॥ মনে করো আমি নেই... ॥
তখন আমি বারো কি পনেরো,
ইন্টারনেট, ইউটিউব, ফেসবুক এইসব তো দূর অস্ত, বাড়িতে টিভিও ছিল না। আর প্রত্যন্ত গ্রামে বাড়ি হওয়ার দরুন তখনও ইলেকট্রিসিটি আসেনি। একান্নবর্তী পরিবার ছিল আমাদের। সন্ধ্যা নামলেই হ্যারিকেন লন্ঠনের আলোয় গোল হয়ে বসে পড়াশোনা, আড্ডা, বিনোদন সবই চলত। আর ছিল প্রানের সঙ্গী– এক বিশাল কাঠের বাক্সওয়ালা রেডিও।
এমনই এক সন্ধ্যায় বাবা, মা, পিসি, কাকা, কাকীমা সবাই মিলে বসে সান্ধ্য চা সহযোগে শোনা হচ্ছে রেডিও।
ঘড়িতে (সম্ভবতঃ) ৫:৪৫, বিবিধ ভারতী তে ঘোষণা হল– আকাশবাণী কলকাতা, বিবিধ ভারতী প্রচার তরঙ্গের অনুষ্ঠান শুনছেন ২২৬.৭ মিটারে অর্থাৎ ১৩২৩ কিলো হার্জ এ। শুরু হচ্ছে বিজ্ঞাপনদাতা দ্বারা আয়োজিত অনুষ্ঠান– “মনের মতো গান”।
অতঃপর ঘোষণা— আজকের অনুষ্ঠানের প্রথম গানটি শুনতে চেয়ে অনুরোধ পাঠিয়েছেন- এই বলে, ঠিকানা সহ বাবার নাম এবং তারপর একে একে আমাদের সবার নাম। বাবা-ই চিঠি টা লিখেছিল গানটা শুনতে চেয়ে। বাবা তো খুশিতে আত্মহারা। হবারই কথা! প্রায় বছরখানেক ট্রাই করার পর নিজের অনুরোধের গান নাম-ঠিকানা সহ রেডিওতে, তাও আবার একেবারে শুরুতেই। এ যেন ঠিক লটারি লাগার মতো খুশি। তখনকার আনন্দগুলোই অন্য ধরনের ছিল। আজকের ইন্টারনেটের যুগে যা কল্পনাতীত।
যাইহোক, তারপর বেজে উঠল সেই গান—
“মনে করো আমি নেই,
বসন্ত এসে গেছে..
কৃষ্ণচূড়ার বন্যায়,
চৈতালী ভেসে গেছে...”
গানের শিল্পীর নাম শুনে সেদিনের আমি অবাক হয়ে বাবাকে বললাম – ওই দ্যাখো বাবা, এটা তো লতা মঙ্গেশকরের গান, ওরা বোধহয় ভুল করে সুমন কল্যাণপুর বলল।
তখন বাবা বলল— না রে, এটা সুমন কল্যাণপুর এরই গান। ওর গলাটাই লতার মতো।
বড় হতে হতে শিল্পীর আরো কিছু গান শুনলাম। চিনলাম শিল্পীকে। সুমন কল্যাণপুর। যাঁর কণ্ঠের ভীষণ মিল ছিল লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে।
এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাও তাঁর গান শোনে, পছন্দ করে, কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি, বেশিরভাগই লতা মঙ্গেশকরের গান ভেবেই শোনে।
গতকাল পেরিয়ে এলাম শিল্পীর জন্মদিন। তবে পোস্ট টা লিখতে লিখতে অনেক রাত হয়ে যাওয়ায় পোস্ট করা হয়ে ওঠেনি। আজ করলাম।
হ্যাঁ যেকথা বলছিলাম, লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে তাঁর কন্ঠের অদ্ভুত মিল। আর ঠিক এটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় তাঁর কেরিয়ারের ক্ষেত্রে। তাই তিনি আজকে প্রায় অচেনা।
আধুনিক বাংলা গান, বাংলা ছায়াছবির গান অনেক গাইলেও সুমন কল্যাণপুর আদতে বাঙালি নন। কিন্তু তিনি তাঁর কয়েকটি গান দিয়েই বাঙালিদের বড্ড আপন ছিলেন।
সেসময় রেডিও আর রেকর্ডের যুগে সুমন কল্যাণপুরের গান শুনলে আমার মতো প্রায় সব শ্রোতারাই বিভ্রান্ত হয়ে যেতেন তাঁর গাওয়া গান শুনে। ভাবতেন– এটা তো লতা মঙ্গেশকরের গলা।
এই "Identity crisis" যে কতখানি অস্বস্তির কারণ একজন শিল্পীর কাছে, তা বোধহয় বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই এই বিভ্রান্তি শুধু শ্রোতাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, সুমনের জীবনের বড় একটা অংশকে আচ্ছন্ন করেছিল। রেডিওতে সুমনের গান বাজানোর পরে অনেক সময় তাঁর নাম ঘোষণা করা হতো না। এমনকি শুরুর দিকে রেকর্ডেও তাঁর নাম দেওয়া হতো না।
লতার কণ্ঠস্বরের সঙ্গে মিল থাকায় সুমনকে প্রায়শই তাঁর ছায়ার মতো বাঁচতে হয়েছে। অথচ, এটা সুমনের লতা-কণ্ঠের অনুকরণ নয়, বরং লতাকে অনুসরণ করেই সুমনের সংগীতযাত্রা শুরু। কলেজজীবনে তিনি লতার গান গেয়ে চমকে দিতেন সবাইকে।
বলুন তো, ঈশ্বর একরকম কন্ঠ উপহার দিলে তাঁর কি দোষ?
সুমনের কণ্ঠে যেমন ছিল অসামান্য সুরেলা গভীরতা, তেমনি বাংলা, হিন্দি, তামিল—সব ভাষাতেই ছিল তাঁর স্পষ্ট উচ্চারণ। সংগীত পরিচালকরাও বুঝেছিলেন, এই গুণগুলো তাঁকে প্লেব্যাকের জন্য আদর্শ করে তুলেছে। তবু পঞ্চাশ-ষাটের দশকে লতা মঙ্গেশকর এবং আশা ভোঁসলের মতো তারকার দাপটে সুমন কল্যাণপুরকে প্রায়শই সংগীত পরিচালকদের “থার্ড চয়েস” হয়ে থাকতে হয়েছে। যখন কোনও গান রেকর্ডিংয়ে লতা সময় দিতে পারতেন না বা প্রযোজকদের বাজেট লতার পারিশ্রমিক সামলাতে পারত না, তখনই সুমন কল্যাণপুরের ডাক পড়ত।
তবে সবসময় এমন ছিল না। কিছু সময়ের জন্য সুমন কল্যাণপুর মহম্মদ রফির সঙ্গে একের পর এক ডুয়েট গেয়ে নিজের আলাদা অবস্থান তৈরি করেছিলেন।
লতা এবং রফির মধ্যে রয়্যালটি বিতর্ক চলাকালীন, রফির সঙ্গে লতার পরিবর্তে গান গাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন সুমন। ১৪০টিরও বেশি ডুয়েট গান রয়েছে এই জুটির...
“আজকাল তেরে মেরে পেয়ার কে চর্চে”,
“তুমনে পুকারা অউর হাম চলে আয়ে”,
“না না করতে প্যার তুম্হি সে কর ব্যাঠে”,
“দিল নে ফির ইয়াদ কিয়া”,
“ইতনা হ্যায় তুমসে প্যার মুঝে”,
“অ্যায়সে তো না দেখো”
মান্না দে-র সঙ্গে—
“না জানে কাঁহা তুম থে”
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (হেমন্ত কুমার) এর সঙ্গে—
“তুম্হি মেরে মিত হো”
মুকেশ এর সঙ্গে—
“ইয়ে কিসনে গীত ছেড়া”
আবার শিল্পীর একক কন্ঠে —
“না তুম হামে জানো”
“প্যাহলা প্যাহলা প্যার”
— এমনই অনেক চিরন্তন গান আজও সুমনের চিরসবুজ কণ্ঠস্বরের সাক্ষী।
সুমন কল্যাণপুরের জন্ম ১৯৩৭ সালের ২৮ জানুয়ারি, অবিভক্ত বাংলার ঢাকা শহরে। তবে তাঁর পূর্বপুরুষরা কর্নাটকের উদুপি জেলার হেমাদি গ্রামের বাসিন্দা। সুমনের পিতা শঙ্কর রাও হেমাদি ছিলেন সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার উচ্চপদস্থ কর্মচারী। ১৯৪৩ সালে চাকরিসূত্রে তাঁদের পরিবার মুম্বাইয়ে (তখনকার বম্বে) চলে আসে। দক্ষিণ ভারতীয় শিকড়, বাংলা ও হিন্দির প্রতি দখল, এবং গানের প্রতি ভালোবাসায় ভর করে মুম্বাইয়ের পরিবেশে বেড়ে ওঠেন সুমন।
মুম্বাইয়ের কলম্বিয়া হাইস্কুলে পড়াশোনা চলাকালীনই গানের তালিম নিতে শুরু করেন সুমন। একদিকে গান, অন্যদিকে ছবি আঁকায় তাঁর ছিল অসাধারণ দক্ষতা। জেজে স্কুল অফ আর্টসে ভর্তি হওয়া এই প্রতিভাবান শিল্পী কিশোরীবেলায় প্রখ্যাত সংগীত পরিচালক কেশব রাও ভোলের নজরে আসেন। তিনিই সুমনকে প্লেব্যাকের দিকনির্দেশনা দেন। সুমনের কণ্ঠে ছিল এমন এক মাধুর্য, যা তাঁকে ক্লাসিক্যাল গান ছেড়ে আধুনিক ও প্লেব্যাকের জন্য আরও বেশি উপযুক্ত করে তুলেছিল।
১৯৫৪ সালে 'মঙ্গু' ছবিতে সুমন কল্যাণপুরের প্লেব্যাক যাত্রা শুরু হয়। এরপর 'দরওয়াজা' ছবিতে তালাত মাহমুদের সঙ্গে তাঁর গান জনপ্রিয়তা পায়। শঙ্কর-জয়কিষণ, শচীনদেব বর্মণ, মদনমোহন, নৌশাদ—সব বড় সংগীত পরিচালকের সঙ্গেই কাজ করেছেন সুমন।
সুমনের বিয়ে হয় মুম্বাইয়ের ব্যবসায়ী রামানন্দ কল্যাণপুরের সঙ্গে। সুমনের কেরিয়ারের অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক ছিল তাঁর স্বামীর সমর্থন। তিনি সব রেকর্ডিংয়ে স্ত্রীকে নিয়ে যেতেন, যাতে সংগীতজীবনে কোনও বাধা না আসে।
বাংলা সংগীত জগতেও সুমন কল্যাণপুর একটি বিশেষ নাম।
“আমার স্বপ্ন দেখা দুটি নয়ন”
কিংবা
“মনে করো আমি নেই, বসন্ত এসে গেছে”
তারপর
“কাঁদে কেন মন আজ কেউ জানে না”
গানগুলো আজও আমাদের মনে দোলা দেয়।
আঁধার আকাশে মেঘের ডাকে আজও মন গেয়ে ওঠে —
“বাদলের মাদল বাজে গুরু গুরু...”
কিংবা, কোনো স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় জর্জরিত এক নিঃসঙ্গ হৃদয়ের আবেগময় জীবন্ত প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে—
“শুধু স্বপ্ন নিয়ে খেলা চলেছে...”
বাংলার নিখাদ সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে যা এযুগেও সমান প্রাসঙ্গিক, জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় থেকে মান্না দে—সবাই সুমনের প্রতিভার স্বীকৃতি দিয়েছেন।
লতার কণ্ঠস্বরের সঙ্গে মিল থাকার কারণে সুমন কল্যাণপুরকে প্রায়শই আড়ালে পড়তে হয়েছে। তবু তাঁর কণ্ঠে যে মাধুর্য ছিল, তা আজও বহু শ্রোতার মনে গেঁথে আছে।
‘মনিহার’ ছবির–
“দূরে থেকো না, আরো কাছে এসো”-র মতো আবেদনময়ী গানে যেমন শ্রোতারা রোমাঞ্চিত হয়েছে,
তেমনই ‘কৃষ্ণ সুদামা’ ছবির–
“তোরা হাত ধর প্রতিজ্ঞা কর” গানটি বন্ধুত্বের চিরন্তন প্রতীক হয়ে থেকে গেছে।
আজ সুমন কল্যাণপুর নব্বই ছুঁই ছুঁই।
তবে এত অবহেলা সত্ত্বেও জীবনের প্রতি তাঁর কোনও আক্ষেপ নেই। মেয়ে চারুল অগ্নি আমেরিকাবাসী হলেও তাঁর নাতনি ভারতে এসে সুমনের নামে একটি এনজিও খুলেছেন।
সঙ্গীতের বাইরে সুমন কল্যাণপুর চিত্রাঙ্কন, বাগান করা, বুনন ও রান্নায় আগ্রহী। তিনি বিভিন্ন সময়ে দেশ-বিদেশে সঙ্গীতানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন এবং তাঁর সুরেলা কণ্ঠের মাধ্যমে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছেন।
তাঁর সঙ্গীত জীবনের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ২০০৯ সালে মহারাষ্ট্র সরকারের লতা মঙ্গেশকর পুরস্কার, ২০১৫ সালে গদিমা পুরস্কার এবং ২০২২ সালে মির্চি মিউজিক লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। ২০২৩ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত করে।
সুমন কল্যাণপুরের সঙ্গীত জগতের অবদান ও তাঁর সুমধুর কণ্ঠস্বর সঙ্গীতপ্রেমীদের হৃদয়ে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে। সারাটা জীবন তিনি নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তবুও শ্রোতাদের বিভ্রান্তি যেন তাঁকে চিরকাল একপ্রকার ব্রাত্য করেই রেখেছে বলা যায়।
তাঁর গাওয়া সেই গানগুলোই যেন তাঁর জীবনের গল্প বলে—
“আমার স্বপ্ন দেখা দুটি নয়ন
হারিয়ে গেল কোথায় কখন,
কেউ তা জানে না।”
______________________
লেখক: ©️ কিছু কথা ॥ কিছু সুর।
তথ্য সংগ্রহ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার: The Wall (শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়), Bharat Discovery, Biography pot, Kafal Tree, Saregama, Gaane Sune Ansune.
______________________________________
এই লেখা, অথবা লেখা থেকে কোনো অংশ নিলে লেখকের নামসহ তথ্যসূত্র উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক।