জলাতঙ্ক থেকে কি বেঁচে ফেরা সম্ভব?
জলাতঙ্ক শব্দটা শুনলেই আমাদের সর্বপ্রথম মাথায় আসে একজন মুমূর্ষু রোগীর ভয়াবহ অবস্থার প্রতিচ্ছবি — যিনি প্রচণ্ড আতঙ্কে ভুগছেন, প্রচণ্ড পিপাসায় তার গলা শুকিয়ে গেছে অথচ পানি দেখলে বা পান করতে গেলেই ছটফট করছেন, মুখ থেকে বেরোচ্ছে ফেনা, শরীর কাঁপছে, কখনো হিংস্র আচরণ করছেন আবার কখনো অচেতন হয়ে পড়ছেন। সময় যত এগোচ্ছে, তার স্নায়ুতন্ত্র ততই ভেঙে পড়ছে, শ্বাস-প্রশ্বাসে ব্যাঘাত ঘটছে, হৃদস্পন্দন দুর্বল হয়ে আসছে — এবং অবশেষে, একটি ভয়ানক এবং নির্মম পরিণতির মাধ্যমে শেষ হয় তার জীবনের অধ্যায়।
জলাতঙ্ক ভাইরাস, বা র্যাবিস, সাধারণত সংক্রমিত প্রাণীর কামড় বা আঁচড়ের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। যদি যথাসময়ে প্রতিষেধক (vaccine) দেওয়া না হয় তাহলে একবার উপসর্গ শুরু হলে এই অবস্থা থেকে কোনো মানুষের বেঁচে ফেরার সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কোটায় বলেই আমরা জানি। তাই চিকিৎসাবিজ্ঞানে জলাতঙ্ককে আজও মানব ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক রোগগুলোর একটি ধরা হয় যার বিরুদ্ধে উপসর্গ-পরবর্তী কার্যকর প্রতিকার আজও সুনিশ্চিত নয়।
তবে ২০০৪ সালে ঘটে এক অভাবনীয় ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যে ১৫ বছর বয়সী এক কিশোরী (Jeanna Giese) বাদুড়ের কামড়ে জলাতঙ্কে আক্রান্ত হোন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো উপসর্গ শুরু হওয়ার পরও তিনি বেঁচে যান। এটি ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী মুহূর্ত। এই অলৌকিক সাফল্যের পেছনে ছিল এক সাহসী চিকিৎসক ও পরীক্ষামূলক চিকিৎসাপদ্ধতি — Milwaukee Protocol।
ঘটনার শুরু হয় ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১২ তারিখে। সেদিন জিয়ানা তার মায়ের সাথে গির্জায় প্রার্থনা করতে গেলে দেখা যায় গির্জায় অনুপ্রবেশকৃত একটি বাঁদুড় সবার প্রার্থনায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল বলে গির্জার কর্মীরা সেটিকে আঘাতের মাধ্যমে মেঝেতে ফেলে দেয়। আর এই ঘটনা জিয়ানার দৃষ্টিগোচর হলে সে বাঁদুড়টিকে গির্জার বাইরে ছেড়ে দিয়ে আসার চেষ্টা করে এবং এমতাবস্থায় আচমকা বাদুড়টি তার আঙুলে কামড় দেয়। তবে সে এই ব্যাপারটিকে খুবই হালকাভাবে নেয় এবং ভ্যাকসিন না নিয়ে কেবল এন্টিসেপটিক দিয়ে ক্ষত পরিষ্কার করে। আর তার এই সামান্য অসাবধানতাই ডেকে আনে এক ভয়াবহ পরিণতি। প্রায় ১ মাস পর অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে সে জ্বরে ভুগতে শুরু করে। শুরু হয় ক্লান্তি, দৃষ্টিজনিত সমস্যা, বমি, অতিরিক্ত লালার প্রবাহ — এবং ধীরে ধীরে স্নায়ুবিক উপসর্গ।
শিশু সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং চিকিৎসক রডনি উইলোবি রোগীর অবস্থা দেখে উপলব্ধি করেন এটি জলাতঙ্ক হতে পারে এবং পরবর্তীতে CDC (Centers for Disease Control and Prevention) থেকেও পরীক্ষার ফলাফল পজিটিভ আসে। এর পরপরই উইলোবি সিদ্ধান্ত নেন মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়ার বদলে একটি সাহসী ও নতুন পথ বেছে নেবেন।
Dr. Willoughby-এর ধারণা ছিল অনেকটা এমন যে, যেহেতু র্যাবিস মস্তিষ্কের কোষে আক্রমণ করে এবং কোষের কার্যকলাপ ধ্বংসের কারণেই রোগীর মৃত্যু ঘটে তাই যদি মস্তিষ্কের কার্যকলাপ সাময়িকভাবে “বন্ধ” করে রাখা যায় তাহলে ভাইরাসের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে স্নায়ু কিছুটা রক্ষা পাবে এবং ফলশ্রুতিতে শরীর নিজেই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়ার সময় পাবে। র্যাবিসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ওপর করা কেস রিপোর্টগুলো বিশ্লেষণ করে তিনি দেখতে পান যে, র্যাবিসে মৃতদের মস্তিষ্ক মৃত্যুর পর দেখা যায় না খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং যদি রোগীদের মৃত্যুর আগে শ্বাস-প্রশ্বাস ও রক্তচাপ বজায় রাখতে সহায়তা করা যায়, তাহলে মৃত্যুর পর তাদের দেহে ভাইরাস খুঁজে পাওয়া যায় না।
আর এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে তিনি তৈরি করলেন এক পরীক্ষামূলক চিকিৎসা — Milwaukee Protocol।
জিয়ানা-কে ওষুধের মাধ্যমে কৃত্রিম কোমায় পাঠানো হয়। তাকে দেওয়া হয় sedatives (ketamine, midazolam), antiviral ও neuroprotectant ওষুধ (amantadine), এবং antiviral ribavirin। পরে অল্প ডোজে phenobarbital দেয়া হয় কোমা পরিপুর্ণভাবে নিশ্চিত করতে, যদিও এটি মূল পরিকল্পনার অংশ ছিল না। যাইহোক এসব ঔষধ প্রয়োগের উদ্দেশ্য মস্তিষ্কের কার্যক্রম হ্রাস করে ভাইরাসের আক্রমণ থেকে নিউরনগুলোকে রক্ষা করা এবং সেই সময়টায় শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানাতে সুযোগ দেওয়া।
মূলত চিকিৎসকেরা Jeanna-র শরীরকে একটি নিউরোলজিকাল শীতনিদ্রা/হাইবারনেশনে পাঠিয়েছিলেন। উইলোবি বলেছিলেন, এটা ছিল একেবারেই একটি "ধারণা", যার পেছনে কোনো পরীক্ষিত তথ্য ছিল না। কিন্তু জিয়ানা গিজের অভিভাবকরা সম্মতি দেন। শুরুতে জিয়ানা নির্দিষ্ট কিছুদিন কোমায় ছিলেন। এরপর ধীরে ধীরে তার স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকলাপ পুনরুদ্ধার হয় এবং দীর্ঘ পুনর্বাসনের মাধ্যমে তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন।
সপ্তাহখানেক পর ঔষধের ডোজ কমানোর ফলে কৃত্রিম কোমা থেকে ধীরে ধীরে জিয়ানা যখন জেগে ওঠেন তখন তিনি পুরোপুরি প্যারালাইজড — কিন্তু তিনি জীবিত ছিলেন, যা নিঃসন্দেহে একটি বড় অর্জন। দিনদিন ডাক্তাররা যখন অ্যানেস্থেসিয়ার পরিমাণ কমাচ্ছিল তখন জিয়ানার ধীরে ধীরে রিফ্লেকশন আসা শুরু করে। দুই সপ্তাহের মধ্যে তিনি উঠে বসতে এবং চারপাশে তাকাতে শুরু করলেন এবং তিনি একটি দীর্ঘ, কঠিন পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু করলেন। তার ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে লিখিত তথ্যমতে, “কথা বলা, হাঁটা, দাঁড়ানো, জিনিস তুলে ধরা, নির্দেশ করা, খাওয়া, পান করা, সবকিছু একটি শিশু যা শেখে” এই সবকিছু তাকে পুনরায় শিখতে হয়েছিল (যেহেতু সে প্যারালাইজড ছিল)। ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে জিয়ানা হাসপাতাল ছাড়েন। রোগ নির্ণয়ের এক বছর পর তিনি রেবিস গবেষকদের একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বক্তৃতা দেন এবং ২০১১ সালে তিনি কলেজ থেকে স্নাতক হন, যেখানে তার চিকিৎসক উইলোবি উপস্থিত ছিলেন।
তবে ২০০৫ সালে জিয়ানা গিজ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেলেও পরবর্তী দুই বছর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারেননি ডাক্তার উইলোবি। কেননা যেহেতু এটাই সুস্থতার প্রথম রেকর্ড এবং জলাতঙ্ক থেকে আরোগ্যের বিষয়ে এর আগে তার কোনো ধারণা ছিল না তাই তাই গিজের পুনরায় জলাতঙ্কে আক্রান্ত হওয়া কিংবা ধীর্ঘ মেয়াদি অন্য কোনো সমস্যা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তাছাড়া এরই মধ্যে তার মনে বেশকিছু প্রশ্নও ছিল। গিজ কেন বেঁচে গেল? সে কি র্যাবিস দ্বারা পরিপূর্ণভাবে সংক্রমিত ছিল নাকি তার সংক্রমণের ধরণ ছিল হালকা কিংবা অস্বাভাবিক? নাকি সত্যিই প্রটোকৌলই তাকে বাঁচিয়েছে? আর যদি তাই হয় সেক্ষেত্রে প্রটোকৌলের কোন উপাদানগুলো জীবন বাঁচানোর ক্ষেত্রে দায়ী? তার এই পদ্ধতি কি বাকিদের উপর কাজ করবে?
উইলোবি ও তার সহকর্মীরা জিয়ানা গিজের এই আরোগ্য লাভের ঘটনাটি CDC (Centers for Disease Control and Prevention) এর “রোগ ও মৃত্যু সাপ্তাহিক প্রতিবেদন”-এ এবং নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে রিপোর্ট করেছিলেন। তাছাড়া উইসকনসিন মেডিকেল কলেজ বিস্তারিত চিকিৎসা পদ্ধতি সহ একটি ওয়েবসাইট তৈরি করেছিল (যা মিলওয়াকি প্রোটোকল নামে পরিচিত হয়েছিল) এবং একটি রেজিস্ট্রিও তৈরি করেছিল যেখানে চিকিৎসকরা প্রোটোকল ব্যবহার করে তাদের অভিজ্ঞতার বিবরণ রেকর্ড করতে পারতেন। উইলোবি আশা করেছিলেন যে বছরে হাজার হাজার জলাতঙ্কের মারাত্মক ঘটনা ঘটলে, অন্যান্য চিকিৎসকরা এটি ব্যবহার শুরু করবে এবং ছয় মাসের মধ্যে তার কাছে একটি উত্তর থাকবে সেই প্রশ্নগুলোর।
যাইহোক, যে Milwaukee Protocol ইতিহাসের প্রথমবারের মতো কোনো জলাতঙ্কের রোগীকে সুস্থ করে তোলার কর্তৃত্ব অর্জন করেছিল সে চিকিৎসা পদ্ধতিটি তেমন উল্লেখযোগ্য স্বীকৃতি তো পায়নি বরং অনেক জলাতঙ্ক গবেষক তার এই প্রটোকৌল এর তীব্র সমালোচনা করেছেন এই চিকিৎসাটিকে “অনৈতিক” অবহিত করে। বহু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এই পদ্ধতিটি আসলে কার্যকর নয়, বরং ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা পদ্ধতিতে করা ৫১টি প্রচেষ্টাতে দেখা যায়, যার মধ্যে মাত্র ৭ জন বেঁচে আছেন, অর্থাৎ, সাফল্যের হার মাত্র ১০–১৫ শতাংশ। আবার বেঁচে যাওয়া এসব লোকেদের মধ্যে কারো কারো শারীরিক প্রতিবন্ধকতার রেকর্ডও রয়েছে। তবে উইলোবি মনে করেন, প্রায় অর্ধেক ক্ষেত্রে তার এই প্রটোকৌল কঠোরভাবে মানা হয়নি এবং এতদিনে এই পদ্ধতির সংশোধিত রূপ আরও নিরাপদ ও কার্যকর হতে পারে।
যদিও উইলোবি মনে করেন তার উদ্ভাবিত এই চিকিৎসা পদ্ধতি অধ্যয়ন যোগ্য তবে সমালোচকরা তা মোটেও মনে করেন না। এরমধ্যে ম্যানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালান জ্যাকসন ২০১৩ সালে অ্যান্টিভাইরাল রিসার্চ জার্নালে প্রকাশিত একটি পর্যালোচনায় বলেছেন, “এই প্রোটোকলটির ব্যবহার বন্ধ করা উচিত।” আবার, অনেকে সমালোচকরা মনে করেন যারা জলাতঙ্ক থেকে বেঁচে গেছেন তারা হয়ত এমনিতেই বেঁচে যেতেন। জিয়ানার বেঁচে থাকা হয়ত তার শক্তিশালী ইম্যিউন সিস্টেমের ফলাফল — কোনো চিকিৎসার কারণে নয়। এই ধারণাকে সমর্থন করার জন্য প্রমাণ হিসেবে দাঁড় করানো হয় যে, র্যাবিস সংক্রমণ সবসময় মারাত্মক হয় না। তাছাড়া, সমস্ত আক্রান্ত প্রাণী এই রোগে মারা যায় না, এবং পেরুর প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে সংক্রামিত ভ্যাম্পায়ার বাদুড় খুবই কমন, সেখানে গবেষণায় দেখা গেছে যে কিছু লোকের জলাতঙ্কের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি রয়েছে যদিও তারা কখনও টিকা গ্রহণ করেনি।
যাইহোক, চিকিৎসক উইলোবির উদ্ভাবিত এই Milwaukee Protocol সমস্ত সমালোচনাকে পাশ কাটিয়ে আদৌ কোনোদিন সর্বজনস্বীকৃত হতে পারবে কি না, নাকি চিকিৎসাবিজ্ঞানের কল্যাণে ভবিষ্যতে জলাতঙ্কে আক্রান্ত রোগীদের জীবন বাঁচাতে আরো কার্যকর কোনো পদ্ধতি উদ্ভাবিত হবে তার উত্তর হয়ত সময়ই বলে দিবে। তবে বর্তমানে উইলোবি এবং তার চিকিৎসা পদ্ধতির সমালোচকগণ, উভয় পক্ষ এই বিষয়ে একমত যে, প্রতিরোধই জলাতঙ্কের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র। Milwaukee Protocol-এ একজন রোগীর চিকিৎসার খরচ যেখানে ৮ লক্ষ ডলার, সেখানে সেই খরচে হাজার হাজার শিশুদের ভ্যাকসিন দেওয়া সম্ভব। তাই বর্তমানে বিশ্বজুড়ে কুকুরের টিকাদান ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি এই ভয়াবহ রোগ থেকে বাঁচার সবচেয়ে কার্যকর পথ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন