জাল হাদীস বিষয়ক চলমান বিতর্কে অধমের শেষ কৈফিয়ত!
যুগে যুগে আল্লাহর অনেক ওলীদের মাধ্যমে জাল হাদীস সমাজে ছড়িয়েছে। মানুষকে হেদায়াতের পথে আনার মানসেও অনেক আল্লাহর ওলীরা জাল হাদীস বানাতেন। নিজের হেকমতের কথাকে হাদীস নামে চালিয়ে দিতেন।
উদ্দেশ্য তাদের খারাপ ছিল না। কিন্তু পদ্ধতি গলদ ছিল।
যুগের উলামাগণ সেসব হাদীস নামে বানোয়াট কথাকে চিহ্নিত করে নবীজীর পবিত্র কথাকে ব্যক্তির বানোয়াট কথার আবর্জনা থেকে হেফাজত করেছেন।
সন্দেহ নেই। আমি একজন কম ইলমওয়ালা মানুষ। ভালো যোগ্যতাও নেই। কিন্তু ফারেগ হবার পর থেকে নিজের জাহালাত দূরিকরণে মেহনতের চেষ্টা করেছি। এখনো চেষ্টা করছি। আমি পেরেছি কিংবা পারছি এটা বলার মতো ক্ষমতা আমার নেই। আমি আসলে এখনো পর্যন্ত মৌলিক কোন কাজ করতে পারিনি। সেই যোগ্যতাই আমার নেই। আমি কেবল বড়দের কথাগুলো নকল করি। এতোটুকুই আমার কাজ।
মাওলানা নজরুল ইসলাম কাসেমী সাহেবকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। কয়েক বছর ধরে তিনি অনলাইনে অনেক পপুলার মানুষ। বেশ কিছু মাহফিলে হযরতের সাথে দেখাও হয়েছে। সামান্য কথাও হয়েছে।
হযরতের বয়ানের বিষয়ে সন্দেহ আমার প্রথম থেকেই। এমন আজগুবী সব কথা বলেন। যা শুনতে যে কোন আহলে ইলমের সন্দেহ হবেই।
আমিতো আর আহলে ইলম নই। ছাত্র মানুষ। কিন্তু আমার তালেবানা জেহেনেও হযরতের কথাগুলো আটকে যেতো। এসব কী বলেন? এমন কথাতো জীবনেও শুনিনি।
হযরতের বয়ান হঠাৎ করেই সেদিন আমাকে একজন পাঠায়। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মবৃত্তান্ত সম্পর্কে। শুনতে বসলাম। ইন্নালিল্লাহ। আমার মতো অজ্ঞ মানুষটাও স্তব্ধ হয়ে গেলাম হযরতের জাল হাদীসের ফিরিস্তি দেখে।
আমি জানি তিনি দাওয়াতও তাবলীগে সময় লাগান। আমি নালায়েকও মাঝে মাঝে সময় দেবার চেষ্টা করি। এ কারণে আমি ভালো করেই জানি যে, দাওয়াত ও তাবলীগের ভাইরা উলামায়ে কেরামের বয়ান কী পরিমাণ মনোযোগ সহকারে শুনেন। এবং কিভাবে হরফ ব হরফ মুখস্ত করেন।
আমি ব্যক্তিগতভাবে বেশ কয়েকজন তাবলীগের সাথীকে জানি, যারা হযরতের কথাকে চাতকের মতো গ্রহণ করেন। গোগ্রাসে গিলেন। নিজের বয়ানে গর্বের সাথে ‘মাওলানা নজরুল ইসলাম কাসেমী সাহেব বলেছেন’ বলে রেফারেন্স দিয়ে থাকেন।
কাসেমী সাহেবের বয়ান দেখে আমি আঁতকে উঠলাম। এই যে বছরের পর বছর ধরে তিনি এভাবে নবীর নামে জাল কথা বলে আসছেন। ইউটিউবে শত শত ভিডিও আপলোড হচ্ছে। লাখ লাখ ভিউ হচ্ছে। কত শত হাজারো মানুষ এভাবে বানোয়াট কথাগুলোকে নবীর কথা বলে বিশ্বাস করছে। কী হবে এদের? এতো নতুন এক সাদপন্থী ফেতনা জন্ম লাভ করছে!
একটু খবর নিতে শুরু করলাম। এমন ভয়াবহ জাল বর্ণনা বলার পরও কিভাবে তিনি বছরের পর বছর বয়ান করে যাচ্ছেন। আমাদের দেশে কি উলামাগণ নেই, যারা হযরতকে দরদের সাথে এ বিষয়ে সতর্ক করবেন?
খোঁজ নিয়ে জানলাম। আরো ভয়ানক তথ্য। হযরতকে কয়েক বছর ধরেই একাধিক বিজ্ঞ উলামাগণ এ বিষয়ে সতর্ক করেছেন। সরাসরি করেছেন। কিন্তু তিনি কাউকে পাত্তা দেননি। কিতাবে আছে বলে এড়িয়ে গেছেন।
তারপরও আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে কয়েকবার ফোন দেই। আমিতো এক নাখান্দা মানুষ।
কিন্তু আল্লাহর রহমাতে দেশের যোগ্য উলামাগণও অধমকে স্নেহ করেন। ফোন দিলে ধরতে না পারলে ব্যাক করেন। মুফতী মুস্তাকুন্নবী কাসেমী ও মুফতী হাবীবুল্লাহ মাহমূদ কাসেমীদের মতো ইলমী ও আমলী মানুষগুলো, যাদের সময়ের অনেক দাম। বলতে গেলে আমার মতো অথর্বকে সময় দেবার মতো সময়ই তাদের নেই। কিন্তু তারাও ফোন দিলে ধরেন। ধরতে না পারলে ব্যাক করেন। এটা আমার যোগ্যতার কারণে নয়। তারা বড় হবার সাথে সাথে বড় দিলের মানুষ হবার কারণেই এমন করে থাকেন।
কিন্তু মাওলানা নজরুল ইসলাম কাসেমী সাহেবকে ফোন এবং মেসেজ দেবার পরও তিনি কোন সাড়া দেননি। তখন আমি বুঝে গেলাম যে, এত বছর ধরে যেহেতু তিনি বড়দের কথাই শুনেননি। আমার মতো অনুল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরতো কোন বেইল থাকারই কথা নয়। তিনি যে, কারো কথার পাত্তা দেন না এবং ইচ্ছেকৃত এসব জাল ও বানোয়াট বর্ণনা করেন, তা আমাদের লেখা প্রকাশের পর তার প্রতিক্রিয়ায় "তিনি এসব বলেই যাবেন" মর্মের উদ্ধত বক্তব্যে পরিস্কার হয়ে গেছে।
এ কারণেই মূলত আল্লাহর উপর ভরসা করে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসকে মানুষের কথার নোংরামী থেকে রক্ষা করতে লিখতে শুরু করেছি।
মাকসাদ মালিকের সন্তুষ্টি। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর মিথ্যা অপবাদ দেয়া থেকে জাতিকে সতর্ক করা। উদ্দেশ্য উম্মত যেন জাল হাদীসের আবর্জনা থেকে রক্ষা পায়।
জানি সমালোচনা হবে। শত্রু বাড়বে। কিন্তু আমরাতো মুসলিম হিসেবে জন্ম নেবার পর থেকে নিজের জানমাল মালিকের কাছে বিক্রি করে দিয়েছি। তাই মালিককে ছাড়া ভয় কিসের?
কয়েকটি বিষয় বুঝে নিন।
১
জঈফ তথা দুর্বল বর্ণনা ফযীলতের ক্ষেত্রে বলা যায়। এ কারণে মাওলানার বলা দুর্বল বর্ণনা বিষয়ে আমার কোন কালাম নেই। কিন্তু জাল তথা বানোয়াট বর্ণনার ক্ষেত্রে কোন ছাড় দেয়া জায়েজ নেই। তাই এ বিষয়ে কোন প্রকার দুর্বলতা প্রকাশ মানে হলো, নবীর কথার ইজ্জত রক্ষার উপর কোন ব্যক্তির ইজ্জতকে প্রধান্য দেয়া।
২
এটা শুধু মাওলানা নজরুল সাহেব নয়, আমার বাবাও যদি জাল হাদীস বলেন, আমি এমনি নির্দ্বিধায় বলবো "এটা জাল এটা বলা জায়েজ নয়। হারাম"।
৩
দুঃখ পেয়েছি হযরত আমাদের জবাব দিয়েছেন। কিন্তু তিনি "এসব বলেই যাবেন" ঘোষণার সাথে সাথে জাল হাদীস নির্ণয়ের এক উদ্ভট দলীল তিনি আবিস্কার করেছেন। সেটা হলো:
ক) দলীল ওনার কাছ থেকে নিয়ে যেতে।
জাল হাদীসের দলীল ওনার কাছ থেকে কী নেবো? জালতো জালই। এটার অস্তিত্বের আবার দলীল কী? হাদীস দুর্বল বললে, সেটার দলীল জানা দরকার। কিন্তু যেসব জাল এসবের আবার দলীল দিয়ে বিশুদ্ধ প্রমাণের সুযোগ কোথায়?
খ) ওনি হাদীস বলবেন। আর শ্রোতাদের দায়িত্ব দিয়েছেন এটা খুঁজে দেখতে। এটা সহীহ না জাল।
ইন্নালিল্লাহ। যদি শ্রোতারা নির্ধারণ করতে পারে সহীহ কোনটা আর জাল কোনটা? তাহলেতো আর তারা শ্রোতা থাকতো না, তারা হযরতের মতো বক্তাই হয়ে যেতো।
গ) যারা হযরতের কথাগুলোকে জাল বলছেন। এরা কেউ কিতাব পড়ে না। সারাদিন ফেইসবুক চালায়। হোয়াটসআ্যাপে চ্যাটিং করে। কিতাব পড়ে না।
আমি আমার ক্ষেত্রে মানি। আমি আমলহীন মানুষ। ইলম ও নেই। ফালতু সময় নষ্ট করি তাই অনেক ইলম থেকে বঞ্চিত। কিন্তু আমি নালায়েক, কাসেমী সাহেবের যে বিষয়গুলোকে জাল ও বানোয়াট বলে চিহ্নিত করেছি, তিনি কি আমাদের দেশের বা বর্হিবিশ্বের কোন ইফতা বা উলুমুল হাদীস বিভাগ থেকে এসব জাল নয় বা বয়ান করা জায়েজ মর্মের ফাতওয়া দেখাতে পারবেন?
ঘ) হযরতের দাবী তিনি যা বলেছেন সবই কিতাবে আছে। সুতরাং সমালোচনা করা অহেতুক।
আস্তাগফিরুল্লাহ। আমরা কখন বললাম কিতাবে নেই। কিতাবে থাকলেই কি সেটা গ্রহণযোগ্য হয়ে যায়? প্রায় সকল জাল হাদীসইতো কোন না কোন কিতাবে আছে। এখন কিতাবে থাকলেই যদি হাদীস ঠিক হয়ে যায়, তাহলেতো দুনিয়াতে জাল হাদীসের কোন অস্তিত্বই থাকবে না।
তাহলে জারাহ তা’দীলের এ বিশাল ভান্ডার কেন অহেতুক উলামাগণ কষ্ট করে একত্র করলেন?
হযরতের জাল বয়ানের সংক্ষেপ তালিকা!
১
উম্মতে মুহাম্মদী জাহান্নামে যাবে। কিন্তু জাহান্নামের আগুনে পুড়বে না। চেহারা কালো হবে না।
চূড়ান্ত জাল বক্তব্য। এর কোন ভিত্তি নেই।
২
নাফরমান বান্দার কাছে আল্লাহ তাআলা এসে ব্যক্তির জন্ম ও জন্মের বৃত্তান্ত নির্ভর বিশাল বর্ণনা কোন হাদীস নয়। হাদীসে কুদসী হবার প্রশ্নই উঠে না।
৩
আগের সমস্ত নবীরা আমাদের নবীর উম্মত হতে চেয়েছেন বলা নবীদের নামে চরম মিথ্যাচার।
৪
হযরত দানিয়াল আলাইহিস সালাম উম্মতে মুহাম্মদীকে ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছেন বলা ডাহা মিথ্যা।
৫
হযরত মুসা আলাইহিস সালাম উম্মতে মুহাম্মদীর আল্লাহর ডাকে সাড়া দেয়া দেখে হতভম্ব হয়ে গেছেন বলা বানোয়াট।
৬
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের দিন ফেরেশতাদের দুইদিন ছুটি ছিল বানোয়াট কথা।
৭
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের পর ছাদ ফেটে নবীকে পুরো পৃথিবী দুই মিনিটের মাঝে ঘুরিয়ে আনার কথা হাদীসে আছে বলা হাদীসের নামে জালিয়াতি।
৮
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের পর নবীজীর খেলনা নেই বলে হযরত আমিনার মন খারাপ দেখে আল্লাহর সান্ত্বনা দিয়ে আকাশের চাঁদকে খেলনা বানানোর কথা "তাখাইয়ুল" হিসেবে বলা যেতেও হয়তো পারে, কিন্তু স্পষ্টভাবে "আল্লাহ বলেছেন" বলা আল্লাহর উপর মিথ্যা অপবাদ।
৯
জিবরাইল আলাইহিস সালাম নবীর কাছে এসে হাটু লাগিয়ে বসা দেখে আল্লাহ তাআলা ঈর্ষান্বিত হয়ে আল্লাহ তাআলা নবীকে মেরাজে নিয়ে নিজের পাশে বসিয়েছেন বলা আল্লাহর উপর মিথ্যা অপবাদ।
১০
সমস্ত সৃষ্টির এক হাজার বছর আগে আল্লাহ তাআলা সূরা ইয়াসিন তেলাওয়াত করেছেন। ইমাম যাহাবী রহঃ বলেন, এটা মুনকার। ইমাম ইবনে হিব্বান রহঃ বলেন এটা বানোয়াট কথা।
تلك عشرة كاملة
মাত্র দশটা বললাম। আপনি শায়েখের যে কোন বয়ান ইউটিউব থেকে নামিয়ে বিজ্ঞ কোন আলেমকে শুনান। দেখবেন আরো কত জাল ও বানোয়াট কথা বিজ্ঞ উলমাগণ বের করে দিবেন।
শেষ কথা
উম্মাহ দরদী মাওলানা নজরুল কাসেমীর আমরা বিরোধী নই। তিনি উম্মতের দরদেই কথা বলেন আমরা মানি। নবীকে মোহাব্বত করেই কথা বলেন তাও মানি।
কিন্তু এ যুক্তিতে নবীর নামে মিথ্যা বলা বৈধতা পেয়ে যাবে না। উম্মতের দরদে নবীর উপর অপবাদ আরোপ জায়েজ হয়ে যাবে না। নবীকে মোহাব্বতের নামে মানুষের বানোয়াট কথাকে নবীর নামে চালানো গুস্তাখী ছাড়া কিছু নয়।
তাই আমাদের এ অনলাইন প্রচারের মাকসাদ মূলত মাওলানাকে ছোট করা নয়। উম্মতকে জাল হাদীসের প্রচারক হওয়া থেকে বাঁচানো। যেন তারা সতর্ক হোন। লাখ লাখ মানুষ যেন জাল হাদীস ছড়িয়ে দিয়ে নবীর হাদীসের নামে মিথ্যাচারে মগ্ন না হয়।
সাধারণ ভাইদের প্রতি আমাদের আহবান। মাওলানা নজরুল ইসলাম কাসেমী সাহেবের প্রতি কোন প্রকার বিদ্বেষ রাখবেন না। তার ব্যাপারে কোন কটূবাক্য উচ্চারণ করবেন না।
বাকি এতটুকু সতর্ক করবো যে, হযরতের বয়ানকৃত হাদীস শুনেই বর্ণনা করতে থাকবেন না। বরং বিজ্ঞ কোন আলেমের মাধ্যমে তাহকীক করিয়ে তারপর তা বর্ণনা করবেন।
আল্লাহ তাআলা আমাদের দ্বীনের জন্য কবুল করুন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রকৃত উম্মত হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে কবরে যাবার তৌফিক দান করুন।
আমীন।
কপি
পেস্ট
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন