আমি বই পড়ছিলাম, আমার চার বছরের ছোট্ট মেয়েটা বারান্দায় খেলনা হাঁড়িপাতিলে রান্না করছে। হঠাৎ দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করল, বাবা, চা খাবে?
চা খাবার বদ অভ্যেসটা আমার বেশ পুরনো! আমি ওর খেলনার বাটিতে চুমুক দিয়ে তৃপ্তি পাবার অভিনয় করে বললাম, খুব ভালো হয়েছে মা।
- আর এককাপ খাবে?
- না মা! আমি পড়াশোনা করছি।
- তাইলে নিডো খাও! শক্তি হবে!
আমি ওর দিকে তাকালাম। আমাকে নিয়ে এমন চিন্তিত চেহারায় আমার গর্ভধারিণী মায়ের পর আর কাউকে দেখেছি বলে মনে পড়ে না! হাত বাড়িয়ে বুকে টেনে নিলাম। ঘাড়ে মাথা দিয়ে ও চুপ করে শুয়ে আছে, ওর মাথার ঘ্রাণটা আমার চোখে পানি এনে দিচ্ছে! আহা মা! আহা বন্ধন! মাঝে মাঝেই আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। সব কন্যার বাবাই হয়তো আমার মতো লুকিয়ে কাঁদে।
আমার বিয়ের সময় বিদায়বেলায় আমার শ্বশুর তার মেয়েকে বুকে জড়িয়ে কেঁদেছিলেন। আমার হাত চেপে ধরে বলেছিলেন, মেয়েটা আমার বড্ডো আদরের, ও কোনো ভুল করলে আমাকে বলবে বাবা, বকাঝকা করো না।
আমিও সুবোধ বালকের মতো মাথা নেড়ে বলেছিলাম, অবশ্যই বাবা!
আমি ওয়াদা রাখিনি। সংসার জীবনের পথ পরিক্রমায় আমি আরেকজনের কন্যাকে কাঁদিয়েছি, বকাঝকাও করেছি! আমি জানি আমার স্ত্রী এগুলো মনে রাখে না। সে এখন একমাত্র আমার সংসার নিয়েই চিন্তিত, এর বাইরে তার মাথায় কিছু কাজ করে না! তার বাবার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে সে তৈরি করেছে আলাদা এক বৃত্তের বলয়। সেই বৃত্তের কেন্দ্রে শুধুই আমার দুই সন্তান আর প্রচন্ড ব্যস্ত আমি। তার পৃথিবীটা আজ শুধুমাত্র আমাদেরকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। ভাবলে অবাক লাগে, কী আত্মত্যাগটাই না একজন নারী করে তার সংসারের জন্য!
আমার ছোট্ট মেয়েটাও একদিন হয়তো আমাকে কাঁদিয়ে আরেক বৃত্তে চলে যাবে! আমাকেও হয়তো আরেক যুবকের হাত ধরে সেই একই কথার পুণরাবৃত্তিই করতে হবে! আমি চাই না আমার ব্যর্থতা আমার কন্যাসন্তানকে স্পর্শ করুক! আমি ক্ষমাপ্রার্থী আর অনুতপ্ত কথা রাখতে না পারার জন্য।
কন্যার পিতা হওয়া অনেক কষ্টের। কতটুকু কষ্টের সেটা কন্যাসন্তানের পিতা হবার পূর্বে অনুভূত হয় না। আমার চোখের কোণায় পানি গাঢ় হচ্ছে, আমার ছোট্ট মেয়েটা খুবই অস্থির হয়ে উঠেছে, ভ্রু কুঁচকে পড়ার চেষ্টা করছে এক অপরাধীর জবানবন্দি। ওর চোখেও জল! কি জানি! মেয়েরাই হয়তো বাবার অনুভূতি পড়তে পারে, সৃষ্টিকর্তা মেয়েদেরকে বাবার অনুভূতি পড়তে পারার এক অদ্ভুত শক্তি দিয়েই পৃথিবীতে পাঠান।
একজন বাবা তার সন্তানের কাছে কেমন, তা নির্ভর করে তিনি স্বামী হিসেবে তার স্ত্রীর সাথে কেমন আচরণ করছেন তার উপর। সন্তানেরা মায়ের চোখ দিয়েই বাবাকে দেখে। একজন স্ত্রী তার স্বামীকে শ্রদ্ধা করলে, ভালবাসলে, সন্তানেরাও বাবাকে ভালবাসতে শেখে, শ্রদ্ধা করে। একজন স্ত্রী তার স্বামীকে ঘৃণা করলে, সন্তানেরাও তাদের বাবাকে আজীবন ঘৃণার চোখে দেখে।
বাবাদের মূল্যায়ন তার নিজের কাজ দিয়ে হয় না। বরং, মা কিভাবে বাবাকে সন্তানদের সামনে উপস্থাপন করছেন তার আলোকেই নির্ধারিত হয়। সন্তানেরা মায়ের চোখ দিয়েই বুঝে নেয়, বাবা কি হিরো নাকি ভিলেন। তাই, একজন ভাল বাবা হওয়ার আগে, একজন ভাল স্বামী হওয়া খুব জরুরী।