— এই বিট্টু, কোন কলেজে ভর্তি হলি?
— এই তো টেকনো ইন্ডিয়ায়।
— এহ, বেসরকারী কেন রে?
— আরে এইবার কলেজে ভর্তির ফর্ম ফিল আপটা কেমন যেন উল্টোপাল্টা টাইপের। তাই ভালো কলেজ পেলাম না। তাই বাধ্য হয়েই আর কি.. তুই কোন কলেজে পেলি?
— আমি তো সুরেন্দ্রনাথ কলেজে।
— বাঃ ভালোই।
— ভালো আর কোথায়...তোর কলেজে কত্ত মেয়ে শালা। টেকনোতে হেব্বি হেব্বি মেয়ে পড়ে। আমি রুখা-সুখা থাকব।
— আহা চাপ নিস না। তোর লাইন আমি লাগিয়ে দেব।
— এই নাহলে বন্ধু!!
আহঃ, এটাই তো প্রেমে পড়ার বয়স। আঠেরো উনিশ বছর বয়স। নতুন কলেজ। চারদিকে প্রেম যেন উড়ে বেড়াচ্ছে। প্রেম আর পলিটিক্সে ঢোকার এই তো উত্তম বয়স। এই বয়সে কলেজে উঠে শুরু হয় ইউনিয়ন। আর ইউনিয়নের একটু বড় পদে গেলে নাকি মেয়েদের লাইন লেগে যায়। চলো ফিরে যাওয়া যাক ১১৬ বছর আগে। মেদনীপুরের কলেজিয়েট স্কুলের এক স্টুডেন্ট। সে রামকে যতটা না চেনে তার চেনে বেশি চেনে সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে, ওর স্কুলের হেডমাস্টার। ছেলেটার জীবনে প্রেম এনেছিল ওই মাষ্টারমশাই, দেশপ্রেম। এখনকার ছেলেমেয়েরা প্রেম বলতে যা বোঝে তার চেয়ে অবশ্য অনেক বেশি কিছু। যাইহোক। ওর জীবনে প্রেম তো এলো। আর আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে গেল ওর জীবনে।
ইতিহাসের পাতায় সময়টা ১৯০৫ সাল, বাংলা মায়ের বুক চিরে দুভাগ করার জন্য ব্রিটিশ সরকার তখন প্রস্তুত। সারা বাংলায় চলছে বিপ্লব, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন। পূর্ববঙ্গ ও আসামের গভর্নর 'ফুলার' বিপ্লবী সন্দেহে সাধারণ ভারতবাসীর উপর অকথ্য নির্যাতন শুরু করেন। আর এদিকে বাংলার গভর্নর 'ফ্রেজার' ও শোষণ আর অত্যাচারের দিক দিয়ে কোনো অংশে পিছিয়ে ছিলেন না। বিপ্লবী 'যুগান্তর দলের' সদস্যরা এই দুই গভর্নর কে হত্যা করার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হন। এবার তাদের লক্ষ্য হয়ে ওঠে কলকাতা প্রেসিডেন্সির ম্যাজিস্ট্রেট, অত্যাচারী 'কিংসফোর্ড'। কিংসফোর্ড বিপ্লবীদের মূল লক্ষ্য হয়ে উঠেছেন এই সংবাদ পেয়েই ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাকে তড়িঘড়ি মুজাফফরপুর বদলি করে দেয় কিন্তু বিপ্লবীরা তাদের সিদ্ধান্ত থেকে পিছুপা হননি।
৩০ শে এপ্রিল ১৯০৮ বিহারের মোজাফ্ফরপুরে রাত্রি আটটা ত্রিশ মিনিটে রাতের অন্ধকারে, এক হাতে বোমা এবং অন্য হাতে পিস্তল নিয়ে, ১৮ বছরের ছেলেটা কিংসফোর্ডকে হত্যা করার জন্য অপেক্ষা করছিল, সঙ্গে ছিল দীনেশ। যখন তারা দেখল কিংসফোর্ডের গাড়ি আসছে, তখন বোমা ছুঁড়ে মারল আর সঙ্গে সঙ্গেই সেই গাড়ি জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেদিন সেই গাড়িতে কিংসফোর্ড ছিল না। সেইদিন সেই গাড়িতে ছিল, মিসেস কেনেডি ও তার কন্যা। ব্যস ইংরেজদের রাতের ঘুম উড়ে যায়।
সেই ছেলেটা আর দীনেশকে ধরার জন্য ইংরেজ সরকার একশত কুড়ি টাকা (বর্তমান মূল্যে প্রায় ১.২ কোটি) পুরস্কার ঘোষণা করে দেন। ছেলেটা এবং দীনেশ দুজনে আলাদা আলাদা রাস্তা অবলম্বন করলেন। কিন্তু তাঁরা দুজনেই ইংরেজদের কাছে ধরা পড়ে যান। ইংরেজদের হাতে পড়ার আগে দীনেশ পিস্তলের গুলিতে নিজেকে হত্যা করেন। তবুও ব্রিটিশ সরকারের হাতে ধরা দিলেন না। অন্য দিকে ছেলেটা ইংরেজদের কড়া পাহারা থাকা সত্ত্বেও পঁচিশ মাইল (প্রায় ৪০ কিমি) রাস্তা পায়ে হেঁটে ওয়াইনি রেল স্টেশনে এক চায়ের দোকানে জল খেতে ঢুকলে সেখানে তাকে দেখে ইংরেজদের সন্দেহ হয় এবং তাঁর দেহ তল্লাশি করে একটা পিস্তল ও ৩৭ রাউন্ড গুলি পায় এবং তাঁকে ইংরেজরা গ্রেফতার করে।
একটা কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার বয়সী ছেলের এতবড় সাহস!! আরেহ কোথায় সাহস দেখলেন?
ধরা পড়ার পর বোমা নিক্ষেপের সমস্ত দায় নিজের ওপর নিয়ে নেয় ছেলেটা। অন্য কোন সহযোগীর নাম বা কোন গোপন তথ্য শত অত্যাচারেও প্রকাশ করেননি। মজফফরপুর আদালতে ছেলেটার বিচার কাজ শুরু হলো ০৮ জুন ১৯০৮। কিন্তু সারা পশ্চিমবাংলা থেকে কোন আইনজীবী মামলায় আসামী পক্ষের হয়ে কোন আইনজীবী আদালতে দাঁড়াতে সাহস পাননি। তখন পূর্ব বঙ্গ থেকে রংপুর বারের উকিল সতীশ চন্দ্র চক্রবর্তী, কুলকমল সেন ও নগেন্দ্রনাথ লাহিড়ী ছেলেটার পক্ষে মামলায় পরিচালনায় এগিয়ে আসেন। ইতোমধ্যে বিচারকের অনুরোধে কালিদাস বসু নামে স্থানীয় এক আইনজীবী এগিয়ে আসেন আসামী পক্ষে। ৬ দিন চললো বিচার অনুষ্ঠান। বিচারের শুরুতেই ছেলেটা স্বীকার করে সবকিছু আর সব দোষ নিজের ঘাড়ে নেয়। ভারতীয় দণ্ডবিধি আইনের ৩০২ ধারা অনুযায়ী প্রানদণ্ডের রায় শোনার পরে দেখা যায় ছেলেটার মুখে হাসি। বিচারক কর্নডফ তাকে প্রশ্ন করেন, তাকে যে ফাঁসিতে মরতে হবে সেটা সে বুঝেছে কিনা? উত্তরে ছেলেটা শুধু হাসে। ১৯০৮ সালের ১১ আগষ্ট। ভোর চারটে। একজন পুলিশ তাকে জিজ্ঞেস করে:
-এখন ভোর চারটে। আর কিছুক্ষণ পরেই আপনার ফাঁসি হবে। ভয় করছে না?
- আমি গীতা পড়েছি। তাই মৃত্যুকে আমি ভয় করি না।
একজন আঠারো বছর আট মাসের ছেলের বলা। খুব ঔদ্ধত্য তাই না? আরেহ ঔদ্ধত্য কোথায় দেখলেন! ফাঁসিতে তোলার আগে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, তোমার শেষ ইচ্ছে কী? তার উত্তর ছিল, "আমি ভালো বোমা বানাতে পারি, মৃত্যুর আগে সারা ভারতবাসীকে সেটা শিখিয়ে দিয়ে যেতে চাই।
বিপ্লবীরা কোন দলের না, কোন গোত্রের না, যেখানে স্বৈরাচার সেখানেই বিপ্লবীরা সোচ্চার! ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতারা সব সময় ছিল, আছে। ওদের মেরে ফেললে বিপ্লব অবসম্ভবী! মৃত্যুঞ্জয়ীদের গুলি করে মারা যায় না তারা রক্তবীজের মত হাজার হাজার হয়ে ফিরে আসে।
.
.
. কলমে ✍️✍️✍️ সব্যসাচী
সংগৃহীত
ছবি - 🖼️ অলোক ভট্টাচার্য।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন