বহুমুখী প্রতিভার নিরিখে পিকাসোর সঙ্গে তাঁর তুলনা করেছিলেন বিষ্ণু দে। তিনিই একসময়ে শ্যামবাজারে কাপড়ের দোকানে কাজ করেছেন, শাড়ি কেনাবেচা করতে গিয়ে বুঝে গিয়েছিলেন নানা পেশার মানুষের রঙের পছন্দ-অপছন্দ! গতানুগতিক শিল্পী হতে কোনওদিন মন সায় দেয়নি। অনেকবার বিদেশ ভ্রমণের আমন্ত্রণ পেয়েও দেশের বাইরে যাননি। তিনি বিরলগোত্রের সেই চিত্রশিল্পী যাঁর আঁকা ছবি মধ্যবিত্ত বাঙালির বাড়িতে খুঁজলেই পাওয়া যায়। তিনি যামিনী রায়।
© ধ্রুবতারাদের খোঁজে
খুব ভাল প্রতিকৃতি আঁকতে পারতেন যামিনী রায়,যথেষ্ট ভাল রোজগার হত। কিন্তু গতানুগতিক শিল্পী তিনি হতে চাননি। গ্ৰামের পটুয়া ও মৃৎশিল্পীদের মূর্তি দেখে তাঁর মনে শিল্পী হওয়ার বাসনা জাগে। সেসব দেখে তাঁর বাবা তাঁকে পাঠালেন কলকাতার মামার বাড়িতে। ষোলো বছর বয়সে যামিনী রায় ভর্তি হলেন গভর্নমেন্ট স্কুল অফ আর্টসে। পাশ্চাত্য রীতির ছবি আঁকেন যামিনী, তাঁর দক্ষতায় খুব খুশি অধ্যক্ষ পার্শি ব্রাউন। কিন্তু ছাত্র যামিনী বড় অনিয়মিত। সাহেব প্রিন্সিপাল একদিন ক্লাসে এসে দেখেন, যামিনী ক্লাস না করে জানালার খড়খড়ি তুলে চৌরঙ্গির বহমান জীবন দেখছেন। এ ভাবে সময় নষ্ট করছ! অকুণ্ঠ তরুণ বলেন, ক্লাসে প্রাকৃতিক দৃশ্য আঁকতে হবে, কিন্তু বাইরের দৃশ্য তো বিরাট বিশাল, তাই তাকে এই খড়খড়ির ফ্রেমে আটকে দেখছি!
আর্ট স্কুলের গিলার্ডি সাহেবের কাছে যামিনী শিখে নিয়েছিলেন পাশ্চাত্য রীতির অঙ্কন - পদ্ধতি ও তেল রং-এ আঁকা। কিন্তু অচিরেই জল রংয়ের নিজস্ব উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে ছবি আঁকতে লাগেন। এক সময়ে ফরাসি কার্ভপন্থীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। তবে ৩৪ বছর বয়সে সেই যে নিজস্ব পদ্ধতি অবলম্বন করলেন বাকি জীবনটা সেই পদ্ধতিতে এঁকে যান। সমতল কাগজ ছেড়ে অসমতলের বুননের ক্যানভাসে ছবি আঁকা শুরু করেন। অতঃপর পল্লিমানব চিত্রিত হতে লাগল মহাপুরষের সমমর্যাদায়।
© ধ্রুবতারাদের খোঁজে
যামিনী রায়ের জন্ম বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড় গ্ৰামে। যামিনী যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য রায়ের বংশধর।পিতা রামতারণ,মা জননী নগেন্দ্রবালা। পিতার মধ্যেও ছবি আঁকার প্রবণতা ছিল। ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত যামিনীর জীবনে প্রবল অনটন। আর্ট কলেজে পড়ার সময় থেকেই কলকাতার অনেক জায়গায় কাজের ব্যাপারে ঘুরেছেন। উত্তর কলকাতাতেই পনেরো বার বাড়ি পালটাতে হয়েছে। শিল্পের সাধনে যামিনী ছিলেন অনন্ত উৎসাহী এক ছাত্র। যখন খুব নাম হয়েছে, তখনও বলতেন, কাকে কী শেখাবেন! নিজেই এখনও শেখার জন্য অস্থির হয়ে আছেন।
একসময়ে আবার করে দেখলেন পটের ছবি। সেই ঐতিহ্য আপনার শিল্পের মাধুরী মিশিয়ে গড়ে তুললেন নিজস্ব স্টাইল । ১৯৩৭ এর প্রর্দশনী যামিনী রায় কে রসিক মহলের সামনে এনে দেয়। সুহৃদ পেলেন বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্তদের । বিষ্ণু দে তাঁকে তুলনা করেন পাবলো পিকাসোর সঙ্গে। বিষ্ণু দে’র ভাষায়, ‘ধূসর তিনি আনেন নদীর পলিমাটি থেকে, সিঁদুর-রঙ পান মেয়েদের পুণ্যাচারের সিঁদুর থেকে, নীল তো চাষের নীল, আর শাদা হচ্ছে সাধারণ খড়ির রঙ এবং কালো তিনি মেশান সুলভ ভুষো থেকে।’ তিনি ছবি আঁকেন খবরকাগজে, চটে চাটাইয়ে, ছেঁড়া কাপড়ে, তালপাতা-নারকেলপাতায়, এক ছবি মুছে দিয়ে তার উপরেই আঁকেন অন্য ছবি। আবার তাঁর অসামান্য কীর্তি রামায়ণ সিরিজ আঁকেন উত্তর কলকাতার ‘রসগোল্লা ভবন’-এর লম্বা হলঘরে বসে।
বাগবাজারের বাড়িতে অন্তরঙ্গ জনেরা পড়সি, কথা সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় ‘রবীন্দ্রনাথের ছবি’ নামে দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলেন যামিনী রায়। রবীন্দ্রনাথের ছবি নিয়ে বিস্তর সমালোচনার আবহে প্রকাশিত সেই প্রবন্ধ পড়ে আনন্দিত কবি চিঠি লিখেছিলেন শিল্পীকে, ‘তোমাদের মতো গুণীর সাক্ষ্য আমার পক্ষে পরম আশ্বাসের বিষয়।’ কলকাতার এগজিবিশনে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর এসেছেন, জিভে প্যারালিসিস, কথা বলতে পারেন না। যামিনী রায় দেখলেন, তাঁর আঁকা ছবি দেখে গগনেন্দ্রনাথের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।
যামিনী রায় বিশ্বে পরিচিত হয়েছেন এক্ষেত্রে ' বি নিকলস এর 'ভার্ডিকট অন ইন্ডিয়া ' বইয়ের বড় ভূমিকা।
তাঁর অসংখ্য ছবি সারা পৃথিবীর রসিকদের সংগ্ৰহে। সরল মানুষ,সরল জীবনযাপন। সাঁওতাল রমণী,বাংলার বধূ, মায়ের কোলে শিশু ছাড়াও যিশু -পশুপাখি চিত্রশালা যামিনী রায়ের জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে। তাঁর ছবিতে বাঙালি জীবনে প্রাণস্পন্দন,গ্ৰাম উঠে এসেছে জীবন্ত হয়ে। যামিনীর শিল্পকর্ম দেখতে স্বয়ং গাঁধীজির আগ্রহ সত্ত্বেও দেখাতে যাননি যামিনী রায়। বলেছিলেন "গাঁধীজি যদি ছবিই দেখতে চান, আমার স্টুডিওতে আসবেন। এটুকু সম্মান কি শিল্পী হিসেবে আশা করা যায় না"?
ভারত সরকার শিল্পী যামিনী রায় কে পদ্মভূষণ সম্মান দেয। ললিত কলা অ্যাকাডেমি 'ফেলো' নির্বাচিত করে। তিনি কী সত্যিই যশ,খ্যাতি অর্থ চেয়েছিলেন! না, চাননি তো এ সব। তিনি নিজের কাজটাই করে গিয়েছেন হৃদয় দিয়ে আবেগে, আবেশে। থেকেছেন কখনও একাকী, প্রকাশ্যে, অন্তরালেও।
পটুয়াদের চিত্রকলা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজস্ব চিত্রশৈলী গড়ে তোলেন। গত শতকের চল্লিশের দশকে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে যামিনী রায়ের নাম পৌঁছে যায় ইউরোপীয় মানুষজনের ঘরে ঘরে। লন্ডন-নিউ ইয়র্কের শিল্পরসিকদের মুখে মুখে চর্চিত হতে থাকেন তিনি। ১৯৭২-এ আজকের দিনে প্রয়াণ ঘটে শিল্পীর।তাঁকে আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।
সংকলনে ✍🏻 অরুণাভ সেন।।
© ধ্রুবতারাদের খোঁজে
#JaminiRoy
#Painter
#DeathAnniversary
#ModernArt
#dhrubotaraderkhonje
#legendary
পুস্তক ঋণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার,সেরা বাঙালি শতক বারিদবরণ ঘোষ ও আনন্দবাজার পত্রিকায় শিশির রায়ের নিবন্ধ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন