এর আগে জাপানিজদের সম্পর্কে কোথাও লিখেছিলাম যে, এরা যা করে অনেক ডেডিকেশন ও নিষ্ঠার সাথে করে। ধরেন যিনি একটা মাটির পট বানাচ্ছে সে খুব ধীরস্থির ভাবে পার্ফেক্ট করে বানাতে চেষ্টা করে, যিনি সুশি মেইকার তিনি হয়তো বিশ বছর ধরে কেবল নিখুঁত ভাবে সুশিই বানাচ্ছেন, যে মেয়েটা মাঙ্গা কার্টুন আঁকে সে অনেক সময় ধরে খুব ডিটেইলিং মাথায় রেখে পেইজ বাই পেইজ কমপ্লিট করে।
ওয়াগু বিফের ব্যাপারে এমন কিছু শুনেছিলাম যা হয়তো অতিরঞ্জিত। গরুকে নাকি মাসাজ করা হয়, সঙ্গীত শোনানো হয়, এমনকি বিয়ার খাওয়ানো হয় মাংসের গুণগত মান বাড়ানোর জন্য। জাপানে শত শত বছর ধরে এই নির্দিষ্ট ব্লাডলাইন রক্ষা করে বংশবিস্তারের মাধ্যমে এই জাতটি উন্নত করা হয়েছে।
এই প্রসঙ্গ থেকেই ব্রিটিশ সহ বাকি পশ্চিমাদের ব্যাপারে কিছু অদ্ভুত বিষয় খেয়াল এলো। জিম করবেটের শিকারের কাহিনী পড়তে পড়তে দেখেছিলাম ব্যাটা হচ্ছে ইংরেজ (এংলো-ইন্ডিয়ান মূলত), কিন্তু দীর্ঘদিন থাকতে থাকতে ভারতবর্ষের জঙ্গলের আনাচে কানাচে সব জানে। কোনটা কোন পশুর ডাক, কোনটা কোন পাখির ডাক এসব মুখস্ত। পায়ের ছাপ দেখে বুঝতে পারত বাঘ ক্ষুধার্ত নাকি শান্ত। উপমহাদেশের সেরা শিকারির নাম বললে জিম করবেটের নাম আসবে।
এই ব্যাপারটায় হয়তো নুয়ান্স আছে। কারণ ইউরোপিয়ানরা আধিপত্যে ছিল, তাই হয়তো সাহিত্য ও ইতিহাসের একরৈখিক ব্যাখ্যায় অন্যকারো গল্প স্থান পায় নি। তবুও এমন কিছু প্রমাণ আছে যেটা মূল স্টেইটমেন্টকে বৈধতা দেয়। ব্রিটিশ ও অন্যান্য কিছু ইউরোপিয়ানদের ব্যাপারে আমার যতটুকু মনে হয়েছে-
প্রথমত, এই শালারা প্রচুর কম্ফোর্ট জোনের বাইরে থাকতে পারে
দ্বীতিয়ত, এরা মরিয়া হয়ে চেষ্টা করে ও অসাধারণ এডাপ্টেশন ক্ষমতা।
তৃতীয়ত, ওদের প্রচুর সাহস (কিছুক্ষেত্রে এটাকে বোকামী হিসেবেও ধরা যায়)
একারণে শীতপ্রধান দেশে জন্মেও ইউরোপিয়ানরা আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা ও ভারতবর্ষের মত যায়গা কলোনাইজ করতে পেরেছে। ভ্যাপসা গরম সহ্য করেছে ও মশার কামড় খেয়েছে। কিছু যায়গা আছে যেখানে কেউ মরতেও যায়না কিন্তু দেখবেন সেসব যায়গাতেও ইংরেজরা চলে গিয়েছে।
এরা যেখানেই কলোনি করতে গেছে সেখানকার সংস্কৃতি বাদ দিলে প্রায় বাকি সবকিছুতে এক্সপার্ট হয়ে গেছে।
যেমন দেখেন প্রথম বাংলা ব্যকরণ রচয়িতা বাঙালি না সেটা একজন ইংরেজ, নাম নাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড। উইলিয়াম কেরি জীবদ্দশায় প্রায় ৩৪টি ভাষা ও উপভাষা শিখেছিলেন, বাংলা, সংস্কৃত, হিন্দি, মারাঠি, তামিল ইত্যাদি জানতেন ও এসব ভাষায় বাইবেন অনুবাদ করেন। উপমহাদেশেই এতদিন এভারেস্ট ছিল, কিন্তু সেটার চূড়ায় প্রথমে যে উঠে সে নিউজিল্যান্ডের। এমনকি ব্রাহ্মি লিপি প্রথম যে ডিসাইফার করে সেও ইংরেজ।
নতুন জিনিস এক্সপেরিমেন্ট ও ট্রাই করা সম্ভবত ইউরোপিয়ানদের একটা নেশা। পৃথিবীর দুই মেরু অঞ্চল আর্কটিক ও এন্টার্টিকা প্রথম এক্সপ্লোর করা লোকেরাও নরওয়েজিয়ান আর ব্রিটিশ। জেমস কুক সর্বপ্রথম অস্ট্রেলিয়া ম্যাপ করে। পুরো দুনিয়া তিনবার চক্কর লাগানো প্রথম লোকটাও কোনভাবে ইংরেজ। রিচার্ড বার্টন নামে এক ব্রিটিশ লোক ছিল ২৯ টা ভাষা জানতো। এরাবিয়ান নাইটস ইংরেজিতে অনুবাদ করেছে এবং শোনা যায় ছদ্মবেশে নাকি একবার হজ্বও করে এসেছে। এই কাজটা করেছে স্রেফ কৌতুহল ও আগ্রহের বশে।
এমনকি ইজিপশিওলজির গোরাপত্তন, হায়রোগ্লিফিক্স ডিসাইফার করেছে ইউরোপীয়ানরা। পার্সি ফশেট নামে এক ইংরেজ ভূতত্ত্ববিদ ছিলেন। ১৯০০ সালের দিকে এমাজন জঙ্গলে অভিযান চালিয়েছেন। ১৯২৫ সালে একটা হারানো শহর খুঁজতে গিয়ে নিজেই নিখোঁজ হন। মানে এক কথায়, দেখা যায় দুঃসাহসী এক্সপ্লোরারদের বেশীরভাগই কোনভাবে ব্রিটিশ বা ইউরোপিয়ান।
জঙ্গল অভিযান, সমুদ্রভ্রমণ, তিমি শিকার, আফ্রিকাতে কোন ফ্যান্টম হাতির আক্রমণ থেকে গ্রামবাসীকে বাঁচানো নিয়ে বিভিন্ন ইউরোপিয়ান অফিসারদের ঘটনা পড়েছি আর রোমাঞ্চিত হয়েছি।
জেমস ক্লিয়ারের বই এটমিক হ্যাবিটস থেকে একটা ঘটনা বলি। ১৯০৮ সাল থেকে ব্রিটিশরা অলিম্পিক গেইমসের সাইক্লিংয়ে তুলনামুলক বাজে ছিল। সাইক্লিংয়ের বৃহত্তম রেস ট্যুর ডি ফ্রান্সেও একই, ১১০ বছরেও কোন ব্রিটিশ এই ইভেন্ট জিতে নাই। ইউরোপের ভালো বাইক কোম্পানীগুলো নেভেটিভ পাবলিসিটির ভয়ে ব্রিটিশদের কাছে বাইক বেচত না।
ব্রেইলসফোর্ড নামে নতুন কোচ নিয়োগ দেয়া হল। কোচের কাজ কি? শুধু অনুশীলন করানো তাইতো? কিন্তু এই লোক ফুলফ্লেজড সায়েন্টিস্টের মত কাজ করা শুরু করল।
এমন কিছু নাই যেটা ব্রেইলসফোর্ড চেষ্টা করল না। নতুন বাইক ডিজাইন করল যেখানে সিটগুলো তাদের মত আরামদায়ক পজিশনে রাখলো। টায়ারগুলো এলকোহল দিয়ে ঘষা হল। রাইডারদের গরম পোষাক দেয়া হল, প্রতিটা রাইডারের শরীরে বায়োসেন্সর লাগানো হল শারিরীক প্রতিক্রিয়া ও ওয়ার্ক আউট পর্যবেক্ষণের জন্য।
সুড়ঙ্গের ভেতরে বিভিন্ন স্যুট পরিয়ে বাতাস প্রবাহিত করে এরোডায়নামিক্স পরীক্ষা করে দেখা হল, ফলে স্যুটেও কিছুটা চেঞ্জ আনা হল। কোচ এত নাছোড়বান্দা ছিল যে কোথাও কোনভাবে ১% উন্নতিও করা সম্ভব হলেও তা বাদ দিল না। এথলেটদের মাসলের রিকভারির জন্য বিভিন্ন মাসাজ জেল টেস্ট করা হল।
ডাক্তার, সার্জন নিয়োগ করা হল। হাস্যকর ব্যাপার হচ্ছে সাইক্লিস্টদের ঠান্ডা লাগানোর সম্ভাবনা কমাতে সহীহ পদ্ধতিতে হাতধোয়ার ট্রেইনিংও দেয়া হল। রাতে ভালো ঘুমের জন্য বালিশ আর গদিও টেস্ট করা হল। মানে একেবারে টমাস এডিসনের মত সবকিছু এক্সপেরিমেন্ট করে দেখা হচ্ছে।
ব্রেইলসফোর্ডের কথাই ছিল এরকম যে- ভাই আমাকে একদিনে হাতি মেরে দেখাতে হবে না, প্রতিদিন আগের থেকে ১% উন্নতি করলেই হবে। কিন্তু ধারাবাহিকভাবে প্রতিদিন করতে হবে।
ফলাফল হচ্ছে ব্রেইলসফোর্ডের দায়িত্ব নেয়ার পাঁচ বছরের মধ্যে বেইজিং অলিম্পিকে ব্রিটিশ টিম ৫০ পার্সেন্স গোল্ড মেডেল জিতে নেয়। এর পরের অলিম্পিকেতো নয়টা অলিম্পিক রেকর্ড ও সাতটা বিশ্বরেকর্ড করে ফেলে এবং ট্যুর ডি ফ্রান্সও জিতে নেয়।
যাইহোক, মজার ব্যাপার হচ্ছে আপনি এখনো এরকম কেইস দেখবেন যে কোন একটা ব্রিটিশ বা পশ্চিমা নাগরিক অদ্ভুত কারণে হঠাৎ করে বাংলাদেশ বা ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাস করা শুরু করেছে। কিছু কেইভ এক্সপ্লোরার আছে যারা চিপাচাপা গুহা দেখলেই ভেতরে ঢুকে যায়। বহু বিলাতি ফুড ভ্লগারকে দেখবেন এমন স্ট্রিট ফুড খাচ্ছে বা এমন টয়লেট ব্যবহার করছে যেটা আপনি জীবনেও ট্রাই করতে চাইবেন না। ওরা কেন জানি করছে।
সম্ভবত জাতিগত ভাবে কোমফোর্ট জোনের মেন্টালিটি বাদ দিয়ে এরকম এক্সপ্লোরার মেন্টালিটি গড়ে তোলা যায় না। তবে ইন্ডিভিজ্যুয়ালিস্টিক ভাবে সেটা হতে তো বাঁধা নাই। লাইফে রিস্ক নেয়া, একটা গোল সেট করা এবং সেই কম্পিটিটিভ গোল পারসিউ করার ব্যাপারটা অসাধারণ। এসব ছোট বড় জিনিস জীবনে অনেক বলার মত গল্প রেখে যায়।
জীবনে যে একবার বাঘ শিকার যে করেছে তার কাছে একবার সেই গল্প শুনতে চেয়েন। অথবা যে স্কাইডাইভিং করেছে,গভীর সমুদ্রে স্করকেলিং করেছে, কিংবা সম্পূর্ণ একা একটা দ্বীপে একদিন থেকেছে তার কাছে জানতে চেয়েন তার আকাশ দেখার অনুভূতি কেমন ছিল।
আমার পছন্দের একজন ইনফ্লুয়েন্সার এবং লেখক কোন একটা ভিডিওতে দৌড়াতে দৌড়াতে অনেকটা এরকম কিছু বলেছিল-
“এই যে আমি ভোর সকালে উঠে পাগলের মত দৌড়াচ্ছি, কেন দৌড়াচ্ছি জানেন? কারণ আমি জানি আমার আশেপাশের সব লুজাররা এখন ঘুমাচ্ছে। এটা করার মত অওকাদ সবার নাই আর এই ব্যাপারটাই আমাকে ইম্পাওয়ার ও মোটিভেট করে”
-ওমর বিন মাহতাব।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন