ক্রোমোজোম আবিস্কার ও মাইটোসিস গবেষণার পথিকৃৎ বিজ্ঞানী ওয়াল্টর ফ্লেমিং
তিনি গ্রেগর জোহান মেন্ডেলের প্রায় সমসাময়িক বিজ্ঞানী ছিলেন । কিন্তু মেন্ডেলের বংশগতি সঙ্ক্রান্ত গবেষণা সম্বন্ধে কিছুই জানতেন না।কারণ ২০ বছরের বেশি সময় ধরে মেন্ডেলের গবেষণার কথা কারো জানা ছিল না। কিন্তু তিনি নিজের মতো করে বংশগত বৈশিষ্ট্য কীভাবে এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চারিত হয় তা নিয়ে গবেষণা করেন।
আবার কোষের কোষ বিভাজন ও ক্রোমোজোম নিয়ে গবেষণার তিনি অন্যতম পথিকৃৎ। তিনি ওয়াল্টর ফ্লেমিং (Walther Flemming ,1843-1905)।
ফ্লেমিং প্রথম ব্যক্তি যিনি কোষবিদ্যার (cytology) গবেষণার করতে গিয়ে কোষ বিভাজন ও ক্রোমোজোম নিয়ে গবেষণায় জীবনের বেশি সময় ব্যয় করেছিলেন । যদিও ১৮৪২ সালের প্রথম দিকে কার্ল নাগেলি (Carl Nageli) কোষ বিভাজন সম্বন্ধে ধারণা দিয়েছিলেন , যিনি ভেবেছিলেন কোষ বিভাজন একটি অস্বাভাবিক ঘটনা। তবে ফ্লেমিংই প্রথম মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় ক্রোমোজোমের গতিপ্রকৃতির বিস্তারিত বিবরণ দেন।
১৮৭৯ সালে অ্যানিলিন ডাই (aniline dyes, coal tar এর বাইপ্রোডাক্ট ) নামক বিশেষ রঞ্জক ব্যবহার করে ফ্লেমিং স্যালাম্যান্ডার এর ভ্রূণ কোষের নিউক্লিয়াসের মধ্যে বিশেষ এক ধরনের সুতোর ন্যায় গঠন (threadlike material) পর্যবেক্ষণ করেন । বেসোফিলীয় ডাইকে যা তীব্রভাবে শোষণ করতে সমর্থ হয়। তিনি তার নাম দেন ক্রোমাটিন (chromatin) ।
দেহকোষ বিভাজনের (somatic cell division) সময় কোষের নিউক্লিয়াসে তিনি কিছু তুলনামূলক মোটা কয়েকটি সুতোর মতো গঠন পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি মনে করেন, কোষের নিউক্লিয়াসে থাকা ওই সুতোর মতো গঠনগুলোর সাথে তাঁর আবিস্কৃত ক্রোমাটিনের কোনো না কোনো সম্পর্ক রয়েছে। পরবর্তীতে শারীরতত্ত্ববিদ ভিলহেল্ম ফন ওয়ালদেয়ার হার্টজ ( Wilhelm von Waldeyer-Hartz 1841–1923) । সেগুলোর নাম দেন ক্রোমোজোম ( রঞ্জিত। বস্তু )।
ফ্লেমিং ১৮৮২ সালে আবিষ্কার করেন ক্রোমোজোম (যদিও ক্রোমোজোম নাম দেন ওয়ালদেয়ার)। এই ক্রোমোজোম বংশগত বৈশিষ্ট্যের ধারক বাহক। তিনি দেহকোষ বিভাজনের সময় কোষের নিউক্লিয়াসের মধ্যে ক্রোমোজোম কেমন আচরণ করে তা প্রথম পর্যবেক্ষণ করেন। ফ্লেমিং দেহ কোষ বিভাজন কীভাবে হয় তা নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেছিলেন।
দেহকোষের এই বিভাজন পদ্ধতিকে তিনি মাইটোসিস (mitosis) নাম দেন।
এছাড়াও তিনি অপত্য কোষে ক্রোমোজোমের বণ্টন প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করেন। তবে অপত্য ক্রোমাটিড (chromatid) সমভাগে দ্বিবিভাজিত হওয়ার প্রক্রিয়া ফ্লেমিং পর্যবেক্ষণ করেননি। সামুদ্রিক সালামান্ডার মাছের কোষের ভ্রূণে ফ্লেমিং মাইটোসিস প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করেন।
১৮৮২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সাড়া জাগানো বই জেলসাবস্টাঞ্জ কার্ন উন্ড জেলথেইলাং (Zell-substanz, Kern und Zelltheilung )।এই গ্রন্থে কোষের গঠন, কোষের নিউক্লিয়াস ও কোষ বিভাজন সম্বন্ধে বিস্তারিত লেখেন।
কোষ নিয়ে তাঁর গবেষণার ভিত্তিতে তিনি বলেন, ভারচুর ওমনিস সেলুলা ই সেলুলা মানে কোষ হতেই কোষের উৎপত্তি ঘটে।আর বলেন নিউক্লিয়াস থেকেই নিউক্লিয়াস সৃষ্টি হয় ("ওমনিস নিউক্লিয়াস ই নিউক্লিও")।
মানবতার মুখ ফ্লেমিং
ওয়াল্টর ফ্লেমিং তাঁর জীবনে মানবিক মূল্যবোধকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি প্রতি সপ্তাহে গৃহহীন দরিদ্র মানুষজনকে খাওয়াতেন। তিনি যা উপার্জন করতেন, তার কুড়ি শতাংশ অর্থ গরিব গৃহহীন মানুষকে দান করে দিতেন। দারিদ্র্যের কারণে যেসব শিশু বিদ্যালয়ে যেতে পারত না, তিনি তাদের গণিত ও বিজ্ঞান পড়াতেন।
বংশগতিবিদ্যার উপর গ্রেগর জোহান মেন্ডেল যে কাজ করেছিলেন, ফ্লেমিং সে সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। তাই ফ্লেমিং তার নিজস্ব পর্যবেক্ষণ ও জিনগত উত্তরাধিকারের মধ্যে কোনো সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেননি। দুই দশক পরে যখন মেন্ডেলের সূত্র পুনরাবিষ্কৃত হয় , তখন ওয়াল্টার ফ্লেমিংয়ের মাইটোসিস তত্ত্বের তাৎপর্যও সবাই অনুধাবন করতে সক্ষম হয়।
সায়েন্স চ্যানেল ফ্লেমিংয়ের মাইটোসিস তত্ত্ব ও ক্রোমোজোম আবিস্কারের ঘটনাকে বিজ্ঞানের সেরা একশ আবিষ্কারের একটি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।আর তাঁর এই আবিস্কার জীববিজ্ঞানের দশটি গুরুত্বপূর্ণ আবিস্কারের একটি বলে অভিহিত করে।
ওয়াল্টর ফ্লেমিং এর জন্ম হয় ১৮৪৩ সালের ২১ শে এপ্রিল, জার্মানির মেকলেনবার্গ এ।মৃত্যু হয় ১৯০৫ সালের ৪ আগস্ট।ো
আজ ২১ এপ্রিল এই মহান বিজ্ঞানীর জন্মদিনে তাঁকে অসীম শ্রদ্ধা জানাই 🙏।
লেখা -পঞ্চানন মণ্ডল ।। বিজ্ঞানকথা ।। ২১০৪২০২৩
#আবিষ্কারেরকথা #বিজ্ঞানীরজন্মদিনেশ্রদ্ধাঞ্জলি
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন