বারী সিদ্দিকী: এক বাঁশির যাত্রী, এক সুরের সাধক
(একটি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবন্ধ | A Tribute Feature by Labu Flutes)
নির্জন কোনো নদীর ধারে বসে কেউ যদি চোখ বন্ধ করে শুনে, হঠাৎ কোথা থেকে যেন এক বাঁশির করুণ ধ্বনি ভেসে আসে—তাহলে ধরে নেওয়া যায়, সে সুরের উৎস বারী সিদ্দিকীর আত্মা থেকে নিঃসৃত। তাঁর বাঁশির আওয়াজ ছিল কেবল সঙ্গীত নয়, ছিল ধ্যান, সাধনা, কান্না আর প্রেমের গভীর ভাষ্য।
@
১৯৫৪ সালের ১৫ নভেম্বর নেত্রকোণার এক সংগীতপ্রবণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন বারী সিদ্দিকী। তাঁর পিতা মোসলেহ উদ্দিন ছিলেন এক সংস্কৃতিমনস্ক ব্যক্তি, যিনি নিজেই সংগীত চর্চা করতেন। ছোটবেলায় বাড়ির উঠানে বাউলদের আসর বসত, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সেসব লোকজ সুর গেঁথে যেতে থাকে তাঁর হৃদয়ে। ছয়-সাত বছর বয়স থেকেই বাঁশির প্রতি দুর্নিবার টান অনুভব করতেন তিনি—মনে হতো, এই যন্ত্রের মধ্যেই যেন তার আত্মার আত্মীয় বাস করে।
তবে বারী সিদ্দিকী কেবল স্বভাবগত প্রতিভাই ছিলেন না—তিনি পরিশ্রমী, নিবেদিতপ্রাণ এবং শুদ্ধ সংগীতের এক অস্থির খোঁজাখুঁজির যাত্রী। ১৯৮১ সালে শুরু করেন গুরুপরম্পরায় প্রাতিষ্ঠানিক সংগীতশিক্ষা। তাঁর ভাগ্যবান শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন পণ্ডিত ভিষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় (কলকাতা), যিনি তাঁকে হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতের মাধুর্য, রাগভিত্তিক সুরের গঠন এবং অলঙ্কারিকতা শেখান। তাঁর আরও এক গুরু ছিলেন উস্তাদ আমিনুর রহমান, যিনি লোকগান ও শাস্ত্রীয় সংগীতের এক ভিন্ন মিশ্রণে বারী সিদ্দিকীকে দীক্ষা দেন।
বারী সিদ্দিকীর সংগীত জীবনের সবচেয়ে হৃদয়স্পর্শী অধ্যায়গুলোর একটি ছিল তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক উস্তাদ লাবু মিয়া–এর সঙ্গে, যিনি Labu Flutes-এর প্রতিষ্ঠাতা। লাবু মিয়া ছিলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত বাঁশিশিল্পী ও বাঁশি নির্মাতা। দুজনেই ছিলেন সুরের সাধক, দুই ভিন্ন পথে হাঁটলেও গন্তব্য ছিল এক—সত্যিকারের সুরের সন্ধান।
উস্তাদ লাবু মিয়া বারী সিদ্দিকীর জন্য বহু বিশেষ বাঁশি নির্মাণ করেছিলেন—প্রতিটি বাঁশি ছিল হাতে বানানো, তাঁর নিখুঁত বাজানোর কৌশল অনুযায়ী। কখনো ছিল মিহির ঘরানার স্টাইল, কখনো লোকগানের ঝোঁক—এই প্রতিটি বাঁশিই লাবু মিয়ার নির্মাণশৈলীতে ছিল স্বতন্ত্র।
বারী সিদ্দিকীর সংগীতজীবন যেন এক বহতা নদীর মতো—লোকসংগীত, বাউল, শাস্ত্রীয় ও আধুনিক সকল ধারায় ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। তাঁর কণ্ঠ ছিল বাঁশির মতোই—কখনো করুণ, কখনো দার্শনিক, কখনো প্রেমময়। "শুয়োরে ভাই", "আমার গায়ে যত দুঃখ সয়", "মানুষ ধরলে সোনার মানুষ" "সাদা পাতায় কালো দাগ", শুয়া চান পাখি, পূবালি বাতাসে –এমন অসংখ্য গান তিনি উপহার দিয়েছেন, যেগুলো আজও বাংলার সুরের ভাণ্ডারে অমূল্য সম্পদ।
একজন বাঁশিশিল্পী হিসেবে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো—তিনি বাঁশিকে জনপ্রিয় করলেন সেই শ্রোতামহলের কাছে, যারা আগে কেবল গায়ক-কেন্দ্রিক সংগীতকেই প্রাধান্য দিত। তাঁর হাত ধরে বাঁশি হয়ে উঠল জনতার সংগীতযন্ত্র।
বারী সিদ্দিকীর সংগীতচর্চা কখনো নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি অনেক শিষ্যকে দীক্ষা দিয়েছেন, সংগীত বুঝতে শিখিয়েছেন।
২০১৭ সালের ২৪ নভেম্বর রাতে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই মহান শিল্পী। তিনি শেষ দিন পর্যন্ত সংগীতচর্চায় ব্যস্ত ছিলেন, এমনকি মৃত্যুর কিছুদিন আগেও এক বন্ধুকে বলেছিলেন,
“সুরটাই তো আমার জীবনের কথা—আমি মরবো, কিন্তু আমার বাঁশি থাকবে, গাইবে।”
🌟 নির্বাসিত দেহ, অনন্ত সুর
আজ বারী সিদ্দিকী নেই, কিন্তু তাঁর বাঁশির সুর, তাঁর গানের শব্দ, তাঁর চোখ বন্ধ করে বাজানোর যে নিবেদন—তা রয়ে গেছে বাংলার প্রতিটি হৃদয়ে। তাঁর আত্মা আজও ভেসে বেড়ায় Labu Flutes-এর কোনো এক বাঁশির শরীরে।
📯 Labu Flutes এই মহান সুরসাধককে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করে।
“বারী সিদ্দিকী ছিলেন আমাদের সময়ের আত্মার বাঁশি।”
এই লেখা Labu Flutes-এর পক্ষ থেকে রচিত। 🎶
যদি আপনার ভালো লেগে থাকে, তবে দয়া করে কমেন্ট করতে ভুলবেন না, আর বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে দিন
#BariSiddiqui #LabuFlutesFeature #BanglaSurerGorbo #FluteLegacy #Mihargarana #UstadLabuMiah #BanglaMusicHistory
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন