॥ কোনো এক গাঁয়ের বধুর কথা ॥
সালটা ১৯৪৫। তখন সদ্য বিবাহিত হেমন্ত ভবানীপুরের বাসার কাছে, ইন্দিরা সিনেমার উল্টো দিকে, ইন্দ্র রায় রোডে সস্ত্রীক বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকেন।
একদিন হঠাৎ সেখানে হাজির এক যুবক। এর আগে দেবব্রত বিশ্বাসের বাড়িতে ঐ যুবকের সাথে হেমন্ত বাবুর আলাপ হয়েছিল, তবে তেমন কিছু নয়! যুবক তখন আপিটিএর সঙ্গে যুক্ত। নতুন সুর করে। আর সেই তৈরি করা সুর আইপিটিএ-র ফাংশান স্কোয়াডেই এখানে ওখানে গেয়ে বেড়ায়। গ্রামোফোন কোম্পানিতে তখনও সুযোগ পায়নি।
যাইহোক সেদিন হেমন্ত বাবুকে ঐ যুবক বেশ কয়েকটা গান শোনালেন। প্রগ্রেসিভ গান, স্কোয়াড এর জন্য উপযুক্ত। কিন্তু সোলো রেকর্ড করার মতো নয়।
গান শুনে হেমন্ত বাবু বেশ প্রসংশাও করলেন, কিন্তু বললেন- "এসব গান তো আর রেকর্ড করা যাবে না, অন্য গান থাকে তো দাও।
সেই মুহূর্তে ঐ যুবকের অন্য কোন গান মনে পড়ছিল না। শেষে হেমন্ত বাবুর থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন, হেমন্ত বাবুও এগিয়ে দেওয়ার জন্য সিঁড়ি দিয়ে নামছেন, হঠাৎই ঐ যুবকের একটা আধখানা অসমাপ্ত গানের কথা মনে পড়ল।
সঙ্গে সঙ্গে সে হেমন্ত বাবুকে বলল— “হেমন্তদা, একটা অন্য ধরনের গানেরও সুর করেছি। আমারই লেখা। অবশ্য এখনও পুরোটা লেখা হয় নি। তা যেটুকু হয়েছে শোনাব?”
দুজনেই আবার ফিরে এলেন। ঐ আধখানা গান শুনে হেমন্ত বাবু বললেন- “রেকর্ড করার পক্ষে এটাই ঠিক গান! কিন্তু আরো বড় করতে হবে। কাহিনী-সংগীত যখন, রেকর্ডের দু’পিঠের মতো কথা বাড়াও। তাহলে খুব ভাল হবে। তুমি এটা তাড়াতাড়ি শেষ করে নিয়ে এসো।”
সেই রাতেই ঐ যুবক ঐ গানটা শেষ করে, বাকি অংশটা সুর করে কয়েকদিনের মধ্যেই হেমন্ত বাবুর হাতে তুলে দিলেন।
ওইসময় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বাজার দারুন। যে গানই করছেন, হটকেক! তবে এহেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুপারিশ সত্ত্বেও গ্রামোফোন কোম্পানি রেকর্ড করতে চায়নি সেই গান। তাদের বক্তব্য — এ সব পাঁচালি কে শুনবে? কে কিনবে?
অবশেষে গণনাট্য সঙ্ঘের রাজ্য কমিটির সদস্য তথা কোম্পানির রেকর্ডিং-ইন-চার্জ ক্ষিতীশ বসু মধ্যস্থতা করেন।
ইতিমধ্যেই কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষণা হয়েছে। ঐ যুবকের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি হয়েছে রাজনীতি করার ফলে। সুতরাং খানাতল্লাশি এড়াতে তিনি আত্মগোপন করলেন।
এদিকে সুরকারের অবর্তমানেই হেমন্ত বাবু গানটা রেকর্ড করলেন। যুবক সুরকারের ছকে দেওয়া যন্ত্রানুসঙ্গেই গানটি রেকর্ড করেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নিজেই।
কিছু দিনের মধ্যেই এইচএমভি-র শারদ অর্ঘ্যে ঠাঁই হয় সেই কালজয়ী গানের। তার পর যা হয়েছিল তা তো ইতিহাস! রেকর্ডটির দু'পিঠ জুড়ে গানটা রিলিজ করল।
এদিকে ঐ যুবক সুরকার-গীতিকার তখনও আত্মগোপন করেই আছেন। এ গান তিনি শুনেছিলেন ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ থেকে। সন্দেশখালিতে পার্টির গোপন ডেরায় বসে। এই সাফল্যে তিনি উল্লসিত হলেও তাঁর কমরেডরা হননি। গণনাট্য সঙ্ঘের যে সব সর্বভারতীয় সম্মেলনকে ‘আমার সংগীতের বিশ্ববিদ্যালয়’ বলতেন সলিল, সেই গণনাট্য সঙ্ঘের আসরে এ গান নিষিদ্ধ হয়েছিল।
তবে এই গানের মাধ্যমেই দিকে দিকে তার নাম ছড়িয়ে পড়ল। বাংলা গানের জগতে এক নতুন দিক নির্দেশ হল ঐ গানের মাধ্যমেই। সৃষ্টি হল এক নতুন জুটির।
সেদিনের ঐ যুবকের নাম সলিল চৌধুরী। আর সলিল চৌধুরী ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায় জুটি বাংলা গানের এক নবজাগরণ। আর এই জুটির সূচনাবিন্দুতে আছে প্রায় ছ’মিনিট দৈর্ঘ্যের এই গান—
“কোনো এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোনো,
রূপকথা নয় সে নয়।
জীবনের মধুমাসের কুসুম-ছিঁড়ে-গাঁথা মালা
শিশির-ভেজা কাহিনি শোনাই শোনো।”
সত্যি বলতে কি, একটা গানের মধ্যে যুগলক্ষ্মণ ফুটে ওঠার পাশাপাশি কী ভাবে যুগযন্ত্রণাও ফেটে বেরোতে পারে, ‘গাঁয়ের বধূ’ শোনার আগে বাঙালি জানত না। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলা জুড়ে যে দুর্ভিক্ষ হয়, যাকে ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ বলা হত আগে, যাকে ‘চার্চিলস সিক্রেট ওয়র’ বলার চল হয়েছে এখন, তাতে অন্তত ৫০ লক্ষ বাঙালির মৃত্যু হয়। ওই দুর্ভিক্ষ কী ভাবে বাংলার কৃষি অর্থনীতির ভিত চুরমার করে দিয়েছিল, তার ‘ব্যথার পাহাড়’ বয়ে এ গান তৈরি করেছিলেন সলিল চৌধুরী।
শিল্পবাণিজ্যের পরিভাষায় ‘গেম চেঞ্জার’ বলে একটা কথা আছে। নাগরিক বাঙালির শ্রবণবিশ্বে ‘গাঁয়ের বধূ’ গানটা তাই।
____________________________
©️ কিছু কথা ॥ কিছু সুর
কৃতজ্ঞতা: আনন্দবাজার পত্রিকা ও সারেগামা (HMV)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন