অভাবের মর্যাদা
রাতে অন্ধকার ঘনিয়েছে। মাটির ঘরে ছোট্ট প্রদীপটা টিমটিম করে জ্বলছে। বাইরে হালকা বৃষ্টি, টিনের চাল থেকে টুপটাপ শব্দ হচ্ছে। শীতের রাত, কিন্তু সেই ঘরে নেই কোনো মোটা কম্বল, নেই নরম বিছানা। একটি পুরনো খেজুরপাতার মাদুর আর তার ওপর পাতলা চাদর।
গরীব পিতা আবদুল মালেক নিজের সন্তান রাফিকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন—
“বাবা, আজ তোকে একটা গল্প শোনাবো। এটা কোনো রূপকথা নয়, একেবারে সত্যি গল্প। এই গল্প শুনে তুই বুঝবি, অভাব কষ্টের হলেও এর ভেতরেই মর্যাদা লুকিয়ে আছে।”
রাফি অবাক চোখে বাবার দিকে তাকালো।
---
গল্পের শুরু
“অনেক বছর আগে, আমার বয়স তখন তোর চেয়েও কম। আমাদের বাড়িতে একদিন ভাত রান্না করার মতোও চাল ছিল না। মা চুপচাপ আমাদের জন্য ভাতের বদলে লাল লবণ দিয়ে গরম পানি খাওয়াতেন। আমরা ভেবেই নিতাম এটা নাকি এক ধরনের স্যুপ। পেট ভরে যেত না, কিন্তু মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আমরা কোনো অভিযোগ করতাম না।
আমার বাবার হাতে কোনো কাজ থাকত না। সকাল থেকে সন্ধ্যা তিনি খেতমজুরের খোঁজে ঘুরতেন। অনেক সময় ফেরত আসতেন খালি হাতে। তখন মা আমাদের বলতেন—
‘অভাব লজ্জার নয়, চুরি করলে লজ্জা। অভাব সহ্য করতে পারলে তোর মাথা কখনো নিচু হবে না।’
সেই কথা আজও আমার মনে গেঁথে আছে।
একদিন এক ধনী লোক আমাদের বাড়িতে এলেন। তিনি আমাকে বললেন, ‘তুই আমার বাগানে কাজ করবি, কিন্তু শর্ত হলো, বাগানের ফল যদি তোর চোখে পড়ে, তুই চুরি করে খেতে পারবি না।’
আমি তখন ক্ষুধায় কাতর, দুইদিন ভাত খাইনি। তবু বাবার শিক্ষা মনে রেখে ফলের দিকে তাকিয়েও খাইনি। ধনী লোকটা দেখে অবাক হলো। পরে সে আমাকে ডেকে বলল,
‘তুই অভাবী হলেও সততা ধরে রেখেছিস। আমি তোকে আমার দোকানে কাজ দেবো।’
সেই সততার কারণেই আমি ধীরে ধীরে একটু দাঁড়াতে পেরেছিলাম।”
---
সন্তানের চোখ ভিজে যায়
মালেক থেমে গিয়ে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বললেন—
“বাবা, আমরা গরীব, এটা ঠিক। আমাদের ঘরে হয়তো বিলাসিতা নেই। কিন্তু এই অভাব আমাদের শিখিয়েছে মানুষ কিভাবে সৎ থাকতে হয়, কিভাবে অল্পতে খুশি থাকতে হয়। মনে রাখিস, বিলাসিতা মানুষকে অলস আর অকৃতজ্ঞ করে দেয়। কিন্তু অভাব মানুষকে পরিশ্রমী, ধৈর্যশীল আর মর্যাদাবান বানায়।
তুই যখন বড় হবি, তখন হয়তো ধনী হবি। কিন্তু যেন কোনোদিন অভাবের মর্যাদা ভুলে না যাস। অল্প খাবার থাকলেও যদি তা ঘামের টাকায় আসে, তবে সেটা রাজকীয় ভোজের চেয়েও বেশি সম্মানের।”
রাফির চোখে পানি জমে গেল। সে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলল—
“বাবা, আমি বুঝেছি। আমি কোনোদিন বিলাসিতার লোভ করব না। আমি অভাবকে মর্যাদা হিসেবে দেখব।”
---
গল্পের শেষ
বাইরে বৃষ্টি তখনো ঝরছে, কিন্তু ঘরের ভেতরে আলোটা যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। অভাবের ভেতরেও সেই পরিবারের হৃদয়ে জন্ম নিল এক অমূল্য সম্পদ— সততা, পরিশ্রম আর মর্যাদার শিক্ষা।
---
এই গল্প পড়লে বোঝা যায়, অভাব কখনো অভিশাপ নয়, বরং মানুষের চরিত্রকে সবচেয়ে সুন্দরভাবে গড়ে তোলে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন