সমুদ্র সৈকত বলতে প্রথমেই আমাদের সবার চোখে সামনে কি ভেসে ওঠে? ধূসর বালিতে ঢাকা বিস্তীর্ণ তটে ক্রমাগত আছড়ে পড়ছে একের পর এক ঢেউ। কিন্তু ধরুন তো এমন কোনো সমুদ্র সৈকতে আপনি গেছেন যেখানে গিয়ে দেখলেন সেখানে সৈকতের রং স্বাভাবিক নয়, শুধুই লাল।
ভাবছেন রূপকথার কোনো দেশের গল্প শোনাতে এসেছি আপনাদের সামনে। না সেরকম কোনো ব্যাপার এখানে নেই। আমাদের এই পৃথিবীতে ভূমির প্রকৃতির বৈচিত্রের অন্ত নেই। পৃথিবীতে যে সমস্ত সমুদ্র সৈকত রয়েছে তাদের মধ্যে শুধু ব্যতিক্রম চীনের পানজিয়াং সমুদ্র সৈকত।
গ্রীষ্মের রক্তরাঙা কৃষ্ণচূড়া অথবা বসন্তের লাল পলাশের সৌন্দর্য্য দেখে যদি আপনার মন ভালো লাগে তাহলে এই জায়গা আপনার জন্য একদম পারফেক্ট। একথা নিশ্চিত করে বলতে পারি,এখানে এলে রক্তিম এই সমুদ্র সৈকত আপনাকে নিয়ে যাবে প্রকৃতির এক অন্য জগতে।
চীনের রাজধানী বেইজিং থেকে মাত্র ৬ ঘন্টা দূরত্বে অবস্থিত এই সমুদ্র সৈকতে প্রকৃতির এই রংবাজি দেখলে আপনিও অবাক হয়ে যাবেন। দূর থেকে এক ঝলক দেখলে মনে হবে,কেউ লাল রঙের কার্পেট বিছিয়ে রেখেছে গোটা সৈকত জুড়ে।
এই সমুদ্র সৈকত জুড়ে আপনি দেখতে পাবেন শুধু লাল রংয়ের অস্তিত্ব। ভাবছেন লাল রঙের সমুদ্র সৈকত এমনটাও আবার হয় নাকি? হ্যাঁ চীনের এই পানজিয়াং সমুদ্র সৈকতে এলে আপনার এমন অভিজ্ঞতাই হবে। তবে এই লাল রঙের জন্য সমুদ্রের বালি কিন্তু দায়ী নয়। বরং এর পেছনে আছে একটি অন্য গল্প
পানজিয়াং এই লাল সমুদ্র সৈকতের পিছনে রয়েছে সুয়েডা নামক এক শৈবালের কাহিনী। পুরো লিয়াওয়া বদ্বীপ জুড়েই দেখতে পাওয়া যায় এই শৈবালের উপস্থিতি। এপ্রিল ও মে মাসের দিকে জন্মানো এই শৈবালগুলির শরৎকালেই আসল রূপ দেখতে পাওয়া যায়। এপ্রিল মে মাসে এলে কিন্তু আপনি এই লাল রং দেখতে পাবেন না। এই সময় জন্মানো সবুজ শৈবালগুলি সমুদ্রের নোনা জল শোষণ করে ক্রমশ পরিবর্তন করতে থাকে তাদের রং।
শরতের শুরুতে এই শৈবালগুলির রং প্রথমে থাকে কমলা,তারপরে গোলাপী এবং সবশেষে টকটকে লাল। বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে অর্থাৎ পরিপূর্ণ শরতের সময় এই সমুদ্র সৈকত এক আলাদাই অনুভূতি। এই সময় দূর থেকে দেখলে মনে হয় কে যেনো লাল রঙের গালিচায় ঢেকে দিয়েছে পুরো পানজিয়াং সমুদ্র সৈকত।
চীনের এই পানজিয়াং সমুদ্র সৈকত শুধু যে তার মনভোলানো রূপের জন্য বিখ্যাত তাই নয় বরং এটি পক্ষী প্রেমীদের জন্য আদর্শ একটি গন্তব্যস্থল। এখানে দেখতে পাওয়া যায় প্রায় ২৬০ রকমের পাখি আর ৩৯৯ রকমের বন্য প্রাণী। তাই এই পশু ও গাছপালা মিলিয়ে এখানে তৈরি হয়েছে খুব জটিল এক ইকোসিস্টেম।
এছাড়াও এই এলাকায় পাওয়া যায় বিলুপ্তপ্রায় মুকুটধারী সারস পাখি আর কালো ঠোঁটের শঙ্খচিল। এখানে সারস পাখি এতটাই বেশি দেখা যায় যে পানজিয়াংকে অনেক সময় " সারসের ঘর " বলেও অভিহিত করা হয়। ১৯৮৮ সালে এলাকাটিতে গাছপালা ও পশুপাখি সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
চীনের উত্তর অঞ্চলে অবস্থিত এই সমুদ্র সৈকতের আসল সৌন্দর্য বা রূপ উপলব্ধি করতে হলে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যেতে হবে। কারণ এই সময় ওই শৈবালগুলির রং এতটাই উজ্জ্বল রক্তবর্ণ হয় যে সেই সৌন্দর্য্য থেকে চোখ ফেরানো যায় না।
প্রধানত লাল এই শৈবালের কারণে এই পানজিয়াং সমুদ্র সৈকতটি চীনের অন্যতম একটি বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠেছে। তবে পর্যটকদের কাছে একটি দুঃখের বিষয় যে পুরো সমুদ্র সৈকতের সব অংশে তাদের যাওয়া নিষেধ।
পুরো সমুদ্র সৈকতটির কিছুটা অংশ উন্মুক্ত থাকে সকলের জন্য। শুধু তাই নয় দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চালু থাকে এই ব্যবস্থা। অর্থাৎ সেই সময়ের পরে গেলে আপনি এর সৌন্দর্য উপলব্ধি করার সুযোগ হাতছাড়া করতে পারেন।
এই প্রতিবেদন পড়ার পরে যদি চীন ভ্রমণের কথা মাথায় এসে থাকে তাহলে অবশ্যই দেখে আসুন রাজধানী বেইজিং থেকে মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে অবস্থিত এই সমুদ্র সৈকতটি। তবে মাথায় রাখবেন শুধুমাত্র শরৎকাল হলে তবেই উপলব্ধি করতে পারবেন বিচিত্র এই সৈকতের আসল রং ও রূপ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন