আমার শালিকা রুমির বিয়ে হবার পর থেকে আমার কেন যেন মনে হচ্ছে শ্বশুর আব্বা আমাকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না। এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমি আসল রহস্যটা উদঘাটন করতে পারি রুমির স্বামীর অর্থবিত্ত দ্বারা। কেননা আমি পেশায় একজন সাধারণ হাই স্কুলের শিক্ষক হলেও রুমির স্বামী পেশায় একজন সরকারী ব্যাংকের কর্মকর্তা।
আমার স্ত্রীও বোনের এমন বড় ব্যক্তিত্বের সাথে বিয়ে হওয়ার পর থেকে হিংসায় জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে এবং মাঝেমধ্যেই আমাকে আমার অবস্থান নিয়ে হেয় করতে ভুলে না। নারীদের এমন বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আমি আগে থেকেই অবগত হওয়াতে আমার স্ত্রীর এরকম ব্যবহারে আমি কিছু মনে করিনা। সেদিন সুমি অর্থাৎ আমার স্ত্রী কিছুটা আফসোসের স্বরেই আমার পাশে বসে বলে উঠলো,
"কেবল আমিই তোমার সাথে এই কুড়েঘরে সংসার করলাম, অন্য কোনো মেয়ে হলে দুদিনও থাকতো না। আমার বোনটা যে স্বর্ণ কপাল নিয়ে জন্মেছিল সেটা ওর শ্বশুরবাড়ি দেখলেই বোঝা যায়। আর আমি জন্মেছিলাম এই পোড়া কপাল নিয়ে।"
সুমির কথা শুনে আমি শুধু মুচকি হাসি কিন্তু কিছুই বলিনা। কারণ মেয়েদের আকাঙ্ক্ষার কোনো শেষ নেই, তাদের যত দেওয়া হবে ততই তারা আফসোসের সাগরে হাবুডুবু খাবে, হয়তো সব মেয়ে এক নাও হতে পারে।
রুমির বিয়ের দুমাস পর শীতের ছুটিতে শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। আমাদের পাশাপাশি রুমির স্বামীসহ ওদের শ্বশুর বাড়ি থেকেও অনেক মেহমান এসেছে শীতের আমেজটা উপভোগ করার জন্য। এত এত মেহমানের খাবার দাবার রান্নার দায়িত্বটা আমার স্ত্রী এবং শাশুড়ি আম্মা বেশ খুশি মনেই সম্পাদন করছেন। কিছুক্ষণ পরপরই আমার শাশুড়ি এসে তার ছোট মেয়ে জামাইকে এটা ওটা জিজ্ঞেস করছেন যে কিছু লাগবে কিনা? অথচ আমি এবাড়িতে আসার পর আমার দিকে একবারের জন্য মুখ ফিরিয়ে তাকিয়েছেন কিনা তা সন্দেহ! তবুও মনকে এই বলে বুঝ দিচ্ছি যে, নতুন জামাইয়ের প্রতি এটুকু কদরতো থাকবেই। আর আমিতো এই বাড়ির পুরোনো সদস্য, পুরাতন দের বেশি আপ্যায়ন না করলেও হয়। এসব বলে মনকে সান্ত্বনা দেওয়ার মাঝেই আমার শ্বশুর আব্বা পুনরায় আগুনে ঘি ঢালা রূপে আবির্ভাব হলেন। তিনি বাজার থেকে তার ছোট জামাইয়ের পছন্দের সকল কিছুই কিনে এনেছেন এবং আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে তিনি সবার সামনেই রুমির স্বামীর ব্যপারে গুনগান গাইছেন। তিনি ভেবেছিলেন এতে হয়তো আমি ঈর্ষান্বিত হবো কিন্তু আমিতো আর এতো সহজেই ভেঙ্গে যাওয়ার পাত্র নই।
এরপর কেঁটে যায় আরো ছয়মাস, কিন্তু সবচেয়ে অবাক করা ব্যপার হলো এই ছয়মাসে আমার শ্বশুর বাড়ি থেকে কেউই আগবাড়িয়ে কল দিয়ে আমার খোঁজখবর নেয়নি। অথচ রুমির বিয়ের আগে আমার শ্বশুর সামান্য কোনো সমস্যার মুখোমুখি হলেও আমার কাছে কল দিয়ে উপদেশ গ্রহণ করতেন নয়তো সাহায্য চাইতেন। আমিও কখনোই তাদেরকে কোনো কাজে অসম্মতি জানিয়ে নিরাশ করতাম না। তবে সুমির সাথে তারা নিয়মিতই কথা বলেন কেননা মেয়ের সাথে কি কথা না বলে থাকা যায়?
বোঝাই যাচ্ছে আমার শ্বশুর আব্বা আমার থেকেও রুমির স্বামীকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।
আজ বাসায় ফেরার পর হঠাৎই সুমি বেশ উৎকন্ঠা নিয়ে আমার পাশে বসলো। খারাপ কোনো সংবাদ ব্যতীত সচরাচর ওর এমন উৎকন্ঠা দেখা যায় না। কৌতূহল বসত জিজ্ঞেস করলাম,
"কি হলো তোমার? এমন চিন্তিত মুখে বসে আছো কেন?"
"না আসলে আজ মা কল দিয়েছিল। বললো রুমি নাকি ওর স্বামীর সাথে আর ঘর করতে চায় না। মা হাজারবার বুঝিয়েছে কিন্তু ওতো নাছোরবান্দা।"
আমি অবাক নয়নে সুমির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
"এতো ভালো ঘরে ওর বিয়ে হলো এমনকি ওর স্বামীও একজন সরকারী চাকুরিজীবী তাহলে কি কারণে ও সংসার ছাড়তে চায়? তোমার মতো অভাবে তো আর নেই। তুমিতো আমার মতো এই গরীবের ঘরেও সংসার করে চলেছো।"
আমার কথায় সুমি বেশ ইতঃস্তত ভঙ্গিতে বললো,
"ধুর এসব কথা ছাড়ো এখন। আর কারণটা আমিও ঠিক জানিনা। তুমি একটু বাবাকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস কইরো।"
আমি আর কিছু না বলে গোসলের প্রস্তুতি নিতে চলে গেলাম।
এর কিছুদিন পর হঠাৎই রুমি ওর শ্বশুর বাড়ি ছেড়ে চলে আসে। মূলত সবার অজান্তেই রুমির স্বামী অন্যত্র এক মেয়েকে বিয়ে করে। আর এই বিষয়টা রুমির পাশাপাশি আমার শ্বশুর শাশুড়িও মেনে নিতে পারেননি। কারণ যেই মেয়ে জামাইকে তারা এত আদর আপ্যায়ন করেছেন সেই লোকই আজ তাদের মেয়েকে ধোঁকা দিয়ে অন্যত্র বিয়ে করেছে, এটা কোনো বাবা মা'ই হয়তো মেনে নিতে পারবে না।
রুমি ওর স্বামীকে ডিভোর্স দেওয়ার কিছুদিন পরই আমি সুমিকে নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে আসি। আমার শ্বশুর আমাকে দেখে কোনো এক অজানা কারণে মুখ লুকাচ্ছেন। এর পিছনের গল্পটা আমি জানলেও তখন প্রকাশ করলাম না।
রাতে যখন সুমি আর আমি ঘুমানোর প্রস্তুতি নিবো তখন হঠাৎই আমার স্ত্রী বেশ চিন্তিত মুখে বলে ওঠে,
"আমার বোনটার সাথে কেন যে এমন হলো বুঝতে পারছি না। ওর ভাগ্যটা আসলেই খারাপ।"
আমি সামান্য মুচকি হেসে বললাম,
"ওতো স্বর্ণের কপাল নিয়ে জন্মেছিল তাই হয়তো এরকম হলো। আর তুমিতো জন্মেছিলে পোড়াকপাল নিয়ে তাই হয়তো এখনও তোমার জীবনে কোনো দূর্ঘটনা ঘটেনি।"
আমার কথা শুনে স্বভাবতই আমার স্ত্রী মুখে কুলুপ এঁটে চুপ করে রইল। কারণ এমন বাক্যের প্রতিউত্তরে কিছু বলার মতো বাক্য তার মুখে অবশিষ্ট থাকার কথা নয়। এটাই হয়তো এক অন্য রকম মধুর প্রতিশোধ।
(সমাপ্ত)
ফেইসবুক থেকে কপি করা
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন