ভাত থেকে পূর্ন পুষ্টি পেতে আঁশযুক্ত চাল খাবেন, সুগারের লেবেল বাড়াতে সাদা চাল খাবেন।
এই নিয়ে Haal Fashion আলমগীর আলম ভাইয়ের লেখা
আপনিই ঠিক করুন, কোনটা খাবেন, সাদা না আঁশযুক্ত চাল?
বাঙালির ভাত ছাড়া চলে না। কিন্তু সেই ভাতেও ঢুকেছে নানা কিছু। চাল আর আগের মতো নেই। চাল নিয়ে তাই অভাব নেই বিড়ম্বনার। তবু জেনে রাখা ভালো, কোন চাল কার জন্য আদর্শ।
আমরা ভেতো বাঙালি। ভাত আমাদের প্রধান খাদ্য। ধান থেকে ভাত আর সেই ভাত থালায় আসা পর্যন্ত কয়েকটি ধাপ পার করে আসতে হয়। আমাদের ভেতর প্রচুর আলোচনা আছে যে লাল চাল খান, সাদা চাল বাদ দেন। আসলে সাদা চাল আর আঁশযুক্ত লাল চালের মধ্যে অনেক কিছুরই ফারাক আছে। আবার সাদা চাল যে একদমই ভালো নয়, সেটাও ঠিক নয়। বিষয়টি বোঝার জন্য কিছু তথ্য দেওয়া হলো। এতে করে আপনার পরিবারের জন্য চাল বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা সহজ হবে।
প্রক্রিয়াকরণের কারণে চালের গুণ!
সাদা চাল: ধান থেকে চাল তৈরির সময় মিলিং ও পলিশিং প্রক্রিয়ায় বাইরের আঁশ (bran), জীবাণু (germ), এবং কখনো কখনো অ্যালিউরন স্তর (aleurone layer) সরিয়ে ফেলা হয়। এটি চালকে সাদা, মসৃণ এবং দ্রুত রান্নার উপযোগী করে, কিন্তু পুষ্টি উপাদানের বড় অংশ হারিয়ে যায়।
আঁশযুক্ত চাল: কেবল বাইরের খোসা (husk) সরানো হয়, কিন্তু আঁশ ও জীবাণু অক্ষত থাকে। এটি ব্রাউন রাইস, লাল বা কালো হতে পারে। যার রং আঁশে থাকা উপাদানের ওপর নির্ভর করে। এসব স্তরই এটিকে পুষ্টির দিক থেকে সমৃদ্ধ করে।
পুষ্টি উপাদানের তুলনা
কার্বোহাইড্রেট ও গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (জিআই)
• সাদা চাল: প্রতি ১০০ গ্রামে প্রায় ২৮৩০ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট থাকে, যার বেশির ভাগই সাধারণ শর্করা। এর জিআই ৭০৮৯। অর্থাৎ, এটি দ্রুত হজম হয়ে রক্তে শর্করার মাত্রা দ্রুত বাড়ায়। এটি ইনসুলিন স্পাইক সৃষ্টি করতে পারে, যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য সমস্যা হতে পারে।
• আঁশযুক্ত চাল: প্রতি ১০০ গ্রামে ২৩২৬ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, কিন্তু আঁশের উপস্থিতির কারণে হজম হয় ধীরে। জিআই ৫০৫৫, যা রক্তে শর্করা ধীরে ধীরে বাড়ায় এবং ইনসুলিনের প্রতিক্রিয়া স্থিতিশীল রাখে। গবেষণায় দেখা গেছে, নিম্ন জিআইয়ের খাবার দীর্ঘ মেয়াদে ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
আঁশ
• সাদা চাল: প্রতি ১০০ গ্রামে মাত্র ০.৪০৬ গ্রাম আঁশ। এটি হজম দ্রুত করে, কিন্তু কোষ্ঠকাঠিন্য বা অন্ত্রের স্বাস্থ্যের জন্য খুব উপকারী নয়।
• আঁশযুক্ত চাল: প্রতি ১০০ গ্রামে ১.৮৩৫গ্রাম আঁশ (ব্রাউন রাইসে ১.৮ গ্রাম, লাল চালে আরও বেশি হতে পারে)। আঁশ অন্ত্রের উপকারী ব্যাকটেরিয়াকে পুষ্টি দেয়, কোলন ক্যানসারের ঝুঁকি কমায় এবং দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা রাখে।
ভিটামিন
• সাদা চাল: প্রক্রিয়াকরণে বি ভিটামিন (B1, B3, B6) অনেকটাই হারিয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, থায়ামিন (B1) প্রতি ১০০ গ্রামে মাত্র ০.০৭ মিলিগ্রাম থাকে। তবে ফর্টিফায়েড সাদা চালে কৃত্রিমভাবে এগুলো যোগ করা হয় (যেমন ০.২০৪ মিলিগ্রাম)।
• আঁশযুক্ত চাল: প্রাকৃতিকভাবে বি ভিটামিনসমৃদ্ধ। থায়ামিন ০.৪ মিলিগ্রাম, নিয়াসিন (B3) ৪.৩ মিলিগ্রাম এবং ভিটামিন B6 ০.৫ মিলিগ্রাম থাকে। এগুলো শক্তি উৎপাদন, স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকারিতা এবং লাল রক্তকণিকা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ।
খনিজ
• সাদা চাল: ম্যাগনেসিয়াম (২৫ মিলিগ্রাম), ফসফরাস (৪৩ মিলিগ্রাম) ও আয়রন (০.৮ মিলিগ্রাম) কম থাকে। প্রক্রিয়াকরণে এগুলোর ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ হারিয়ে যায়।
• আঁশযুক্ত চাল: ম্যাগনেসিয়াম (৮৪ মিলিগ্রাম), ফসফরাস (১৫০ মিলিগ্রাম), আয়রন (১.৫ মিলিগ্রাম) ও ম্যাঙ্গানিজ (১.১ মিলিগ্রাম) বেশি। ম্যাগনেসিয়াম হাড়ের স্বাস্থ্য ও বিপাকের জন্য, আয়রন রক্তাল্পতা প্রতিরোধে এবং ম্যাঙ্গানিজ অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট এনজাইমের কার্যকারিতায় সহায়ক।
অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট
• সাদা চাল: প্রায় কোনো অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট থাকে না।
• আঁশযুক্ত চাল: ফেনলিক যৌগ (যেমন ফেরুলিক অ্যাসিড), ফ্ল্যাভোনয়েড ও অ্যান্থোসায়ানিন (লাল/কালো চালে) থাকে। উদাহরণস্বরূপ, লাল চালে অ্যান্থোসায়ানিন প্রতি ১০০ গ্রামে ১০ থেকে ১৫ মিলিগ্রাম হতে পারে, যা প্রদাহবিরোধী এবং ক্যানসারপ্রতিরোধী।
প্রোটিন
• সাদা চাল: প্রতি ১০০ গ্রামে ২.৭ গ্রাম প্রোটিন।
• আঁশযুক্ত চাল: প্রতি ১০০ গ্রামে ৩৩.৫ গ্রাম। পার্থক্য কম, তবে আঁশযুক্ত চালে অ্যামিনো অ্যাসিডের গুণগত মান কিছুটা ভালো।
ফ্যাট
• সাদা চাল: প্রায় ০.৩ গ্রাম (বেশির ভাগই স্যাচুরেটেড ফ্যাট)।
• আঁশযুক্ত চাল: ০.৯১ গ্রাম (অধিকাংশই অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড, যা হৃৎপিণ্ডের জন্য ভালো)।
বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও প্রভাব
• ডায়াবেটিস: ২০১০ সালে আর্কাইভস অব ইন্টারনাল মেডিসিনে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, সপ্তাহে পাঁচবার সাদা চাল খাওয়ার তুলনায় আঁশযুক্ত চাল খেলে টাইপ–টু ডায়াবেটিসের ঝুঁকি ১৬% কমে।
• হৃদ্রোগ: আমেরিকান জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশন (২০১৬) অনুসারে, আঁশযুক্ত চালে থাকা আঁশ ও ম্যাগনেসিয়াম এলডিএল কোলেস্টেরল কমায় এবং হৃদরোগের ঝুঁকি ২০ থেকে ৩০ শতাংশ হ্রাস করে।
• ওজন নিয়ন্ত্রণ: আঁশের কারণে আঁশযুক্ত চাল বেশি তৃপ্তি দেয়, যা ক্যালরি গ্রহণ কমাতে সাহায্য করে। ২০১৮ সালের নিউট্রিশন রিভিউয়ের একটি সমীক্ষায় এটি নিশ্চিত হয়েছে।
• অন্ত্রের স্বাস্থ্য: আঁশ অন্ত্রে প্রিবায়োটিক হিসেবে কাজ করে, যা গাট মাইক্রোবায়োমের ভারসাম্য রক্ষা করে।
সুবিধা ও অসুবিধা
সাদা চাল
সুবিধা: দ্রুত রান্না হয়, মিষ্টি স্বাদ, হজমে সহজ।
অসুবিধা: পুষ্টি কম, উচ্চ জিআই, দীর্ঘ মেয়াদে স্বাস্থ্যঝুঁকি।
আঁশযুক্ত চাল
সুবিধা: পুষ্টিসমৃদ্ধ, দীর্ঘ মেয়াদে স্বাস্থ্যের জন্য ভালো, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়।
অসুবিধা: রান্নায় সময় বেশি লাগে, স্বাদে কিছুটা কড়া, হজমে সময় লাগে।
কার জন্য কোনটি উপযোগী?
সাদা চাল: শিশু, বয়স্ক বা দুর্বল হজমশক্তির মানুষ ও অসুস্থ ব্যক্তি এবং যাঁরা দ্রুত শক্তি চান, তাঁদের জন্য উপযোগী।
আঁশযুক্ত চাল: ডায়াবেটিস, হৃদ্রোগ বা ওজন নিয়ন্ত্রণে আগ্রহী, স্বাস্থ্যসচেতন মানুষের জন্য উপযোগী।
আপনার খাদ্যাভ্যাস ও স্বাস্থ্যের ওপর ভিত্তি করে এগুলো বেছে নিতে পারেন।
লেখক: খাদ্য ও পথ্যবিশেষজ্ঞ;
প্রধান নির্বাহী, প্রাকৃতিক নিরাময় কেন্দ্র
#alamgiralam
#আলমগীরআলম
#lifestyle
#seeds
#yogalifestyle
#oil
#rice
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন