নদী দিয়ে ঘেরা নয়টি দ্বীপ থেকে নবদ্বীপ বা নওদিয়াহ; আর তার থেকে নদীয়া। প্রাচীন নদীয়ায় কতগুলি নদী থাকলে নয়টি দ্বীপ সৃষ্টি হতে পারে, কখনও ভেবে দেখেছেন? আসুন জেনে নিই নদীয়া জেলার সকল হারিয়ে যাওয়া নদীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
নদীর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নদীয়া জেলার মানুষের জীবন। জেলার আয়তনের তুলনায় এখানে যত সংখ্যক নদী, খাল, বিল, জলাভূমি দেখা যায়, নিম্নবঙ্গের আর কোনও জেলায় তেমনটা দেখা যায় না। ভাগীরথী, জলঙ্গী এবং চূর্ণী এই তিনটি বড় নদী প্রধানতঃ নদীয়ার নদী নামে খ্যাত। জেলার একদিকে ভাগীরথী নদী, ঠিক মাঝামাঝি বয়ে গেছে জলঙ্গী নদী, আর জেলার প্রান্ত দিয়ে মাথাভাঙা, ইছামতী আর চূর্ণী। ব্রিটিশ আমলে সাহেবরা নদীগুলিকে একসাথে বলতেন ‘নদীয়া রিভার্স’। তবে এগুলি ছাড়াও নদীয়া জেলায় ছিল আরও অসংখ্য ছোট ছোট নদী। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য: ভৈরব, পাগলাচন্ডী, কুমার, ভৈরববাঁকী, ছোট গঙ্গা, হাউলিয়া, কলিঙ্গ, চকাই, ছোট চকাই, বুড়ি গঙ্গা, খড়ে, অলকানন্দা, অঞ্জনা, গড়াই, ইন্দুমতী, বাচকো, ছোট জলঙ্গী, গুড়গুড়ি, বেহুলা, সুরধনী, হরিনদী, যমুনা, মরালী, গোমতী, সুবর্ণমতী ইত্যাদি। উক্ত ছোট নদীগুলির অধিকাংশই ছিল প্রধান তিনটি বড় নদীর উপনদী অথবা শাখানদী। বর্তমান সময়ে এই সকল নদীগুলি স্রোতহীন বা মৃতপ্রায় হয়ে পড়েছে অথবা সম্পূর্ণ শুকিয়ে গিয়ে নদীখাতে পরিণত হয়েছে। এতদ্ব্যতীত নদীয়া জেলায় রয়েছে অসংখ্য খাল ও বিল, যেগুলি অতীতে ভাগীরথী, জলঙ্গী ও মাথাভাঙ্গা নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ফলে সৃষ্টি হয়েছিল।
নদীয়াবাসীর সঙ্গে নদীগুলির সম্পর্ক ছিল খুবই ঘনিষ্ঠ। রেলপথ প্রতিষ্ঠার পূর্ব্বে এই সকল নদীই ছিল দেশ-দেশান্তরে যাবার একমাত্র পথ এবং বাণিজ্য পরিচালনার একমাত্র উপায়। প্রশস্ত নদীপথে সুবিশাল নৌকা, জাহাজ ইত্যাদি জলযান অবাধে চলাচল করত। ইংরেজ আমলেও বড় বড় বাণিজ্যিক তরী মালদা, মুর্শিদাবাদ থেকে সূক্ষ্ম রেশমী বস্ত্র, চিনি, চাল এবং শান্তিপুর থেকে বস্ত্র, সুতো, আর সারা নদীয়া জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য নীলকুঠী থেকে নীল সংগ্রহ করে এই সমস্ত নদীগুলি দিয়ে চলাচল করত। সেই সময় নদীয়ার বহু স্থানে নৌকার আড্ডা বা গঞ্জ গড়ে উঠেছিল (নদীপথের গঞ্জগুলিকে আমরা আজকের দিনের রেলপথের জংশন স্টেশনের সঙ্গে তুলনা করতে পারি, দুটির কার্যকারিতা অনেকটা একইরকম)। এরমধ্যে কৃষ্ণগঞ্জ, কালীগঞ্জ, সুখসাগর, নবদ্বীপ, স্বরূপগঞ্জ, গোয়াড়ী, হাঁসখালী, রানাঘাট নোকারি বা নৌকাড়ি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
জীবনের সঙ্গে নদীর জুড়ে থাকার একটি উদাহরণ ছিল নদীয়া জেলা। যুগে যুগে নদীয়ার নদীগুলি নদীয়াকে নতুন করে গড়েছে আর ভেঙেছে। নদীতীরে গড়ে উঠেছে কত বর্ধিষ্ণু শহর, গ্রাম, বন্দর, জনপদ, মন্দির, সমাজ ও কৃষ্টি; আবার কালের আবর্তে এই সবই লুপ্ত হয়ে গিয়েছে নদীর জলে, নদীর চরে, জঙ্গলে আর মাটির তলায়। ব্রিটিশ আমলে সাহেবদের আঁকা বাংলাদেশের নদীর প্রবাহপথের অনেক পুরানো মানচিত্রের সঙ্গে এখনকার প্রবাহপথের তুলনা করলে স্পষ্টই বোঝা যায় কী নিদারুণ পরিবর্তন ঘটেছে এই অল্প সময়ে। বর্তমানে নদীগুলির অধিকাংশই বদ্ধসলিলা, কোথাও ক্ষীণ কলেবরে বইছে আবার কোথাও বা সম্পূর্ণ শুষ্ক নদীখাতে পরিণত হয়েছে। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে নদীয়ার নদীরা। দুঃখজনক তবুও এটিই সত্যি যে, নদীর মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করা ছাড়া মনুষ্য জাতি নদীর জন্য কোনও সদর্থক ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে।
তথ্যসূত্র:
কান্তিচন্দ্র রাঢ়ী - শ্রীশ্রী নবদ্বীপ-তত্ত্ব
অশোক কুমার বসু - পশ্চিমবঙ্গের নদনদী
Van Den Brouck - Golf De Bengale
(সংগৃহীত পোস্ট)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন