সতেরো বছর বয়স মুগ্ধ হওয়ার বয়স। মুগ্ধতাটা সাধারণত তৈরি হয় মেয়েদের ঘিরে। গ্রামের সুন্দরীতমা মেয়ে, বন্ধুর বোন, বিয়ে খেতে গিয়ে কোনো সুন্দর চোখের মেয়েকে দেখে কল্পনায় হারিয়ে যাওয়া এগুলোই
সেই বয়সের স্বাভাবিকতা। আমার ক্ষেত্রে কিন্তু এসব কিছু ঘটত না।
এক রাজনীতি, স্লোগান, মিছিল ছাড়া কোনো কিছুতেই মুগ্ধ হতে পারতাম না আমি।
বন্ধু শফিক একবার হাওর দেখাতে নিয়ে গেল। বিপুল আয়োজন। শফিকের নানাবাড়ি ভাটি অঞ্চলে, ওর মামারা জমিদার শ্রেণির, নৌকায় রাত্রি যাপনের সুবন্দোবস্ত। গায়ক দল প্রস্তুত ছিল প্রকৃতির সঙ্গে মেলানো গান গাওয়ার জন্য। শফিকের মুগ্ধতার মাত্রা একটু বেশিই। পানিতে জ্যোৎস্নার আলো দেখে আর বলে, ‘এত সুন্দর দুনিয়া ছেড়ে আমাদের চলে যেতে হবে তাই না রে সরদার?’
আমি দুনিয়া ছাড়ার চেয়েও তখন নৌকা ছাড়া নিয়ে বেশি চিন্তিত। আর ঠাÐা লেগেই কিনা হাঁচি দিতে শুরু করলাম বারবার। গায়করা গান গায় আমি দেই হাঁচি। দুটোর সুর আর স্বর মিলে অদ্ভুত একটা পরিবেশ।
শফিক বলে, ‘সরদার গান ধর। গান গা। এই দুনিয়া কী সুন্দর।’
শফিকের চাপাচাপিতে সুন্দর দুনিয়া দেখতে গিয়ে খুব কিছু খুঁজে পেলাম না।
পানি বয়ে চলছে, চলুক, তাতে আমার কী!
জ্যোৎস্না উপচে পড়ছে, পড়–ক, তাতে আমার কী!
আমার বরং এর চেয়ে শীতের রাতে কম্বলের নিচে শুয়ে থাকাটাকেই ভালো বন্দোবস্ত মনে হয়।
শফিকের প্রকৃতিপ্রেমের মতো ভয়ও ছিল একটু বেশি। বললাম, ‘শফিক নৌকা ডুবে গেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। আমার মনে কেমন যেন একটা ভয় ঢুকেছে। আজ না হয় থাক।’
শফিক বলে, ‘এত সুন্দর দুনিয়ায় তোর ভয় লাগছে! দেখ, চেয়ে দেখ আমরা এখন স্বর্গে। এখানে ভয়ের কিছু নেই।’
স্বর্গ দেখার চেষ্টা করেও খুব সুবিধা করতে পারলাম না। দ‚রে আরেকটা ছোট নৌকা দেখা যাচ্ছে। শফিকের মতো কোনো মক্কেল হয়তো। আর কী! কিচ্ছু না। ফালতু আর একঘেয়ে সব কারবার।
এই যার মুগ্ধতার সীমানা সেই আমি মুগ্ধ। ক্যাপ্টেন রফিককে দেখে।
এমন মাতিয়ে রেখেছিল যে কোন দিক দিয়ে তিন ঘণ্টা সময় গেল টেরই পেলাম না।
হাতে এক মুঠো মাটি নিয়ে বলল, ‘আমাদের দুই নম্বর সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ কি বলেন জানো? তিনি তোমাদের মতো যোদ্ধাদের হাতে এই মাটি দিয়ে বলেন, এই হলো তোমার প্রিয় বাংলাদেশের মাটি। কিন্তু এই এক মুঠো মাটিতে আমার চলবে না। আমার চাই পুরো দেশ।’
মেজর খালেদ মোশাররফকে দেখিনি। হয়তো তিনি সে রকম মুগ্ধ করা মানুষই হবেন। কিন্তু ক্যাপ্টেন রফিক যেভাবে বলল তাতে মনে হলো, খালেদ মোশাররফও এত সুন্দর করে বলতে পারেন না। এতটা নাড়া দেয়ার ক্ষমতা আর কোনো মানুষের নেই।
ক্যাপ্টেন রফিক আবার বলেন, ‘আরেকটা কথা আছে তার।
শুনতে চাও?’
শিহরণে সবাই মাথা নাড়তেও ভুলে যায় যেন।
তিনি রক্তভেজা কবিতার মতো করে বলে চলেন, ‘এই যে কথাটা সেটা আমার খুব প্রিয়। তিনি বলেন, স্বাধীন দেশ জীবিত যোদ্ধা চায় না। তার চাই মৃত সৈনিক।’
কথাটা ঠিক বুঝলাম না কিন্তু বললাম না, এগুলো আমার কাছে দ‚র গ্রহ থেকে ভেসে আসা সুন্দরতম কবিতা। বোঝার দরকার নেই।
অন্ধ গলিতে ফুলের গন্ধ থেকে নেওয়া
বইটি সংগ্রহ করতে পারেন রকমারি থেকে- https://www.rokomari.com/book/111041/andho-golite-fuler-gandho
ফেইসবুক থেকে নেওয়া
![]() |
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন