বাংলাদেশে একটা কথা খুব প্রচলিত, “বউ হারালে বউ পাওয়া যায়, মা হারালে মা পাওয়া যায় না।”
শুনতে যতটা আবেগময়, বাস্তব জীবনে এই কথাটা অনেক সময় হয় অন্যায় আর বিষাক্ত চাপে পরিণত।
এই কথাটা বুকের মধ্যে নিয়ে চলা অনেক পুরুষ নিজের জীবনের ভারই বইতে পারে না।
একসময় হাঁপিয়ে যায়—
👉 বউকে খুশি রাখতে গিয়ে মাকে কষ্ট দেয়
👉 আবার মাকে খুশি রাখতে গিয়ে স্ত্রীর চোখের জল দেখেও কিছু বলতে পারে না
এভাবেই একটা সময় সে একদম একা হয়ে পড়ে। অনেকেই তো সহ্য করতে না পেরে নিজেকেই শেষ করে দেন। আমি নাজিম উদ্দিন হৃদম আজ কথা বলবো "মা নাকি বউ" এটা নিয়েই।
💔 তিন দিক থেকে চাপ — আর মাঝখানে একজন অসহায় ছেলে
🎭 ১. মা কী ভাবেন?
"আমার ছেলে তো এখন বউয়ের হয়ে গেছে। আগে যেমন ছিল, এখন আর তেমন খেয়াল রাখে না।"
— মা নিজের জায়গা হারিয়ে ফেলেন বলে মনে করেন।
💔 ২. স্ত্রী কী ভাবেন?
"এই সংসারে আমার কথা কেউ শুনে না। সব সময় শাশুড়ির কথাই শুনতে হয়। আমি কি কখনো এই ঘরের আপন হবো না?"
— স্ত্রী ভালোবাসা চায়, নিরাপত্তা চায়, জায়গা চায়।
😓 ৩. ছেলে কী করে?
চুপচাপ থাকে। হয়তো কারো সাথেই মন খুলে কথা বলতে পারে না।
তার দিক থেকে দেখলে—সে দুজনকেই ভালোবাসে। কিন্তু কার পক্ষে দাঁড়াবে?
⚠️ এই টানাপোড়েন যদি চলতেই থাকে, কী হয়?
👉 পরিবারে প্রতিদিন ঝগড়া,
👉 স্ত্রী বিষণ্নতা ও মানসিক অবহেলায় ভোগে,
👉 মা নিজেকে অবহেলিত ভাবেন,
👉 সন্তানদের মনেও ভয় গেঁথে যায় — বাবা চুপ, মা কাঁদে।
এভাবে একটা সংসার ভেঙে পড়ে, ভবিষ্যৎ পর্যন্ত তছনছ হয়ে যায়।
🧨 সবচেয়ে ভয়ংকর পরিণতি?
অনেক পুরুষ এটা সহ্য করতে না পেরে—
👉 মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে
👉 হঠাৎ একদিন বাসা ছেড়ে চলে যায়
👉 কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ পর্যন্ত বেছে নেয়
পুরুষ যদি ব্যালেন্স না শেখে তাহলেই সেই পরিবার টা খুব তাড়াতাড়ি ধংশ হয়ে যাবার সব থেকে বেশী সম্ভবনা থাকে।
🧠 তাহলে সমাধান কী? ব্যালেন্সটা কীভাবে তৈরি হবে?
🔹 ১. ছেলের (স্বামীর) ভূমিকা — তিনি হচ্ছেন সম্পর্কের 'সেতু'
একজন পুরুষকে বুঝতে হবে—মা ও বউ দুজনই তার জীবনসঙ্গী, কিন্তু ভিন্নভাবে।
👉মা তাকে জন্ম দিয়েছেন, জীবন গড়ে দিয়েছেন।
👉আর বউ তার ভবিষ্যতের পথচলার সঙ্গী।
এখন এই দুই নারীর মাঝখানে উপস্থিত থাকার আর বুদ্ধিমত্তার ভার তার ওপরেই।
✅তাহলে করণীয় কি :
👉আলাদা সময় দিন:
যেমন: মাকে সকালে চায়ের সময়টা দিন, স্ত্রীর সাথে রাতে ২০ মিনিট গল্প করুন।
দুজনকেই মনে হবে, আপনি তার পাশে আছেন।
👉সংঘর্ষে নিরপেক্ষ থাকুন:
কোনো পক্ষ না নিয়ে বলুন,
“দুইজনকেই আমি ভালোবাসি, কিন্তু একটা বিষয়ে একসাথে বসে কথা বলা যাক।”
মুখ বন্ধ রাখার চেয়ে এই মধ্যস্থতা করা অনেক ফলদায়ক।
👉প্রতিটি ভালোবাসার ইঙ্গিত দিন:
বাজার থেকে ফেরার পথে মা’র জন্য পছন্দের ফল আনুন,
আবার স্ত্রীর জন্যও পছন্দের কিছু আনুন।
ছোট ছোট এই আচরণ একেকটা শান্তির পিলার তৈরি করে।
📌 উদাহরণ :
রফিক সাহেব, নারায়ণগঞ্জের এক প্রাইভেট কোম্পানির ম্যানেজার।
তিনি তার স্ত্রীকে মায়ের সঙ্গে রান্না করতে বাধ্য করেন না।
তবে সন্ধ্যার পর মা ও স্ত্রী দুজনকে নিয়ে বারান্দায় বসে গল্প করেন, মজার ভিডিও দেখেন।
এই ছোট্ট সময়টাই দুজনের মন ভালো করে দেয়।
🔹 ২. মায়ের ভূমিকা — ছাড় নয়
👉মায়ের ভয়টা খুব সাধারণ:
আমার ছেলে তো এখন আমাকে সময় দেয় না। হয়তো ওর মনটাই চলে গেছে অন্য দিকে।
কিন্তু মনে রাখতে হবে—ছেলে যখন বিয়ে করে, সে আপনাকে কম ভালোবাসে না।
সে শুধু তখন দ্বিগুণ দায়িত্বশীল হয়ে যায়।
✅ করণীয়:
👉 বউকে শত্রু মনে করবেন না:
আপনার ছেলে আজকে তার জীবনসঙ্গীকে নিয়ে ভবিষ্যৎ গড়বে—এটা আপনি আশীর্বাদ করলেই সে সুন্দর হবে।
👉সাহায্য না চাইলে চাপ দিবেন না:
তুমি এটা করো না কেন?, আগে তো আমি এত কিছু করতাম—এই তুলনাগুলো এড়িয়ে চলুন।
👉স্ত্রীকে 'মেয়ে' ভাবুন, 'প্রতিযোগী' নয়:
আপনি যদি তাকে বলেন, “তুমি আমার মেয়ের মতো”—তাহলে সেও একদিন আপনাকে “আম্মু” বলে গর্ব করবে।
📌 উদাহরণ:
সেলিনা খাতুন, বরিশালের এক মা, প্রথম দিকে তার পুত্রবধূকে সন্দেহ করতেন।
কিন্তু একদিন সে নিজের হাতে রান্না করে বউমার জন্য আনলেন খাবার।
বউমা খেয়ে কেঁদে ফেলে বললেন, “আপনার হাতের রান্না আমার মায়ের মতো।”
এরপর থেকে তাদের সম্পর্ক আর কখনো দূরত্বে যায়নি।
🔹 ৩. স্ত্রীর ভূমিকা — সম্মান দিন।
স্ত্রীরা অনেক সময় ভাবেন—আমার স্বামী সব সময় মায়ের কথাই শুনে।
কিন্তু আপনাকে বুঝতে হবে—আপনার স্বামীর মা একজন আবেগের জায়গা, তার শিকড়।
আপনি যদি সেই জায়গাকে সম্মান করেন, আপনি তার হৃদয়ের সবচেয়ে আপন হয়ে উঠবেন।
✅ করণীয়:
👉শাশুড়িকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করবেন না:
আপনি যদি তাকে সম্মান করেন, তিনিও আপনাকে আপন ভাববেন।
👉স্বামীকে প্রতিদিন অভিযোগ না করে সাহচর্য দিন:
তোমার মা এটা বলেছে — এটা বাদ দিয়ে বলুন, আজ একটু গল্প করি?
চাপ দিলে পুরুষ পালায়, শান্তি দিলে সে নিজে থেকেই ফিরে আসে।
👉মায়ের সামনে অহংকার করবেন না:
বরং সব সময় মায়ের প্রতি সৌজন্য বজায় রাখুন—এতে স্বামীর চোখে আপনার মর্যাদা বাড়ে।
📌 উদাহরণ:
তানজিলা আপু, ঢাকার একজন গৃহিণী, শাশুড়ির সাথে প্রথমে কথা বলতেন কম।
পরে একদিন শাশুড়ির জন্মদিনে চুপিচুপি তার জন্য শাড়ি এনে উপহার দেন।
এরপর থেকেই শাশুড়ি তাকে শুধু "বউমা" নয়, “মেয়ে” বলেই ডাকেন।
🚨 যদি ব্যালেন্স না থাকে, কী হয়?
👉 ১. পুরুষ হয়ে পড়ে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত – কার কথায় চলবো?\
📌যখন মা বলেন—“তোমার বউ এখন তোমাকে বদলে দিয়েছে।”
📌আর স্ত্রী বলেন—“তুমি কখনো আমার পক্ষে কথা বলো না।”
📌তখন একজন ছেলে মাঝখানে পড়ে "নিজের কথাই ভুলে যায়"।
📌 উদাহরণ:
সাগর, খুলনার এক প্রাইভেট কোম্পানির অফিসার।
মায়ের চাপে তিনি স্ত্রীর কোনো কথাই শুনতে পারতেন না।
স্ত্রী একসময় মানসিক অবসাদে ভুগে বাবার বাসায় চলে যান।
সাগর এখন নিজের ছেলেকেও ঠিকমতো দেখতে পারেন না।
কেন? কারণ সে সময়মতো ‘ব্যালেন্স’ শিখেনি।
👉 ২. মা আর বউয়ের মধ্যে শত্রুতা জন্ম নেয়
মায়ের মনে হয়—"বউ ছেলেকে কেড়ে নিয়েছে"
বউয়ের মনে হয়—"মা কখনো আমাকে আপন ভাবেনি"
এই ভুল বোঝাবুঝি যত বাড়ে, ততই ঘরে ঝগড়া, কটুবাক্য, অভিমান আর মনকষাকষি জমে।
এক সময় এমন হয়—একজন কিছু বললেই আরেকজন রিঅ্যাক্ট করে।
📌 উদাহরণ:
নুসরাত, চট্টগ্রামের একটি গৃহিণী, স্বামীর পরিবারে এসে প্রথম দিকে হাসিখুশি ছিলেন।
কিন্তু শাশুড়ির কড়া মন্তব্য ও বারবার তুলনা তাঁকে দমিয়ে দেয়।
নুসরাত একসময় কাউকে না বলে আত্মহত্যা করেন।
পরিবারে চিরদিনের মতো বিষাদের ছায়া নামে।
👉 ৩. সন্তানরা বড় হয় ভয়ের মধ্যে—“বিয়ে মানেই সমস্যা”
যে ঘরে প্রতিদিন মা-বাবার ঝগড়া, শাশুড়ি-বউয়ের ঠাণ্ডা লড়াই, আর বাবার নিরবতা—
সেই ঘরে বড় হওয়া সন্তানদের মনে সম্পর্কের প্রতি ভয় গেঁথে যায়।
তারা ভাবে—“বিয়ে মানেই ত্যাগ, মানেই কষ্ট”
একটা প্রজন্ম দাম্পত্যের গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে।
📌 উদাহরণ:
ঢাকার রাহাত, নিজের মা-বাবার জীবনে যন্ত্রণা দেখে এতটাই প্রভাবিত হন যে,
বয়স ৩৫ পেরিয়েও তিনি বিয়ে করতে চান না।
তাঁর ভাষায়—“আমি আর একটা সংসারে সেই যুদ্ধ দেখতে চাই না।”
👉 ৪. একসময় স্ত্রী ভাবেন – “আমার কোনো মূল্যই নেই”
যখন স্বামী বারবার মায়ের পক্ষ নেয়,
যখন সে স্ত্রীর অনুভব বোঝে না,
তখন স্ত্রী নিজেকে একটা "আঁটকে পড়া বোঝা" মনে করে।
এটা ধীরে ধীরে ডিপ্রেশন, আত্মগ্লানি, এমনকি শারীরিক অসুস্থতা পর্যন্ত নিয়ে যায়।
📌 উদাহরণ:
তানিয়া, রাজবাড়ির এক তরুণী।
স্বামী তাকে কোনো সিদ্ধান্তে গুরুত্ব দিতেন না, সবসময় মায়ের কথাই চলতো।
এক সময় তানিয়া কিছু না বলে সন্তানকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে যান।
স্বামী তখন বুঝলেন—তিনি আসলে দুজনকেই হারিয়েছেন।
👉৫. এক পর্যায়ে পুরুষ নিজেও হাঁপিয়ে যায় – "আমি কি কখনো শান্তি পাবো না?"
একদিকে মায়ের অভিমান, অন্যদিকে স্ত্রীর অভিযোগ,
আর তার মধ্যে নিজের কাজের চাপ, সমাজের চাপ—
সব মিলিয়ে সে একসময় মনে করে "সব ছেড়ে দিলে বাঁচি"
এই সময়ই অনেকে হয়ে পড়ে—
👉 বিষণ্ন,
👉 রেগে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ে,
👉 কাজে মনোযোগ হারায়,
👉 কেউ কেউ মাদক বা সিগারেটের ওপর নির্ভর করে,
👉 আবার কেউ কেউ চিরতরে হারিয়ে যায়...
📌 সাম্প্রতিক ঘটনা
চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁও থানার র্যাব-৭ ক্যাম্পে কর্মরত
স্কোয়াড কমান্ডার সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পলাশ সাহা
নিজের অফিস কক্ষে নিজের পিস্তল দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, তিনি একটি চিরকুটে কিছু পারিবারিক অসন্তোষ ও মানসিক ক্লান্তির কথা উল্লেখ করেন।
এএসপি পলাশ সাহা ছিলেন মেধাবী, দায়িত্বশীল ও সৎ অফিসার।
কিন্তু পরিবার থেকে পাওয়া বোঝার অভাব, চাপ, একাকীত্ব—সব মিলিয়ে
তিনি এমন ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন।
এই ঘটনা প্রমাণ করে,
👉 সম্মানিত পেশা থাকা,
👉 আয় থাকা,
👉 সামাজিক অবস্থান ভালো হওয়া —
এই সবই অর্থহীন হয়ে পড়ে, যদি ঘরে ফিরে কেউ বুঝে না: “তুমি কেমন আছো?”
🧠 এই পরিণতি কি আপনি চান?
এই শেষ না হোক আপনাদের পরিবারে।
এই কান্না না হোক আপনার স্ত্রীর চোখে,
এই অভিমান না হোক আপনার মায়ের হৃদয়ে,
এই একাকিত্ব না হোক আপনার নিজের জীবনে।
🌈 বাসা হোক শান্তির ঘর, প্রতিযোগিতার ময়দান নয়
একটা বাসায় দুজন নারী থাকলে প্রতিযোগিতা নয়—সহাবস্থান হওয়া উচিত।
আর সেই সহাবস্থানের মূল কান্ডারী হচ্ছেন—পুরুষ নিজেই।
আপনি যদি মা আর স্ত্রীর মধ্যে শান্তির সেতু তৈরি করতে পারেন,
তাহলে সেই ঘরে একদিন সন্তানেরাও শিখবে—"ভালোবাসা মানে বোঝা, বোঝাপড়া আর সমান সম্মান।"
🕊️ যদি ভালোবাসেন, তাহলে বোঝার দায়িত্বটাও নিন।
আপনার মা আপনাকে জন্ম দিয়েছেন।
আপনার স্ত্রী আপনার নতুন জীবনের সঙ্গী।
এই দুইজন মানুষ আপনার জীবনের দুই কণা—একজন রক্তের, আরেকজন ভালোবাসার।
তাদের মাঝে থেকে আপনি যদি ব্যালেন্স করতে পারেন,
তাহলে আপনি শুধু একজন সফল পুরুষই নন—আপনি একজন সত্যিকারের মানুষ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন