ডঃ কুদরাত-ই-খুদাঃ
প্রখ্যাত রসায়নবিদ,শিক্ষাবিদ ও লেখক
-------------------------------------------------------
স্বনামধন্য ড. মুহম্মাদ কুদরাত-ই-খুদা: উপমহাদেশের প্রখ্যাত রসায়নবিদ, শিক্ষাবিদ ও লেখক। ড: কুদরাত ই খুদার জন্ম ১৯০০ সালের ১ ডিসেম্বর নানার বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের মাড়গ্রামের সম্ভ্রান্ত পীর পরিবারে।
বাবা-মা: সৈয়দ শাহ সুফী খোন্দকার আবদুল মুকিত, সৈয়দা ফাসিয়া খাতুন। বাবা-মায়ের সাত সন্তানের মধ্যে কুদরাত-এ-খুদা ছিলেন দ্বিতীয় সন্তান।
তখনকার ধর্মপ্রাণ মুসলমান পরিবারের রীতি অনুযায়ী জন্মস্থান মাড়গ্রামে কুদরাত-এ-খুদার লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়েছিল নিজ পরিবারে । এরপর মক্তবে গিয়ে হাফেজ হওয়ার উদ্দেশ্যে পবিত্র কোরান শরীফ মুখস্থ করার কঠিন পর্বটিও আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন তিনি।
এরপর কুদরাত ই খুদা পড়াশোনা করার জন্য গ্রামের স্কুল ছেড়ে কলকাতার মিরজাপুর স্ট্রীটে অবস্থিত উডবার্ণ এম.ই. স্কুলে ভর্তি হন। বাংলা শেখার ব্যবস্থা না থাকায় তিনি উর্দুতে মাইনর স্কুলের পড়াশোনা শেষ করেন এবং বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে বৃত্তিলাভ করেন।
মাত্র দু’বছর পর মধ্য ইংরেজি বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন এবং কলকাতা মাদ্রাসায় অ্যাংলো পারশিয়ান বিভাগে ভর্তি হন কুদরাত ই খুদা। সেখানে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় পণ্ডিত মশাইয়ের কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বাংলা পড়তে শুরু করেন তিনি।
স্কুলে বরাবরই কুদরাত ই খুদা ক্লাসে প্রথম হতেন। ১৯১৮ সালে তিনি কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসার অ্যাংলো পারশিয়ান বিভাগ থেকে মেধা তালিকায় প্রথম দশজনের মধ্যে থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
এরপর কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন কুদরাত ই খুদা। বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে রসায়নের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল বেশি। রসায়নের পরীক্ষণ-সংক্রান্ত কাজগুলি তাঁর মনোযোগ এতটা আকর্ষণ করে যে, পরীক্ষণাগারেই অধিকাংশ সময় কাটাতেন তিনি।
আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে অভিভাবকরা কুদরাত ই খুদাকে খুব সামান্য পরিমাণ অর্থ পাঠাতেন। এর বাইরে প্রায় সম্পূর্ণভাবে তাঁকে নির্ভর করতে হতো বৃত্তির টাকার ওপর।
তাই জীবনের প্রয়োজনগুলোকে সীমিত রেখে, অত্যন্ত পরিশ্রম করে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে কলেজের পাঠ শেষ করেন। এরপর প্রেসিডেন্সি কলেজেই স্নাতক পর্যায়ের পড়াশুনা শুরু করেন কুদরাত ই খুদা।
১৯২৪ সালে রসায়নশাস্ত্রে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে এম.এসসি. ডিগ্রি অর্জন এবং ফলাফলের জন্য স্বর্ণপদক লাভ করেন কুদরাত-ই- খুদা।
কুদরাত ই খুদা ১৯৩১ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়ন বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। নিজ মেধা ও দক্ষতায় ১৯৩৬: উক্ত বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের পদে উন্নীত।
কুদরাত ই খুদা ১৯৪২ সালে ইসলামিয়া কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ১৯৪৬ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে ফিরে এসে এর অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত হন তিনি ।
দেশবিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান চলে এলে ১৯৪৭ ভারত পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রথম জনশিক্ষা পরিচালকের (ডিপিআই) দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ১৯৪৯: করাচিতে পাকিস্তান সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। ১৯৫৩: দেশে ফিরে আসেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন।
কুদরাত ই খুদা ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসেবে এর পূর্বাঞ্চলীয় শাখা গঠনের দায়িত্বে নিযুক্ত হন। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত এই গবেষণাগারের পরিচালকের দায়িত্বে কর্মরত থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
কুদরাত ই খুদা ১৯৬৮ সালে তাঁকে কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়, কিন্তু আইয়ুব-মোনায়েম খানের চক্রান্তে সেখান থেকে তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়।
১৯৭২ সালে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠনের জন্য গঠিত প্রথম শিক্ষা কমিশনের সভাপতি হিসেবে তিনি অল্প সময়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কাছে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পেশ করেন।
এই প্রতিবেদনটি “কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট” নামে পরিচিত যা তাঁর কর্মজীবনের একটি বিশেষভাবে স্মরণীয় অবদান।
কুদরাত ই খুদা ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে যোগদান করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এই পদে নিযুক্ত ছিলেন।
ড. কুদরাত ই খুদার গবেষণা মূল ক্ষেত্র ছিল জৈব রসায়ন। তিনি পাট, কয়লা, লবণ ও বিভিন্ন ভেষজ ওষুধ নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি চিকিৎসাকাজে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন দেশীয় ভেষজ গাছ,লতা- পাতার নির্যাস বৈজ্ঞানিকভাবে সংগ্রহ করতেন।
ডক্টর কুদরাত ই খুদা ও তাঁর সহকর্মীদের ১৮টি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের পেটেন্ট রয়েছে। পাট কাঠি থেকে উদ্ভাবিত “পারটেক্স”কে তাঁর সেরা আবিষ্কারগুলোর একটি হিসেবে ধরা হয়।
এছাড়া পাটকাঠি থেকে কাগজ এবং রস ও গুড় থেকে মল্ট ভিনেগার আবিষ্কার উল্লেখযোগ্য। দেশে ও বিদেশের বিভিন্ন বিখ্যাত গবেষণামূলক পত্রিকায় তাঁর রচিত প্রায় ১০২টি গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
কুদরাত ই খুদা সম্মাননা এবং স্বীকৃতি:
* ১৯৭৬ সালে শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ড. কুদরাত-এ-খুদাকে একুশে পদক প্রদান করে সম্মানীত করেন।
১৯৭৯ সালে চট্টগ্রাম বিজ্ঞান পরিষদ ড. কুদরাত-এ-খুদার নামে একটি স্বর্ণপদক প্রবর্তন করে।
১৯৮৪ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান স্বাধীনতা পদক (মরণোত্তর) প্রদান করেন।
১৯৯০ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ড. মুহাম্মাদ কুদরাত-এ-খুদার বসতভিটায় প্রতিষ্ঠিত হয় ড. মুহাম্মদ কুদরাত-এ-খুদা গ্রামীণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিকাশ কেন্দ্র ও সংগ্রহশালা।
একই বছর সেখানে রামপুরহাট থেকে মাড়গ্রাম পর্যন্ত সড়কটি “ড. কুদরাত-এ-খুদা সড়ক” নামকরণ করা হয়।
১৯৯৩ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এই মহান বিজ্ঞানীর প্রতি সম্মান দেখিয়ে ঢাকাস্থ নিউ এলিফ্যান্ট রোডের নাম পরিবর্তন করে “ড. কুদরাত-এ-খুদা সড়ক” নামকরণ করেন।
ড: কুদরাত ই খুদা রচিত জনপ্রিয় গ্রন্থগুলি হলো- বিজ্ঞানের সরস কাহিনী,বিজ্ঞানের বিচিত্র কাহিনী, বিজ্ঞানের সূচনা, জৈব-রসায়ন (৪খন্ড) পূর্ব- পাকিস্তানের শিল্প সম্ভাবনা, পরমাণু পরিচিতি, বিজ্ঞানের পহেলা কথা।
যুদ্ধোত্তর বাংলার কৃষি ও শিল্প,বিচিত্র বিজ্ঞান,পবিত্র কোরআনের পূত কথা,অঙ্গারী জওয়ারা
সাময়িকী:পুরোগামী বিজ্ঞান, বিজ্ঞানের জয়যাত্রা।
ইংরেজিতেও বেশ কয়েকটি পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন তিনি।
স্বনামধন্য বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ এবং লেখক ড: কুদরাত ই খুদাকে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
(Alim Al Rashid)❤️
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন