বাবার পরী রানু
'কুচকুচে কালো সে জাতে স্প্যানিয়েল,
তুলতুলে গা যেন রেশমি রুমাল।
আমি তাকে বুশিবল নাম দিয়ে ডাকি
বুশিবল এ শহরে আছে একটাই...
বুশিবল বুশিবল তুমি যে আমার,
বুশিবল বুশিবল আমিও তোমার।'
একটি কালো রঙের কুকুরের প্রতি ভালবাসা নিয়ে এই গান আজও বাঙালির ঘরেঘরে জনপ্রিয়।
বাংলা সঙ্গীত জগতে এক কিশোরীর মাদকতাময় কণ্ঠ নতুন বাঁক ঘুরিয়ে দিয়েছিল। সেই কিশোরীটি হলেন রাণু মুখোপাধ্যায়, কিংবদন্তী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্যা। কিন্তু রাণু হেমন্ত-কন্যা পরিচয়েই সীমাবদ্ধ থাকেননি, স্বতন্ত্র কণ্ঠ ও গায়কী দিয়ে নিজের আইডেন্টিটি তৈরি করে ফেলেছিলেন খুব অল্পদিনেই। স্টারকিড হওয়ার দৌলতে রাণুর সঙ্গীত জগতের লাইমলাইটে আসা হয়তো সহজ ছিল, কিন্তু বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়ে যেভাবে রাণু মুখার্জীর নামটা এক নম্বরে উঠে এসেছিল, সেই লড়াইটা কিন্তু সহজ ছিল না। বাবা যে একজন কিংবদন্তী সঙ্গীতশিল্পী ও সুরকার, সেই বোধটা ছোটবেলায় ছিল না রাণুর। বাবার ব্যস্ততা, বাড়িতে নিয়মিত সঙ্গীত তারকাদের যাওয়া-আসার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন জয়ন্ত ও রাণু, হেমন্তর পুত্র-কন্যা। জয়ন্ত বড়, রাণু ছোট। রাণু ছোট বলে সবার আদুরে। মুম্বইয়ের খারেতে তখন থাকেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। বাড়ির নাম 'গীতাঞ্জলি'। হেমন্তর প্রতিবেশী ছিলেন বিখ্যাত গীতিকার শৈলেন্দ্র। একবার রাণু স্কুল থেকে ফিরে সুর করে নার্সারি রাইম শোনাচ্ছিলেন বাবা আর শৈলেন্দ্র আঙ্কলকে। সুরটা দু'জনেরই পছন্দ হয়ে গেল। তৈরি হল সেই বিখ্যাত গান, 'নানি তেরি মোরনি কো মোর লে গ্যয়ে'। রেকর্ডিং স্টুডিওয় যাওয়ার পথে গাড়িতেই পুরো গানটা মেয়েকে শিখিয়ে দিলেন বাবা। সহজেই গান তুলে নেওয়ার প্রতিভা রাণুর ছিল সেই বয়সেই। বাবার সুরে ও রেকর্ডে রাণু মুখোপাধ্যায়ের প্রথম গান 'মাসুম' ছবিতে শোনা গিয়েছিল ১৯৬০ সালে। এভাবেই খেলার ছলেই রাণুর গান শেখা। সেইসঙ্গে রক্তে তো গান ছিলই। মা বেলা মুখোপাধ্যায় আর বাবা হেমন্ত মুখোপাধ্যায় দুজনেই গানের জগতের দিকপাল।
হেমন্তর পরিবারে কন্যা সন্তান ই বেশি। একমাত্র পুত্র সন্তান হেমন্তর ছেলে জয়ন্ত। একমাত্র নাতিকে চোখে হারাতেন হেমন্তের মা। হেমন্তর বড়দার শক্তিদাসের ছয় মেয়ে। এক মেয়ে সুমিত্রা মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের গানে বিখ্যাত। কোন পুত্র সন্তান নেই। মেজ ভাই হেমন্তর মেয়ে রানু। সেজ ভাই তারাজ্যোতির একটিই মেয়ে শাশ্বতী। ছোট ভাই সুরকার অমল মুখোপাধ্যায়ের দুই মেয়ে পারমিতা ও মধুমিতা। সবে ধন নীলমণি জয়ন্ত। যদিও হেমন্তর বোন নীলিমার তিন মেয়ের সাথে এক ছেলে হয়। যদিও তাঁরা আলাদা গোত্রের।
অগ্রদূত পরিচালিত ছোটদের ছবি 'বাদশা'তে বাবার সুরে রাণুর গাওয়া তিনটি গান বিশাল জনপ্রিয় হয় মাস্টার শঙ্কর ঘোষের লিপে। 'লালঝুঁটি কাকাতুয়া', 'শোন শোন শোন মজার কথা ভাই' এবং 'পিয়ারিলালের খেলা দেখে যা'। 'লালঝুঁটি কাকাতুয়া' তো ঘুমপাড়ানি গানই হয়ে গেল ঘরে-ঘরে। আজও ছোটদের গান বললেই এক নম্বরে আসবে রাণুর গাওয়া 'লালঝুঁটি কাকাতুয়া ধরেছে যে বায়না, চাই তাঁর লাল ফিতে চিরুনি আর আয়না।'
হেমন্ত-কন্যা ছবিতে নায়িকা হওয়ারও অফার পেয়েছিলেন সেসবে আর এগোননি রাণু। ছোটবেলায় রাণু কিন্তু শিশুশিল্পী রূপে অভিনয়ও করেছেন হিন্দি ছবিতে, 'বন্ধন', 'অনুরাধা' এবং 'বিশ সাল বাদ'।
হেমন্ত-রাণু বাবা-মেয়ের জুটির দ্বৈতকণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ডও বেরিয়েছিল। 'অমল ধবল পালে লেগেছে' এবং 'এ পারে মুখর হল কেকা ওই'।
মহুয়া রায়চৌধুরীর লিপে 'আশীর্বাদ' ছবিতে 'ফুলের গন্ধের মতো তোমায় জড়িয়ে আমি রাখব' রাণু গেয়ে সেরা গায়িকার বিএফজেএ পুরস্কার পান। হেমন্ত চেয়েছিলেন তাঁর সুরে মহুয়ার লিপে অরুন্ধতী এবার নয় রাণু গাইবেন। কিন্তু আশীর্বাদ ই মহুয়ার শেষ ছবি হল নিয়তিতে। যে কারণে রাণু-মহুয়া জুটির গান হিট হয়েও পরে আর হলনা।
হেমন্তর মৃত্যুর পরও রাণু এ আর রেহমানের সুরে প্লে ব্যাক করেছিলেন রাম গোপাল ভার্মার দাউদ ছবিতে। গৌতম মুখোপাধ্যায়, রাণুর স্বামী অনেক গানেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রেকর্ডিংয়ে সহকারী সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। হেমন্ত চেয়েছিলেন তাঁর মেয়ে সারা জীবন গান নিয়েই থাকুক। রাণু মনে-প্রাণে আজও গান নিয়েই আছেন কিন্তু বহু যুগ তিনি গানের জগতের বাইরে। কেন এই অভিমান? নাকি গানের জগত বদলে যাওয়াতেই তাঁর এই অন্তরাল?
হেমন্তর মৃত্যুর পর গানের জগতের দরজা রাণুর জন্য বন্ধ হতে থাকে। নিজের খামখেয়ালি পোনা, কিছুটা বাবার মেয়ে স্টারডম প্রদর্শন কখনও বা একেবারেই উদাসনীতার থেকে লাইমলাইটের বাইরে বেরিয়ে যান রাণু। অন্তরা চৌধুরী আর রানু মুখোপাধ্যায়ের পরপর জন্মদিন। দুজনেই ছোটদের গানে অসম্ভব জনপ্রিয় হন। কিন্তু দুজনেরই গলার টেক্সচার দূর্দান্ত ছিল। রোম্যান্টিক গানে সেভাবে ব্যবহার করেননি ওঁদের কেউ। ছোটদের গানেই দুজনে টাইপকাস্ট হয়ে গেলেন। অন্তরা হাজার বাঁধা পেরিয়ে নিজের গানের ক্যারিয়ার বাঁচিয়ে রাখলেও রাণু সে পথে একেবারেই হাঁটেননি। যে কারণে অন্তরা আট থেকে আশির কাছে চেনা কন্ঠ হলেও রাণু হননি। বাবার প্রস্থানের পর বাংলার সুরকাররা রাণুকে সেভাবে গানও দেননি। বম্বে থেকেও হিন্দি গানে কাজে লাগেনি ওমন পপ গানের কন্ঠ। যদিও 'লাল ঝুঁটি কাকাতুয়া' র গানের আসল শিল্পী কে তাতে রাণু মুখোপাধ্যায়ের নাম আসবেই?
আজ জন্মদিনে ৬৬ বছরের রাণু কী আজও গেয়ে ওঠেন বাবার সুরে 'লাল ঝুঁটি কাকাতুয়া' ? কে জানে গুনগুন করেন কিনা যখন বেড়ান তিনি পাইন বনে!
কৃতজ্ঞতা শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন