সুদক্ষিণার আরেক নাম ছিল পূর্ণিমা। দাদা দিদিদের সাহচর্যে বড়ো হচ্ছিলেন পূর্ণিমা তথা সুদক্ষিণা। একটু বড়ো হওয়ার পরেই তাঁর রূপের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। আশ্চর্য এক সৌন্দর্য! পরিবারের মধ্যে তখন বেশ জল্পনা, এ মেয়ে তো রাজরানীর মতো রূপ নিয়ে এসেছে। সত্যিই রাজরানী হলেন।
পাত্র উত্তরপ্রদেশের হরদৈ জেলার জমিদার, পণ্ডিত জ্বালাপ্রসাদ পাণ্ডে। তিনি পারিবারিক দিক থেকে জমিদার হলেও একজন আই সি এস অফিসারও ছিলেন। ঠাকুরবাড়ির সুন্দরী মেয়ে সুদক্ষিণার যথার্থ দোসর। ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য মেয়েদের মতো ‘পুণ্য’ পত্রিকায় তিনিও লিখেছিলেন। তবে রান্নার লক্ষ্ণৌ প্রণালী নিয়ে। স্বামীর সঙ্গে দাম্পত্য জীবনে অত্যন্ত সুখী ছিলেন। জমিদারি পরিচালনা, ঘোড়ায় চড়া, বন্দুক ছোঁড়া, ইংরেজি ভাষাচর্চা — সবটাই স্বামীর সঙ্গেই আয়ত্ত করেছিলেন। মাত্র সাতাশ বছর বয়সে স্বামীকে হারিয়ে, বিরাট বৈভবের মধ্যে একলা হয়ে পড়েন তিনি। যেন রহস্যময় সৌরজগতে একলা চাঁদের আলো। সেইসময়ের এক বিধবা, নিঃসন্তান , সুন্দরী যুবতী!
ভেবেই নেওয়া হয়েছিল, পণ্ডিত জ্বালাপ্রসাদ পাণ্ডের জমিদারির অবশেষটুকুও থাকবে না। অথচ, গল্পটা ঠিক উল্টো হল। ঠাকুরবাড়ির এই মেয়েটি কলম ধরলেন না সেইভাবে। কিন্তু ঘোড়ায় চড়ে, হাতে বন্দুক নিয়ে জমিদারি এলাকা পরিদর্শন করে বেড়াতেন। অচিরেই তিনি নিজে হয়ে উঠলেন হরদৈ জেলার জমিদার। কাউকেই পরোয়া করতেন না সুদক্ষিণা। আসলে জীবন তাঁকে বেপরোয়া হতেই শিখিয়েছে। সুদক্ষিণার কীর্তির কথা বাংলাদেশে সুপরিচিত ছিল না। অথচ সুদূর উত্তরপ্রদেশে ঠাকুরবাড়ির একটি মেয়ে ঠিক চিত্রাঙ্গদার মতো স্নেহবলে মাতা ও বাহুবলে পিতা হয়ে উঠলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁদের বিপুল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে, এমনটাই ভেবেছিলেন সকলে। বিশেষ করে ব্রিটিশ সরকার। কিন্তু সকলের ধারণা মিথ্যে প্রমাণ করে বীরাঙ্গনার মতো ব্যক্তিত্ব নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালেন রানি সুদক্ষিণা। ঘোড়ায় চড়ে প্রজাদের দুঃখ দুর্দশার কথা শুনতে যেতেন। বিচার করতেন শক্ত হাতে। তাঁর আমলকে সকলে বলত, রামরাজত্ব!
বেশ কয়েকজন তেজস্বী ডাকাতকে নিয়ে রক্ষীবাহিনী তৈরি করেছিলেন তিনি। ইংরেজ সরকার রীতিমতো নাস্তানাবুদ হয়ে পড়েছিল। উত্তরপ্রদেশে তাঁকে ‘মুকুটহীন রানি’ বলা হত। ইংরেজ সরকার তাঁকে তিনবার ‘মহারানি’ খেতাব দিতে চেয়েছিল। তিনবারই পূর্ণিমা তা প্রত্যাখ্যান করেন। ‘ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল’ বইতে চিত্রা দেব এমন কথা লিখেছেন। বিদ্যার প্রতি অমোঘ টান থেকেই ভাষাকে সম্মান জানাতে পেরেছিলেন সুদক্ষিণা। উত্তরপ্রদেশের অনগ্রসর মেয়েদের জন্য একটি বালিকা বিদ্যালয়ও স্থাপন করেছিলেন। পূর্ণিমা নামে ‘দ্য ইন্ডিয়ান ভিলেজ গার্ল’ নামে একটি অর্কেস্ট্রায় সুরও দিয়েছিলেন। এখনও হয়তো উত্তরপ্রদেশের বুধাওন, হরদৈ জেলার অতীত স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছেন রানি সুদক্ষিণা, ঠাকুরবাড়ির একটি মেয়ে!
তথ্যসূত্র
ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল, চিত্রা দেব
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন