অনন্য অসাধারণ এক মায়ের গল্প :
""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""
আমার মা। সত্তরের দশকে পিএইচডি করেছেন বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় Imperial College London থেকে, কঠিন পদার্থবিজ্ঞানের ততোধিক কঠিন শাখা Theoretical Physics-এ।
*
ম্যাট্রিকে গণিতে সেরা নাম্বার পেয়ে স্ট্যান্ড করেছেন, ইন্টারমিডিয়েটে সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম হয়েছেন। পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে সেরা ফলাফল করে মেরিট স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাজ্যে পিএইচডি করতে গেছেন। সেখানে অত্যন্ত গণিত-ঘন পিএইচডি-প্রস্তুতি পরীক্ষায় বাঘা বাঘা ছাত্রদেরকে পেছনে ফেলে ক্লাস-টপার হয়েছেন। পিএইচডি করেছেন P T Matthews (অতি-পরিচিত কোয়ান্টাম মেকানিক্স পাঠ্য-বইয়ের লেখক) এর তত্ত্বাবধানে। দেশে ফিরে alma mater রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেছেন। ভালো শিক্ষক ও তেজস্বী মহিলা হিসেবে তাঁর ছাত্ররা এখনও তাঁকে স্মরণ করে।
*
অতঃপর এক সময় আমি হলাম। কন্যাকে ঘিরে আমার মায়ের জীবনের আবর্তন শুরু হলো। সদা সতর্ক, যত্নশীল মা হিসেবে তাঁর জীবনের এক নতুন অধ্যায়। আমি বড় হতে হতে ছোট্ট একটি বোন হলো আমার। আমরা দুই বোন ছিলাম আম্মার জগৎ।
*
বিয়ের আগে আম্মা কোন রান্নাই জানতেন না। বিয়ের পর একদম নিজে নিজে শেখার শুরু (তখন তো আর ইউটিউব ছিল না!)। গণিতে দীপ্ত মাথার সাথে এবার যুক্ত হলো রান্নার আর্টে সুনিপুণ, স্বশিক্ষিত হাত। অসাধারণ রাঁধুনি, রান্না করেছেন সব নিজস্ব রেসিপিতে, মানুষের ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছেন। নতুন নতুন অজানা কত পদ খাইয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। সেই তিরিশ বছর আগে, জন্মদিনের কেইক নিজে আইসিং করতেন। সারাবছর আমরা বাড়িতে বানানো টমেটোর সস খেয়েছি। সাত থেকে দশ রকমের আচারের বয়াম রোদে দেয়া থাকতো বারান্দা জুড়ে। আর শিখিয়েছেন মানুষকে। যেখানেই থেকেছেন, চারপাশের অনেক নারী তাঁর কাছে বিবিধ রান্নার তালিম নিয়েছেন। টক-ঝাল-মিষ্টি, কোন কিছুই বাদ যায়নি। আম্মা বুঝিয়ে দিতেন খুব যত্ন করে, সমস্ত খুঁটিনাটি টিপসসহ। জাত-শিক্ষক!
*
ম্যাথমেটিক্যাল ব্রেইন সব জায়গায় তার ছাপ রেখেছে। নিত্য-নতুন, নিজস্ব কত ডিযাইনের যে জামা পরেছি দুই বোন! সব আম্মার বানানো। আমার বান্ধবীরা আজও উল্লেখ করে। উলের সেলাই, আক্ষরিকভাবেই শত শত! প্রতি বছর শীতে বসতো আম্মার উল বোনার হাট। আমরা দুই বোন ও তাঁর নাতনিরা তো বটেই, আত্মীয়-প্রতিবেশী-বন্ধু বাদ যায়নি। তাঁর শ্বশুরবাড়ির মানুষ থেকে শুরু করে আমার শ্বশুরবাড়ি পর্যন্ত। নিজস্ব ডিযাইনের প্রত্যেকটা হতো একেকটা মাস্টারপিস। আবার বই থেকে একটা ডিযাইন দেখে তারপর নিজের মাথায় হিসাবনিকাশ করে ভিন্নতা নিয়ে আসতেও বহুবার দেখেছি। আম্মার কাছ থেকে উলের সেলাই বুঝে নিয়েছেন কতজন!
*
নানারকম চুলের স্টাইল করতে জানতেন। আমার বিয়ের খোঁপা আম্মার হাতের।
*
সবচেয়ে বিস্ময়কর ছিল আম্মার একসাথে নানা কাজ সামাল দেয়ার দক্ষতা…. a true multitasking wonder! আমার বোনকে খাওয়াতে খাওয়াতে তাঁকে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের লেকচার তৈরি করতে দেখেছি। আমাদের সাথে টিভি দেখতে দেখতে জটিল উলের সোয়েটার বুনেছেন। রাত দুইটার সময় একশ চমচম বানিয়েছেন, পরেরদিন দাওয়াতের জন্য। আব্বা ও পারিবারিক বন্ধুদের সাথে বসে সমান দাপটে Scrabble খেলেছেন। দুই দানের মাঝে উঠে গিয়ে রান্না দেখে আসতেন।
*
শুক্রবারে জুম্মার নামাজের জন্য আব্বার পাঞ্জাবী ইস্ত্রি করছেন আম্মা, এই দৃশ্য চোখে ভাসে।
*
আমার মা। A complete woman!
✍️লেখকঃ Raihana Shams Islam
Alumni, University of Rajshahi, University of Cambridge
(সংগৃহীত)