কাকে যে নাস্তিক বলা হয়নি!
মহকবি ইকবাল যখন 'শিকওয়া' লিখলেন তখন তাকে নাস্তিক ঘোষণা করা হলো। আবার যখন তিনি 'জবাবে শিকওয়া' লিখলেন তখন তার নামের আগে আল্লামা দেয়া হলো। ‘শিকওয়া’ কবিতায় ইকবাল আল্লাহর কাছে মুসলমানদের দুর্দশা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এতে তিনি বলেন, মুসলমানরা ত্যাগ করেছে, ইতিহাস গড়েছে, অথচ আজ তারা পরাজিত ও অবহেলিত—কেন? এই প্রশ্ন তোলায় ইকবালের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ উঠলো, সীমা লংঘনের জন্য কাফের ফতোয়া দেয়া হলো। এই পরিস্থিতিতেই তিনি লেখেন ‘জবাবে শিকওয়া’—যেখানে অভিযোগের জবাব আসে আল্লাহর কণ্ঠে। জবাব হলো, মুসলিমরাই তাদের আদর্শ থেকে সরে গিয়েছেন। প্রশ্ন না তুললে দায়িত্ব কীভাবে শিখবেন? ইকবালকে বোঝা সহজ নয়। সহজ ছিলো না নজরুলকে বোঝাও। ধর্মের নামে অন্যায়, ভণ্ডামি ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তাঁর তীব্র অবস্থানের কারণে তাকেও নাস্তিক ঘোষণা দেয়া হয়। আবার নজরুল যখন লিখলেন, ‘ও মোর রমজানেরই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ কিংবা ‘মসজিদের পাশে আমার কবর দিও ভাই’ তখন তাকে মুসলিম জাগরণের কবি হিসেবে গ্রহণ করা হলো। এমনটা হয়েছে আল মাহমুদের ক্ষেত্রেও। তিনি যখন ‘সোনালী কাবিন’ লিখলেন তখন তিনি নাস্তিক আবার যখন ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ ও ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ লিখলেন তখন আবার মুসলিম উম্মাহর কবি হয়ে উঠলেন।
মুসলিম বিশ্বে কবি ও লেখকদের নাস্তিক বলার ধারা সুদীর্ঘকাল ধরেই চলে আসছে। ইসলামি স্বর্ণযুগের কালেও ইবনেসিনা, ইবনে রুশদ, আল ফারাবি, আল রাজিসহ বহু লেখক/দার্শনিককে নাস্তিক বলা হয়েছিল। বাংলাতেও মুসলিমদের জাগরণের জন্য লিখতে গিয়ে আবুল হুসেন, আবুল ফজল, কাজী আবদুল ওদুদসহ শিখাগোষ্ঠীর লেখকরা নাস্তিক খেতাব পেয়েছেন। লিখতে গিয়ে নাস্তিক আখ্যা পেয়ে হুমায়ুন আজাদ, নাগিব মাহফুজ, সালমান রুশদি কোপ খেয়েছেন যার প্রতিক্রিয়ায় প্রথম দুজন মৃত্যুবরণ করেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের প্রধান কবি হয়ে ওঠা শামসুর রাহমানকেও নাস্তিক বলা হতো। তাকে সিলেটে প্রতিহতের ডাক দেয়া হয়। শহীদুল জহির, দাউদ হায়দার, রফিক আজাদ, আহমদ শরীফ, জাফর ইকবাল, আরজ আলী মাতুব্বর ইত্যাদি অসংখ্য নাম নেয়া যায়। হুমায়ূন আহমেদ শুরুতে নাস্তিক থাকলেও পরে সংশয়বাদী হিসেবে নিজেকে দাবী করলেও অনেকে তাকে নাস্তিক বলতেন।
ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ নাস্তিক, তাঁর পুত্র মুর্তুজা বশির নাস্তিক, নাতনী গীতি আরা সাফিয়া চৌধুরী নাস্তিক; সুফিয়া কামাল নাস্তিক, তার কন্যা সুলতানা কামাল নাস্তিক, বেগম রোকেয়া নাস্তিক, তসলিমা নাসরিন নাস্তিক...যদি কবি-লেখক কাউকেই নাস্তিক বলা থেকে রেহাই না দেয়া হয় তাহলে তার পরিণতি কী হবে? লেখকদের মূল কাজই তো নতুন কিছু বলা, নতুন শিকওয়া তথা প্রশ্ন তোলা—যার সব জবাব তিনি দিবেন না—রাখবেন পাঠকের জন্যও৷ প্রশ্ন তোলাই যদি অসম্ভব করে দেয়া হয় তাহলে লেখকগণ ভাবনা প্রকাশ করবেন কীভাবে?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন