এ কী লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ (জীবনানন্দ দাশের সহধর্মিণী লাবণ্য দেবীকে নিয়ে লিখেছেন লেখিকা কবিতা সিংহ)
লম্বা ছিপছিপে উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ একটি মেয়ে। মুখের গড়ন লম্বা ধাঁচের। উজ্জ্বল চোখ, তীক্ষ্ণ নাক, পাতলা ঠোঁট। বয়স সতেরো আঠারো। ঢাকায় হস্টেলে থেকে পড়ত।
নাম লাবণ্য। ছোটবেলাতেই বাবা-মাকে হারিয়েছে। মানুষ হয়েছে জ্যাঠামশাই-এর কাছে।
তখনকার কালের ঢাকার কলেজের মেয়ে যেমন হত, ঠিক তেমন। বিপ্লবী দলের সঙ্গে গোপন সংযোগ, শরীরচর্চা, আবার নাচ গান অভিনয়ে ঝোঁক। মা-বাপ নেই বলে খুব স্পর্শকাতর—সেই লাবণ্যকে হঠাৎ একদিন জ্যাঠামশাই বাড়িতে ডেকে নিয়ে এলেন।
হস্টেল থেকে বাড়িতে আসতে এক মাঠ কাদা ভাঙতে হয়। পরনে নকশাপাড় তাঁতের সাধারণ শাড়ি। আসতেই জ্যাঠামশাই বললেন, বাড়িতে অতিথি এসেছেন চা জলখাবার এনে দাও। সেই কাদামাখানো শাড়ি পরেই লাবণ্য লুচি মিষ্টি চা নিয়ে এলেন বাইরের
ঘরে। অতিথির সংখ্যা মাত্র একজন। শ্যামবর্ণ, অতিসাধারণ ধুতি-পাঞ্জাবি পরা নতমুখী
একটি আটাশ-ঊনত্রিশ বছরের যুবক।
জ্যাঠামশাই পরিচয় করিয়ে দিলেন।
—ইনি দিল্লি থেকে এসেছেন। ওখানকার রামযশ কলেজে পড়ান। ইংরেজির অধ্যাপক।
আর এ আমার ভাইঝি লাবণ্য।
জীবনানন্দ দাশ চোখ তুলে নমস্কার করলেন।
সেদিন দুপুরে জ্যাঠামশাই লাবণ্যকে বললেন দিল্লি থেকে যে ছেলেটি এসেছিলেন,
তিনি তাঁকে দেখতেই এসেছিলেন। এবং যাবার সময় মনোনীত করে গেছেন। লাবণ্যের
কিন্তু তখন বিয়ে করতে একটুও ইচ্ছে নেই। সে সময়ে কারই বা থাকে। বিশেষ করে
সবে তখন কলেজে ঢুকেছে, সবে মুক্তির স্বাদ, সবে রাজনীতির রহস্যময় আস্বাদ—তখন
সব এত নতুন এত বৈচিত্র্যময়...জ্যাঠামশাই লাবণ্যকে জীবনের বাস্তব দিকগুলির কথাও
ভাবতে বললেন সেদিন। বাবা নেই, মা নেই। কেবল তিনিই সম্বল। আর জীবনানন্দ
কথা দিয়েছিলেন বিয়ের পরও লাবণ্য পড়বেন। তাছাড়া যখন জ্যাঠামশাই বলছিলেন—
‘মেয়েটা মা-বাপ মরা, একটু জেদি একটু আদুরে, ওকে তুমি ভালো করে দেখো'—
তখন ছেলেটির শান্তচোখে একটা আশ্বাসের ছায়া তিনি স্পষ্ট দেখেছেন। বিশেষ করে ছেলেটির শান্ত প্রকৃতিটিই তাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছিল।
লাবণ্য মত দিলেন।
সে বছরটা ১৯৩০ সাল।
সে সময়টা বৈশাখ।
সেদিন সন্ধ্যায় তাড়াহুড়ো করে বরিশালে বাড়ি, দিল্লির ছেলেটি ঢাকার এক শাড়ির
দোকানে ঢুকে জীবনে প্রথম একটি শাড়ি কিনল। আশীর্বাদের শাড়ি। সন্ধ্যায় আশীর্বাদ
হল। লাবণ্য হিন্দু কুলীন বাড়ির মেয়ে। মানুষ গিরিডিতে। তাঁর বিশেষ হিদুয়ানির সংস্কার
ছিল না। জ্যাঠামশাই ব্রাহ্মা ছিলেন। কিন্তু ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের মর্যাদা দিতেন বলেই তিনি লাবণ্যকে
জিজ্ঞেস করে নিলেন, বিয়ে কোন মতে হবে। ব্রাহ্ম বিবাহে লাবণ্যের আপত্তি হয় নি।
বিয়ের সময়ে জীবনানন্দর সঙ্গে এসেছিলেন বুদ্ধদেব বসু আর অজিত দত্ত। বিয়ের
অনেক রমণীয় স্মৃতির সঙ্গে স্বামীর একটি বন্ধুর স্মৃতিও কেন যেন গেঁথে গিয়েছিল তাঁর
মনে। বুদ্ধদেব ছোটখাট বুদ্ধিদীপ্ত উজ্জ্বল একটি যুবা তখন। স্বামী পরিচয় করিয়ে দিয়ে
বলেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রত্ন, পণ্ডিত ব্যক্তি। কিন্তু লাবণ্যর চোখে সুন্দর লেগেছিল
তাঁর প্রাণচাঞ্চল্য, আকর্ষণীয় কথা বলার ভঙ্গি, সহজ সাবলীল আচরণ। লাবণ্য দাশ
বললেন,—“সাধারণত ওঁর বন্ধুদের সামনে খুব একটা বেরোতাম না। কিন্তু বিয়ের দিনটি
থেকেই বুদ্ধদেববাবুকে আমি আমার স্বামীর বন্ধু, আমাদের বড় সুহৃদ বলে জেনেছি।
তিনি এলেই তাঁর কাছে এসে বসেছি। তাঁর পাণ্ডিত্য, কবিপ্রতিভা নামযশ কিছুই আমাদের
আর তাঁর মধ্যে কোনও আড়াল সৃষ্টি করেনি। বিয়ের দিনে দেখা সেই বুদ্ধিদীপ্ত মানুষটি—
আমার তরুণ স্বামীর তরুণ সঙ্গীটি আমার কাছে ওইভাবেই মুদ্রিত হয়ে গেছেন।”
বিয়ের পরে বরিশালে গেলেন বরবধূ। মস্ত সংসার। অনেকখানি ছড়ানো মেলা জায়গা
নিয়ে বড় বড় ঘর। কিন্তু মাটির ভিত। খড়ের আস্তর। শহর থেকে গিয়ে লাবণ্যর খানিকটা
অবাক লেগেছিল। ঢুকতেই ইতস্তত করছিলেন ঘরে। পরে সেই বড় বড় ঠান্ডা ঠান্ডা ঘর, আম, জাম, বট অশথের হিজলের ছড়ানো বড় বড় বাগান পুকুরের স্নিগ্ধতা লাবণ্য অনুভব করেছিলেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন