মহুয়া ফুলের সাথে জড়ানো জীবন ও জড়ানো জনপদের অজনা কথা!
নব্বই এর দশকে বগুড়াসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় মহুয়া গাছ চোখে পড়তো। গ্রামগঞ্জের ছোট ছেলে-মেয়েরা গাছে উঠে মহুয়া ফুল-ফল সংগ্রহ করে মালা গেঁথে গলায় ঝুলিয়ে ঘুঁড়ে বেড়াতো। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ মিনারের পাশে বেড়ে ওঠা গাছটির নামেতো জায়গাটিরই নাম হয়েছে মহুয়াতলা।
ভারতের ছোটনাগপুরের মালভূমি নামে চিহ্নিত পাহাড়ি অরণ্যে গোন্ড উপজাতি বাস করতো। তাদের নাম থেকেই গন্ডোয়ানাল্যান্ড কথাটি এসেছে। মুখ্য জীবিকা শিকার ও চাষবাস ছাড়া তাদের ছিল মহুয়া, যাকে বাদ দিয়ে বাঁচার কথা তারা কল্পনাও করতে পারতো না। তাদের জীবন থেকে মৃত্যু, প্রতিটি স্তরে জড়িয়ে আছে মহুয়া! শুধু নেশার জন্যই নয়, মহুয়া গাছই তাঁদের জীবনের অঙ্গ। ওয়াইনের কৌলীন্য এর মাঝে আজও টিকে রয়েছে তাদের ঝিম ধরানো মহুয়ার নেশা। গোন্ডদের কাছে মহুয়া মানে জীবন, মহুয়া চিরন্তন, যা তাদের বাঁচিয়ে রাখে। তাদের পুরাণেও মহুয়ার উল্লেখ রয়েছে। সেখানে এ গাছকে ভীষণ পবিত্র মনে করা হয়, তাই তারা মহুয়াকে ‘জীবন বৃক্ষ’ বলে ডাকে।
এদের ক্যালেন্ডারে নতুন বছর শুরু হয় চৈত্র মাসে। এ মাসে তারা মহাপরব পালন করে, যেখানে মহুয়া ফুল খুব জরুরি। ফেব্রুয়ারি-এপ্রিল এ তিনমাস মহুয়া গাছ ফুলে ভরে থাকে। এরপর বর্ষাকালে সেই মহুয়া ফুল থেকে সুরা তৈরির আগে মহুয়া উৎসব পালিত হয়। অর্থাৎ একটি গাছে ফুল আসা ও ফুল ফোটা ধরে তৈরি হয় একটি উপজাতির উৎসব।তাছাড়া এদের কাছে মহুয়ার কান্ড, ডাল, ফুল, ফল সবই খুব পবিত্র। ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও জীবন সংগ্রামে একটি গাছের এমন ভূমিকা বিশ্বে বিরল।
গোন্ড ছাড়াও এই অঞ্চলের বেশিরভাগ উপজাতির কাছে মহুয়া ভগবানের আশীর্বাদ। শুধু নেশা নয়, তারা এই গাছের ফল ও বিভিন্ন অংশ সিদ্ধ করে, গুঁড়িয়ে বা রস করে খাবার তৈরি করে। শুকনো কাঠ জ্বালানির কাজে লাগে। কোয়া উপজাতিরাতো এ গাছের কাঠ দিয়েই তাদের চিতা সাজায়, তাদের বিশ্বাস মহুয়া কাঠের আগুন ছাড়া মানুষের দেহের প্রকৃত পঞ্চত্ব প্রাপ্তি হয় না।
চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ এ দেশের পানীয়ের মধ্যে শ্রেণিবৈষম্য লক্ষ করেছিলেন। সামাজিক মর্যাদা অনুযায়ী সেই সময়ে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও নিম্নবর্গের লোকদের পছন্দের পানীয় এক ছিল না। কিন্তু সে সুরা গোন্ডদের জীবনের প্রতিটি স্তরে অপরিহার্য হয়ে ওঠেছিল। এদের জীবন জীবিকা, সমাজ সংস্কৃতির সব কিছুই মহুয়ার ওপর নির্ভরশীল ছিল।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩য় শতকে রচিত আয়ুর্বেদ গ্রন্থ চরক সংহিতাতেও মহুয়া গাছের উল্লেখ আছে। সেখানে মহুয়া রসকে মহৌষধ বলা হয়েছে। ইতিহাসবিদ সি পি খাঁড়ের বইয়ে মহুয়াকে ব্রঙ্কাইটিস ও সর্দিকাশির অতি কার্যকরী ঔষধ বলে বর্ণনা করেছেন। এত সমৃদ্ধ ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও মহুয়া জঙ্গলের পথ পেরিয়ে আজও হয়তো নাগরিক জীবনে আসেনি কিন্তু সে তার সাবলীল ছন্দে, নিজস্ব মদিরতায় আজও বেঁচে আছে এক জীবন-বৃক্ষ হয়ে।
পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খণ্ডের সাঁওতালদের পালিত দ্বিতীয় বড় উৎসব বাহা পরব। বাহা উৎসব প্রতি বছর ফাল্গুন মাসে দোল পূর্ণিমার পর পালন করে। পুরুষেরা দল বেঁধে শিকারে বের হয়, মেয়েরা নতুন ফুলে নিজেদের সজ্জিত করে। বাহা শব্দের অর্থ ফুল। সেজন্যই বাহা উৎসবকে ফুল বা বসন্ত উৎসব নামেও ডাকা হয়। মুণ্ডা বা হো উপজাতিরা এই উৎসবকে সাহরুল নামে পালন করে।
সাঁওতালরা ১লা মাঘকে শস্যবর্ষ সূচনার প্রথম দিন হিসাবে পালন করে। সেদিন তারা জমিতে লাঙ্গল দিয়ে চাষের সূচনা করে। দোল পূর্ণিমার পর চৈত্র মাস পর্যন্ত প্রতিটি সাঁওতাল গ্রামে বাহা উৎসব পালিত হয়। শাল-পলাশ ফোটার সাথে সাথেই বাহা উৎসবের আগমনী বার্তা আসে। মহুয়া ফুলের কুঁড়ি উদ্গমের সাথে সাথেই যুবক-যুবতীদের মধ্যে শুরু হয় উৎসবের প্রস্তুতি। প্রকৃতি যখন নতুন রূপে সেজে ওঠে শাল পলাশের রঙে ওগন্ধে তখন এদের মধ্যে বয়ে যায় আনন্দের হিল্লোল। মেয়েরা খোঁপায় নতুন ফুল গুঁজে না যতক্ষণ না বাহা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। খায়ও না কোনো নতুন ফল। সে জন্য অত্যন্ত পবিত্রতার সাথে উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
বাহা উৎসবের ১ম দিন উম বা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিন। উৎসবের মাসাধিক কাল পূর্ব থেকেই সাঁওতালরা ঘরবাড়ি পরিষ্কার শুরু করে। একটি শাল বা মহুয়া গাছকে ঘিরে গৃহ তৈরি হয়। সন্ধ্যায় গ্রামে নাচ, গান হয়। প্রতিটি পরিবারেই মেয়ে জামাইকে আমন্ত্রণ করে আনা হয়। শাল ও মহুয়া ফুল দেবদেবীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়। পুরোহিত ডাল থেকে পূজার নতুন ফুল দেন। মেয়েরা সে ফুল বণ্টন করে খোপায় গুঁজে দেওর, বৌদি ননদের মধ্যে জল ছিটিয়ে আনন্দ করে। সারারাত নাচে গানে মেতে ওঠে। তিন দিন ধরে উৎসবে যুব বৃদ্ধ সবাই মেতে থাকে। বাহা উৎসবের মধ্য দিয়েই সাঁওতাল সমাজ নতুন ফুল, ফল ও পাতা ব্যবহার শুরু করে।
তথ্যসূত্র:
ক। উইকিপিডিয়া
খ। অতীন্দ্র দানিয়াড়ী, এই সময় গোল্ড।
গ। উপেন কিসকুর- ‘সাওতাল উৎসব’ প্রবন্ধ
#প্রত্নতত্ত্ব #ইতিহাস #উপজাতি #virals #trend #মহুয়া
ঋষনা রুপকথা- The First Myth ❤️❤️❤️❤️❤️❤️❤️❤️❤️❤️❤️
![]() |
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন