মৃত্যুর জন্য তাঁর হাতে সময় ছিল মাত্র পাঁচ মিনিট। ফায়ারিং স্কোয়াডের মুখে দাঁড়িয়ে এই পাঁচ মিনিট সময়কেই সে নিখুঁতভাবে ভাগ করে নিলো। প্রথম দুই মিনিট খরচ করা হবে তাঁর সাথেই ফায়ারিং স্কোয়াডে দাঁড়ানো বন্ধুদের কাছে থেকে বিদায় নিতে। পরের দুই মিনিট সে ভাববে নিজের সমগ্র জীবন নিয়ে। আর অবশিষ্ট এক মিনিট শেষবারের মতো দেখে নেবে এই প্রিয় পৃথিবীকে।
কিন্তু ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে সেই পাঁচ মিনিটই তাঁর কাছে মনে হচ্ছিল অন্ততকাল। সবার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে, নিজের জীবনের সব উল্লেখযোগ্য স্মৃতি রোমন্থন করেও পৃথিবী দেখার শেষ এক মিনিট সে কিছুতেই শেষ করতে পারছিল না। সময় এতোটাই ধীর গতিতে আগাচ্ছিল যে, যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে সে বলে উঠেছিল- ‘আমাকে তাড়াতাড়ি গুলি করো! আর সহ্য হচ্ছে না!’
এই অভিজ্ঞতা রাশিয়ান ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার 'ফিয়োদর দস্তয়েভস্কি'র। তাঁর কাছে শেষ একটি মিনিট এক অসহ্য অনন্তকাল হয়ে উঠেছিল।
সেইন্ট পিটার্সবার্গ, ১৮৪৯ সাল। আট মাস ধরে তিনি জেলে বসে অপেক্ষা করেছিলেন ফায়ারিং স্কোয়ারের সামনে দাঁড়ানোর আশঙ্কা নিয়ে। প্রথম দিকে তিনি আশায় ছিলেন, ঘটনাটা বোধহয় ঘটবে না। পরবর্তীতে তিনি মনস্থির করে নেন, যখন হবে তখন দেখা হবে। শেষের দিকে তিনি চাইছিলেন ঘটনাটা এখনই ঘটে যাক, যত তাড়াতাড়ি হয় ততই মঙ্গল। কারণ মৃত্যুর থেকেও মৃত্যুর এই প্রতীক্ষা আরও অসহ্য।
অবশেষে যন্ত্রণামুক্তি। একদিন সকালে হঠাৎই অন্যান্য সহবন্দীদের সঙ্গে তাকেও শেকলে বেঁধে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হল সেমোনোভস্ক চত্ত্বরে,নেভার কিনারায়।
কমান্ডারের কণ্ঠে বাজল প্রথম নির্দেশ। বন্দুকধারী সেপাইরা মৃত্যুপথযাত্রীদের চোখ বেঁধে দিল। দ্বিতীয় নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গে সবগুলো বন্দুক থেকে 'কক' করার ক্লিক-ক্ল্যাক শব্দ ভেসে এল। তৃতীয় নির্দেশ এল। 'লক্ষ্য স্থির করো'। শেষবারের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা, গোঙ্গানি, ফুঁপিয়ে কান্না...। তারপর সব চুপচাপ।
নীরবতা।
আরও নীরবতা। মনে হচ্ছিল যে এই নৈশব্দ আর ফুরোবেই না। শেষে তাদের বলা হল, রাশিয়ার মাহান সর্বশক্তিমান জার, পরম করুণাময় তিনি তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন।
১৮৪৮ সালের কোনো একটা সময় থেকে তিনি বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী পেত্রাশেভস্কির প্রগতিশীল পাঠচক্রে যাতায়াত শুরু করেন। পরে পেত্রাশেভ্ স্কির জনৈক সহযোগী পরিচালিত গোপন বিপ্লবী সংগঠনে যোগদান করে নিষিদ্ধ সাহিত্য ছাপিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজে উৎসাহিত হয়ে পড়েন। এক বছর এই কাজ করার পর ১৮৪৯ সালের এপ্রিল মাসে পেত্রাশেভ্ স্কির পাঠচক্রের অন্য ২১ জন সদস্যের সঙ্গে ফিয়োদর দস্তয়েভস্কি গ্রেপ্তার হন। বিচারাধীন বন্দি হিসেবে তাঁকে পিটার-পল কারাদুর্গের নির্জন ঘরে আট মাস বন্দি করে রাখা হয়। বিচারে অন্যদের সাথে তাঁকেও প্রাণদন্ডে দন্ডিত করা হয়।
১৮৪৯ সালের ২২ ডিসেম্বর। হাড়কাঁপানো শীতের ভোরে দস্তয়েভস্কিকে অন্যান্যদের সঙ্গে বধ্যভূমিতে উপস্থিত করা হয়। কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে মন্ত্র পাঠ করিয়ে তাঁকে বন্দুকের সামনে দাঁড় করানো হয়। জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে মাত্র কয়েক মুহূর্তের ব্যবধান। এই সময় জার প্রথম নিকোলাইয়ের দূত ঘোড়া ছুটিয়ে হাজির হয় ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে। জারের নির্দেশে সমস্ত বুদ্ধিজীবী রাজদ্রোহীদের মৃত্যুদন্ড রদ করে সশ্রম কারাদণ্ডে দন্ডিত করা হয়। দস্তয়েভস্কিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সাইবেরিয়ার বন্দি শিবিরে। সেইদিন সন্ধ্যায় দাদা মিখাইলকে লেখা চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন,
"আমি হতাশ হইনি, ভেঙে পড়িনি। জীবন সর্বত্রই জীবন, বাইরের নয়, আমাদের নিজেদের ভিতরের জীবন। আমার আশেপাশে মানুষজন থাকবে, মানুষের মাঝখানে মানুষ হয়ে থাকা, যত বড়ো সংকটই দেখা দিক না কেন, চিরকাল মানুষ হয়ে থাকা, হতাশ না হওয়া, ভেঙে না-পড়া -- এই হল জীবন, এই হল জীবনের লক্ষ্য।"
পরবর্তী কালে সমস্ত লেখায় তাঁর এই জীবন অভিজ্ঞতা গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। চার বছর নির্বাসন দন্ড ভোগ করার পর ১৮৫৪ সালে দস্তয়েভস্কিকে পাঠানো হয় বাধ্যতামূলক সৈনিকের চাকরিতে। ১৮৫৯ সালে তাঁর সৈনিক জীবন শেষ হয়। আবার তিনি সেন্ট পিটার্স বার্গে পাকাপাকিভাবে বসবাসের অনুমতি পান।
'ফিয়োদর দস্তয়েভস্কি'কে সাধারণত সর্বকালের সেরা ঔপন্যাসিকদের একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সাহিত্যিক আধুনিকতাবাদ, অস্তিত্ববাদ, মনোবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা, ধর্মতত্ত্ব এবং সাহিত্য সমালোচনা তার ধারণা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছে। দস্তয়েভস্কি'র রচনাগুলিকে প্রায়শই ভবিষ্যদ্বাণীমূলক বলা হয়, কারণ তিনি রাশিয়ার বিপ্লবীরা ক্ষমতায় এলে কেমন আচরণ করবে তা এত নির্ভুলভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। যা পরবর্তীতে দেখা যায়। সেই সময়ে তিনি একজন সাংবাদিক হিসেবে তার কার্যকলাপের জন্যও বিখ্যাত ছিলেন।
তার উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে,
'দি হাউজ অফ দি ডেড' (The House of the Dead), প্রকাশকাল ১৮৬০। 'এ ন্যাস্টি স্টোরি'(A Nasty Story), প্রকাশকাল ১৮৬২। 'নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড' (Notes from Underground), প্রকাশকাল ১৮৬৪। 'ক্রাইম এ্যান্ড পানিসমেন্ট' (Crime and Punishment), প্রকাশকাল ১৮৬৬। 'দি গ্যাম্বলার' (The Gambler), প্রকাশকাল ১৮৬৭। 'দি ইডিয়ট' (The Idiot), প্রকাশকাল ১৮৬৯। 'দি র ইউথ' (The Raw Youth), প্রকাশকাল ১৮৭৫। 'দি ব্রাদারস কারামাজভ' (The Brother Karamazov), প্রকাশকাল ১৮৮০। 'এ রাইটার্স ডায়েরী' (A Writer's Diary), প্রকাশকাল ১৮৭৩-১৮৮১, দুইখন্ডে প্রকাশিত।
ফিয়োদর দস্তয়েভস্কি লেখক হওয়ার আগে ছিলেন একজন প্রকৌশলী। তিনি যা আয় করতেন তার সব অর্থই উড়িয়ে দিতেন জুয়া খেলে। বলা হয়ে থাকে জুয়া খেলে সর্বশান্ত হয়ে তিনি সাহিত্য রচনায় হাত দিয়েছেন।
জুয়ায় বার বার হেরে গেলেও সাহিত্য রচনায় বহু বাজি তিনি জিতে নিয়েছিলেন। যদিও নানা রকম শারীরিক অসুস্থতা অথবা অর্থকষ্ট তাঁকে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়ে দিত প্রতিনিয়ত। অবশেষে ১৮৮১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যান না ফেরার দেশে।
মূলঃ এদোয়ার্দো গালিয়ানো ( Children of the days )
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন