কিংবদন্তি চিত্রপরিচালক সত্যজিৎ রায় রসিকতার সুরে বলেছিলেন "মহানগর" ছবির জন্য বাঙালিরা তাঁকে যে প্রশংসা করেছেন তার তুলনা হয় না। সত্যি কথা হল ছবির শেষ দৃশ্যে চৌরঙ্গীর রাস্তার সাবেকি আমলের একটা ল্যামপোস্টের তিনটে হোল্ডারওলা এনামেলের তৈরি গোলাকার ল্যাম্প শেডের অবস্থা কার্যত বিতর্কে জড়িয়েছিলেন ছবির দর্শক থেকে সাধারণ মানুষ। মানিক বাবু হাসি চাপতে চাপতে বলেছিলেন " কাগজে কাগজে সে একেবারে জয়জয়কার মশাই। এমন নির্ভেজাল প্রশংসা আর কখনও এর আগে পাইনি "।
জয়পুরের অফিসে ঢুকলে বাঙালি ভদ্রলোক কে রাজস্থানী পিওন বললেন "সত্যদেও রাও"নামে একজন ফোন করেছিলেন। তিনি অফিসে এসে যেন একবার খাসাকোটি প্যালেসে ফোন করেন। একটু যেন ধাঁধার মত লাগছে,আর সে নিজে "সত্যদেও রাও"নামের কাউকে চেনেন না।যাই হোক ফোন করার অনুরোধ যখন এসেছ তখন পাল্টা ফোন করতে হয়। সেই সময় তাঁর জন্মান্তর প্রসঙ্গে একটি বই প্রকাশিত হয়।বইটি তিনি জয়পুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারাসাইকোলজি বিভাগের অধ্যক্ষ বিজ্ঞানী ড.হেমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গবেষণার ভিত্তিতে লিখেছিলেন।
পরামনোবিদ্যা সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে সিধু জ্যাঠা ফেলুদাকে যে ম্যাগাজিনটি ট্রেনে পড়ার জন্য দিয়েছিলেন সেটির জন্যই মানিকবাবু তাঁকে টেলিফোন করেছিলেন। হ্যাঁ লেখক ভদ্রলোক টেলিফোন ব্যাক করে শুনলেন গম্ভীর স্বরে উল্টোদিকের মানুষটি বলেছেন "হ্যাঁ আমি জয়পুরে 'সোনার কেল্লা'র শুটিং করতে এসেছি, আমার জন্মান্তরবাদের ওপরে কিছু বিদেশী ম্যাগাজিন চাই।
নিবন্ধের লেখক জ্যোতির্ময় দাশ লিখেছেন "মানিকদার কাছে গল্প শোনা এক বিরল সৌভাগ্যের মত।অমন জমিয়ে মজলিশি ঢংয়ে গল্প বলা আমি আর কারও কাছে শুনিনি"। রসিকতার সুরে বলেছিলেন "তবে বাঙালিদের মত অমন ইন্টেলেকচুয়াল দর্শক আর হুজুগে মানুষ আমি বিশ্বের কোথাও পাইনি "। সঙ্গে আরও কিছু বলেছিলেন সে গল্প না হয় আপাতত অন্যদিনের জন্য তোলা থাকুক।
"মহানগর "ছবির একটা গল্প বলেছিলেন মানিকবাবু। বলেছিলেন বাঙালিরা তাঁকে"মহানগরের "যে প্রশংসা করেছেন তার তুলনা হয় না। ছবির দুই মুখ্য চরিত্র মাধবী ও অনিল চট্টোপাধ্যায় অফিসপাড়া দিয়ে হাঁটছেন। সন্ধ্যা নেমে আসছে,অনিলের ব্যাঙ্ক ফেল করেছে, ওদিকে মাধবী চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন।সদ্য চাকরি হারানো স্বামী,স্ত্রী পাশাপাশি পথ চলতে চলতে শেষ সংলাপ বলে "এত বড় শহরে আমরা কী আবার চাকরি পাবো না"? তারা জনতার স্রোতে মিশে যায় আর ক্যামেরা চৌরঙ্গীর রাস্তার সাবেকি আমলের একটা ল্যামপোস্টের তিনটে হোল্ডারওলা এনামেলের তৈরি গোলাকার ল্যাম্প শেডে এসে ফ্রিজ হয়।
সিনেমার পর্দায় ক্লোজ আপ শটে দেখা গেল তিনটে বাল্বের মাত্র একটা জ্বলছে,আর একটায় বাল্ব আছে কিন্তু জ্বলছে না,আর তৃতীয় হোল্ডারে কোনও বাল্ব নেই।
তবে এই নিয়ে খবরের কাগজে উঠল আলোচনার ঝড়, সবাই মুক্তকণ্ঠে সত্যজিৎ রায়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। নানা ব্যঞ্জনায় হলেও লেখার সুর এক।কেউ লিখলেন সত্যজিৎ রায় ক্যালকাটা কর্পোরেশন কে যে ভাবে সাইলেন্টলি জুতো মারলেন তুলনা নেই।কেউ অতি উৎসাহে প্রশ্ন তোলেন একেবারে পুকুর চুরির মত ঘটনা ইন্সপেক্টররা সব বাড়িতে ঘুমোয়। অনেকেরই আফশোস রোজ অফিসে গেলেও এটা তারা খেয়ালই করেন নি। নরেন মিত্তিরের গল্পেও এই ঘটনা নেই, কিন্তু সত্যজিৎ রায় সকলের টনক নাড়িয়ে দিলেন।এই না হলে ওয়ার্ল্ড ফেমাস ডাইরেক্টর। মানিক বাবু হাসি চাপতে চাপতে বললেন " কাগজে কাগজে সে একেবারে জয়জয়কার মশাই। এমন নির্ভেজাল প্রশংসা আর কখনও এর আগে পাইনি।
পুস্তক ঋণ- শুটিংয়ের গল্প, সম্পাদনা: সন্দীপ রায়
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন