ধ্রুবতারা ধ্রুব নয় - তা নিজেও পরিবর্তিত হয়
ধ্রুবতারা - নামটি শুনলেই উত্তর দিগন্তের খুব স্বপ্লোজ্জ্বল মিটিমিটি করে জ্বলতে থাকা একটি তারার কথা মনে হয়। সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই এ তারাটি খুব বিখ্যাত, পরিচিত। কারণ, রাতের আকাশে অন্য সকল তারাদেরকে আমরা স্হান পরিবর্তন করতে দেখলেও, এটিই একমাত্র তারা যাকে খালি চোখে স্হান পরিবর্তন করতে দেখা যায় না। তাই, রাতের অন্ধকার, গহীন জঙ্গল কিংবা অন্ধকার গভীর মহাসাগরে নাবিকরা এ ধ্রুবতারাকে লক্ষ্য করে দিক চিহ্নিত করে যাত্রা করতেন। যুগের পর যুগ কিংবা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ধ্রুবতারাকে অপরিবর্তিত দেখালেও কালের পরিক্রমায় ধ্রুবতারারও স্হান পরিবর্তিত হয়। শুধু তাই না, ধ্রুবতারারুপে যে তারা দেখি সেখানে অন্য তারাও চলে আসে! কিভাবে, তা জানার আগে প্রথমে কিছু বিষয় সম্পর্কে দেখি।
ধ্রুবতারার পরিচয়
রাতের আকাশে অন্য সকল তারার মতোই ধ্রুবতারাও একটি সাধারণ তারা ই। এর ইংরেজী নাম Polaris এবং এটি উরসা মাইনর নক্ষত্রমন্ডলের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা বিধায় সে হিসেবে এর নাম আলফা উরসা মাইনোরিস। এর বাংলা নাম ধ্রুবতারা দেবার কারণ হলো, এর অপরিবর্তনীয় ধ্রুব অবস্হান। পৃথিবী থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৪৪০ আলোকবর্ষ। এটি আকারে ও ভরে প্রায় আমাদের সূর্যের মতোই। তবে এর পৃষ্ঠ তাপমাত্রা সে তুলনায় খানিকটা বেশি। তাই মোটের উপর এর উজ্জ্বলতা সূর্যাপেক্ষা খানিকটা বেশি।
ধ্রুবতারা কেন ধ্রুব? কেন একে সর্বদা একই স্হানে দেখা যায়?
আমরা আকাশের সকল তারাকেই পূর্ব আকাশে উদীত হয়ে পশ্চিম আকাশে অস্ত যেতে দেখি কেন? কারণ, পৃথিবী তার নিজ অক্ষে ক্রমাগত পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ঘুরছে। একই সাথে পৃথিবীপৃষ্ঠ গোলাকার হওয়ায় আমরা বিষুবীয় অঞ্চল থেকে যেসব তারাদের খাঁড়া মাথার উপর দিয়ে অতিক্রম করতে দেখি, যদি উত্তর মেরুর দিকে অগ্রসর হতে থাকি, তবে সেসব তারাদেরাে ক্রমেই দক্ষিণ দিকে হেলে আকাশ অতিক্রম করতে দেখবো। একইভাবে, যদি দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হই, তবে তাদেরকে উত্তর আকাশে হেলে অতিক্রম করতে দেখবো। এখন, যদি আমরা বিষুবী অঞ্চল হতে ক্রমেই উত্তর দিকে যেতে থাকি এবং একেবারে পৃথিবীর ঘূর্ণন অক্ষের উত্তর মেরুবিন্দুতে পৌঁছে যাই, তবে দেখবে ধ্রুবতারা ঠিক আমাদের মাথার উপরে এবং তার চারপাশে তাকে কেন্দ্র করেই সকল তারারা যেন ঘুরছে।
এর অর্থ হচ্ছে, পৃথিবী নিজ অক্ষে ঘুরার কারণে তার ঘূর্ণন অক্ষ মহাশূণ্যের দিকে ঠিক সে বরাবর মুখ করে রয়েছে, যে বরাবর পোলারিস অবস্থিত। অন্যকথায়, আমাদের স্বাপেক্ষে ধ্রুবতারার অবস্হান মহাশূণ্যে এমন জায়গায়, পৃথিবীর ঘূর্ণন অক্ষের উত্তর মেরু যেন ঠিক সে বরাবরই মুখ করে রয়েছে। তাই, আমাদের চোখে ইল্যুশন আকারে ধ্রুবতারাকে অপরিবর্তনীয় অবস্হায় অবস্থান করতে দেখায় এবং এ কারণেই এর বাংলা নাম ধ্রুবতারা।
ধ্রুবতারা কি আকাশে সত্যিই স্হির?
উত্তর হচ্ছে, না। ধ্রুবতারাকে একটি বৃত্তাকার পথে ঘুরতে দেখায়। কিন্তু তা খুবই খুবই ক্ষুদ্র পথে। পৃথিবীর ঘূর্ণন অক্ষের উত্তর মেরু বিন্দু মহাশূণ্যের দিকে ঠিক যে রেখা বা, বিন্দু বরাবর অবস্থিত, ধ্রুবতারা সে বিন্দু হতে প্রায় ০.৭° দূরে অবস্থিত। উদাহরণস্বরূপ, আমরা রাতের আকাশে চাঁদকে যে গোলাকার চাকতির আকারে দেখি, তার ব্যাস প্রায় ০.৫°। অর্থ্যাৎ, যদি আমরা ধরি, দৃশ্যমান চাঁদের ব্যাসের এক প্রান্ত বরাবর পৃথিবীর ঘূর্ণন অক্ষের উত্তর মেরুরেখা অবস্হিত, তবে ধ্রুবতারার অবস্হান হবে চাঁদের ব্যাসের অপর প্রান্ত থেকেও খানিকটা দূরে। প্রতিদিন তাই পৃথিবী নিজ অক্ষে ঘুরার কারণে ধ্রুবতারাও আকাশে একটি বৃত্তাকার পথে আবর্তন করে। তবে খালি চোখে এটি বোঝা যায় না। কারণ, এ পথ খুবই ক্ষুদ্র। তবে স্টার ট্রেইল ফটোগ্রাফির মাধ্যমে বোঝা যায়।
কিন্তু মজার বিষয় হলো, ধ্রুবতারার নিজের অবস্হানও ধ্রুব নয়! প্রায় ২৭,০০০ বছর পর পর তার স্হান পরিবর্তিত হয়। অর্থ্যাৎ, প্রতি ২৭,০০০ বছর পর পর ধ্রুবতারা নামে আমরা যে তারা দেখি, সেখানেই অন্য তারাকে ধ্রুবতারারুপে দেখা যায়। কিভাবে ও কেন তা ঘটে, সে সম্পর্কে পরবর্তী পোষ্টে আলোচনা করা হবে।
বিষয়টি আমার প্রকাশিত জ্যোতির্বিজ্ঞানে হাতেখড়ি বই থেকে নেয়া।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন