতা”।
প্রাচীন যুগের গান্ধার প্রদেশেরৎ তক্ষশিলার অধ্যাপকরা ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। খ্যাতনামা চিকিৎসক আত্রেয় এখানেই চিকিৎসাশাস্ত্রের অধ্যাপনা করতেন। ঐতিহাসিকরা আত্রেয়কে আয়ুর্বেদ চিকিৎসার পথিকৃৎ বলে থাকেন।
প্রখ্যাত সংস্কৃত ব্যাকরণ রচয়িতা পাণিনি। তিনি তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। পানিনি সম্পর্কে বলতে গেলে বলা যায়, সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণবিদ এই বিদ্যান ।
তক্ষশিলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে গেছে সাম্রাজ্যবাদী পারস্য, গ্রীক, রোমান, শক, কুষান, আক্রমণ। এসব আক্রমনে সৃষ্ট অস্থির রাজনৈতিক আগ্রাসনের সর্বশেষটি (৪৫০ খ্রি.) আসে হুনদের পক্ষ থেকে। এরপরই থেমে যায় তক্ষশিলার পথচলা।
সৌজন্যে: ঋষণা রূপকথা
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন