আজ সকালে বাজারের ব্যাগ হাতে আমাকেই বেরোতে হলো। 'আমাকেই বেরোতে হল' কথাটা এই কারণেই বললাম সকালের বাজার করার দায়িত্ব আমার মায়ের। মা নিজে হাতে বাজার করবে, সে সবজিই হোক বা মাছ। বাড়িতে ফ্রিজ থাকা সত্ত্বেও প্রতিদিন বাজারে যাবেই। মায়ের বক্তব্য ফ্রিজে মাছ সবজি রাখার থেকে প্রতিদিন টাটকা জিনিস খাওয়াই ভালো।
তো আজ আর মা যেতে পারল না। শুধু আজ নয়, গত দু'তিন দিন মা আর যেতে পারছেই না। সমস্যা চোখে। ডান চোখে দেখতে পাচ্ছে না। বাম চোখটাও আবছা দেখছে। ডাক্তার দেখানো হয়েছে। এর আগে অবশ্য ছানি অপারেশন হয়েছে। ডাক্তার বাবু বললেন, চোখে ইঞ্জেকশন দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ইঞ্জেকশন দিতে গিয়ে দেখা গেল আর এক সমস্যা। সুগার লেভেলটা একটু হাই। তাই সুগার কমাতে হবে। যে ডাক্তার বাবুর ট্রিটমেন্টে মা থাকেন উনি আর একটা ওষুধ বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, এতে সুগারটা কমবে। তারপর ইঞ্জেকশনটা নিতে পারবেন। সেই ভাবেই সমস্ত ওষুধ চলছে গত চার পাঁচদিন। তো আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই মা আক্ষেপ করে বলল,
-মনে হয় আমি আর কোনো দিন বাজার যেতে পারব না। এবার থেকে তুই বাজার করে নিয়ে আসবি।
মাকে আশ্বস্ত করে বললাম, তুমিই যাবে। কিছুদিন রেস্টে থাকো। চোখ ঠিক হয়ে গেলে, তুমিই বাজার করবে নিজে হাতে।
বুঝতে পারছিলাম মায়ের কষ্টটা। এই বয়সে এসে মা নিজের পায়ে হেঁটে, নিজে হাতে দেখে, সবজি কেনা, মাছ কেনা, পাঁচটা মানুষের সাথে কথা বলা, এর মধ্যে রয়েছে মায়ের ভালো থাকার রসদ, বেঁচে থাকার উদ্যম। বয়স বাড়ার সাথে সাথে, শক্তি কমার সাথে সাথে মানুষ তো একদিন ঘর বন্দী হয়েই যায়। তারপর থেকে বাইরের পৃথিবীটা তখন অধরা থেকে যায়। কি অদ্ভুত জীবন মানুষের। কিন্তু কেউ কি চায় এভাবে থাকতে? মন তখন অন্য কথা বলে, একটু বেরোতে পারলেই ভালো হতো।
তবে আমার মাকে আমি বারণ করে বলতাম, মা রোজ রোজ যাওয়ার কী দরকার আছে। তোমার তো বয়স বাড়ছে। চোখের সমস্যা, তার ওপর সুগারের পেশেন্ট তুমি, কেন এত কর? আমিই তো করতে পারি এগুলো।
মা বলে, তুই এসব পারবি না। মাছ, সবজি এগুলো সব দেখে আনতে হয়। তাছাড়া তোর সময় কোথায়? সকালে বেরিয়ে সেই সন্ধ্যের পর ফেরা। তোর ওপর চাপ পড়ে যাবে।
আমি জানি, মায়ের এই কথা গুলো বাইরে বের হবার বাহানা। সত্যিই কি আমি বাজার করতে পারব না? নাকি আর কেউ চাকরি বাকরি করে এসব করে না? আসলে মা চায় এই বয়সে একটু বাইরে বেরোবে, চেনা পরিচিত কারো পাথে দেখা হলে একটু সময় বিনিময় করবে, বাইরের জগতটাকে নিজে চোখে দেখবে। আমি আর বাধা দিতাম না মাকে। এগুলোর ও তো প্রয়োজন আছে। মন যদি ভালো না থাকে তখন শরীরটাও আর সায় দেবে না। আমাকে অনেকেই বলে, কেন বয়স্ক মাকে দিয়ে এসব করাও, নিজেই তো করতে পারো। আমি কান দিই নি কারো কথাতেই। মায়ের ভালো থাকাতেই আমি ভালো থাকা খুঁজি। শুধু একটাই ভয়, রাস্তা ঘাটে গাড়ি ঘোড়ার এত চাপ, কখন যে দুর্ঘটনা ঘটে যাবে, তাই মাকে বলি, খুব সাবধানে রাস্তা চলবে।
সে যাইহোক, যে কথা বলতে গিয়ে এত কথা বলে ফেললাম, সে কথাটা এবার বলি। আজ সকালে বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়েই মাকে জিজ্ঞেস করলাম, বাজারের কী কী জিনিস আনতে হবে।
মা বলল, যা খেতে ইচ্ছে করবে তাই নিয়ে আসিস।
চিকেন নেব ভেবেই বেরিয়েছি। ঘড়িতে তখন সাড়ে নটা। একটু বেলাই হয়েছে। চিকেনের দোকানে যেতেই মাংস বিক্রেতা ছেলেটি আমাকে দেখেই বলল, কাকিমা আসেনি আজ?
বললাম, মায়ের শরীরটা খারাপ। আজ আসতে পারল না। এবার থেকে আমিই আসব।
-সে ঠিক আছে। কাকিমা আসে তো, এসে অনেক গল্প করে। আমি জিজ্ঞেস করি, তোমার কথা। বলে, ছেলের সময় কোথায়। এই বয়সে কাকিমা সব কিছু নিজে হাতে করবে। করুক করুক। বাইরেও একটু বেরোনো দরকার আছে। তাতে মন ভালো থাকে। দাদা তুমি দাঁড়াও, মাংস রেডি নেই। আমি তোমাকে দিচ্ছি।
বললাম, তুমি রেডি করো আমি দাঁড়াচ্ছি। চিকেন ছাড়া আর কী কী নেব তখন সেটাই ভাবছি। হঠাৎ করেই আমার পিছনে কী যেন একটা আওয়াজ হলো। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি এক বয়স্ক ভদ্রলোক, বয়স সত্তরের কাছাকাছি। সাইকেল সমেত উল্টে পড়ে গেল। সাইকেলের দুদিকের হ্যাণ্ডেলে রয়েছে ব্যাগভর্তি বাজার। একটা ব্যাগ থেকে সবজি ছিটকে গিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। আশে পাশে যারা ছিল, তারা বলতে শুরু করল, আরে তোল তোল। কে তুলতে আসবে? বুঝতে পারলাম, পা ঠেকাতে গিয়ে ব্যালেন্স রাখতে না পেরে পড়ে গেছে। আমি সঙ্গে সঙ্গেই সাইকেলটা তুলে সবজি গুলো কুড়িয়ে ব্যাগে রাখলুম, আর একটি বাচ্চা ছেলে সে এসে ওনার হাতটা ধরে তুলল। কোনো রকমে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে দাঁড়াতে পারলেন, পাশে একটা বেঞ্চ ছিল, আমিও ধরে ওখানেই বসিয়ে দিলাম। দেখলাম পা মচকেছে, আর সব থেকে বেশি লেগেছে কোমরে। সঙ্গে সঙ্গেই পাশের দোকান থেকে বরফ নিয়ে এসে পায়ে আর কোমড়ে দিতে লাগলাম। উনি এতটাই টেনশন করে ফেলেছেন, শুধু একটাই কথা বলছেন," আমার সব শেষ হয়ে গেল। আর হয়তো কোনো দিন আসতে পারব না।" বরফ দিতে দিতেই আশ্বস্ত করলাম, টেনশন করবেন না কিছুই হয় নি। বাড়ির নাম্বার বলুন, বাড়িতে কল করি।
উনি যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন, আর তার সাথেই বলছেন, " বাড়িতে কল করতে হবে না। ছেলে বারণ করেছিল, আমি জোর করে বাজারে এসেছি। যদি জানতে পারে আর আসতে দেবে না আমাকে।"
বুঝতে পারলাম, এই একই অনুভূতি আমার মায়েরও। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই পৃথিবীর সাথে আরো অনেকটা মায়া বাড়িয়ে ফেলে বয়স্ক মানুষরা। অনুভব করলাম, শুধু আমার মা নয়, এই পৃথিবীতে আরো কত বয়স্ক মা বাবা আছেন, যারা এই বয়সে এসেও মনের জোর নিয়েই বাইরে বেরোন। সে যাইহোক,
উপায় তো নেই। বাড়িতে কল করতেই হবে। তাই জোর করে একটু ধমকের সুরেই বললাম, আগে কল করুন। বাড়ির লোককে জানাতে হবে তো। যতক্ষণ না কেউ আসছে, ততক্ষণ আমি আছি। আমি আপনার ছেলের মতো।
আমার কথাটা উনি শুনলেন। কোনো রকমে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে, কল করে ছেলেকে ডাকলেন। দেখলাম দশ মিনিটের মধ্যেই ছেলেও চলে এলো। ছেলেকে বললাম, আগে ডাক্তারের কাছ নিয়ে যান। উনি তো দাঁড়াতেই পারছেন না।
আশেপাশে তখন ভালোই ভীড় জমে গেছে। অনেকেই অনেক কিছু পরামর্শ দিচ্ছে, কেউ কিন্তু এগিয়ে এসে সহযোগিতার হাত বাড়ায় নি। ওনার ছেলেকে দেখলাম, খুব শান্ত স্বরে বলল, বাবা! ও নিয়ে চিন্তা করো না। ডাক্তারের কাছে আগে চলো, ওষুধ খেলেই ঠিক হয়ে যাবে।
আমি ছেলের জায়গায় থাকলে ঠিক এই কথাটাই বলতাম। বয়স্ক বাবা মা তো আমাদের সন্তানের মতোই। একটা টোটো ডেকে বাবাকে টোটোয় বসিয়ে নিয়ে ছেলে চলে গেল, বাজারের ব্যাগ আর সাইকেলটা সাইডে রেখে মাংসের দোকানে ছেলেটিকে বলে গেল, পরে এসে নিয়ে যাচ্ছি।
বাবাকে নিয়ে ছেলেটি চলে যেতেই একজন দুম করে বলে বসল, ইয়াং ছেলে ঘরে বসে থাকে, আর বুড়ো বাবাকে বাজারে পাঠিয়ে দেয়। বাবাকে তো আর এমনি এমনি খাওয়াবে না, খাটিয়ে উশুল করে নেয়।
ভাবছিলাম একটি বার উত্তর দিই। তারপর ভাবলাম, সব জায়গায় উত্তর দিতে নেই। কিছু মানুষ আছে, যারা আসল কাজে কোনো কাজে লাগে না, কিন্তু অকেজো কথাও বলতে ছাড়ে না। ওখান থেকে সরে এলাম। শুধু এটুকু বুঝলাম, এই পৃথিবীর সব অনুভব ক্ষমতা ঈশ্বর সকলকে দেন নি। সত্যিটা তো আমি বুঝি, আমার মতো অনেকেই আছেন, যারা বাবা মায়ের অনুভূতিটুকু অনুভবেই বুঝে নেন।
কলমে: সরজিৎ ঘোষ। Sarajit Ghosh
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন