পরির সাথে সহবাস
লেখক: Mehedi Hasan Shohag
নিচিন্তপুর গ্রাম। রাজশাহীর বাঘা থানার পুরনো একটা গ্রাম, যেখানে আধুনিকতার ছোঁয়া সামান্যই লেগেছে। বিকেলের পর পরই গোটা গ্রামটা কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে যেত। বাতাসেও ভেসে বেড়াতো এক অদ্ভুত শীতলতা, যেন অদেখা কারো ছোঁয়া। গ্রামের এক কোণে ছিল সেই ভয়ঙ্কর কুঠি আর কবরস্থান ঘেরা বাঁশঝাড়। গ্রামের বয়স্করা বলত,
"ওখানে গেলে মানুষের আত্মা আর ফেরে না। সেখানে রাত নামলে পরি ঘুরে বেড়ায়!"
রিহান ছিল শহরের ছেলে, সাহস আর কৌতূহলের মিশ্রণে পাগল। ভয়ংকর গল্প শুনলেই তার মন আনচান করত। ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে এসে সে শুনল বাঁশঝাড়ের সেই পরির কাহিনি।
কীভাবে এক মেয়েকে তার প্রেমিক প্রতারণা করে হত্যা করে বাঁশঝাড়ের পাশে কবর দেয়। সেই মেয়ে পরিণত হয় এক অশরীরী আত্মায়, যাকে সবাই পরি বলে ডাকত। যাকে রাতের অন্ধকারে দেখা যেত সাদা জামা পরে বাঁশঝাড়ের আশেপাশে হেঁটে বেড়াতে।
গ্রামবাসীরা বারবার সতর্ক করেছিল রিহানকে —
"ওই জায়গার দিকে তাকাবি না, ও তোর প্রাণ ছিঁড়ে নিবে!"
কিন্তু রিহান হাসত।
"ভৌতিক কাহিনিগুলো শুধুই মনের ভ্রম।"
এ কথা ভেবে এক পূর্ণিমার রাতে, যখন চাঁদের আলোয় গোটা গ্রাম সাদা রুপালি কাপড়ে মোড়ানো মনে হচ্ছিল, রিহান একাই রওনা দিল সেই কুঠির দিকে।
বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে হাঁটতেই তার মনে হলো, বাতাস থমকে গেছে। পায়ের নিচে মাটি যেন নরম হয়ে উঠেছে। দূরে, কুঠির সামনে সে দেখল — এক মেয়ে, সাদা জামা পরে, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার লম্বা চুল হাঁটু ছুঁয়ে যাচ্ছে। মৃদু মৃদু হাওয়ায় ওড়া চুলের ফাঁক দিয়ে কখনও কখনও এক জোড়া গভীর কালো চোখ দেখা যাচ্ছিল।
"তুমি কে?" — রিহান সাহস করে প্রশ্ন করল।
মেয়েটি মাথা তুলল। চোখে ছিল বিষণ্ণতা আর চিরন্তন এক আকাঙ্ক্ষা। ঠোঁটে মৃদু হাসি, গলার স্বর নরম,
"আমি অপেক্ষা করছি... সেই সত্যিকারের ভালোবাসার জন্য। তুমি কি আমার সেই ভালোবাসা?"
রিহান হারিয়ে গেল তার চাহনিতে।
সে আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। নিজের অজান্তেই মেয়েটির হাত ধরল। হাতটি ছিল ঠাণ্ডা, মৃতের মতন শীতল, অথচ গভীরভাবে আকর্ষণীয়।
সে তাকে নিয়ে গেল কুঠির ভেতর। চারদিকে ভাঙা দেয়াল, ভেজা মাটি আর বাতাসে অদ্ভুত ঘ্রাণ — পচা ফুল আর আগরবাতির মিশ্র গন্ধ।
সেই রাতে, রিহান আর সেই পরির মধ্যে এক অদ্ভুত মিলন হলো। ভালোবাসা আর আতঙ্কের মিশ্রণ।
মেয়েটির স্পর্শে সে যেন জীবনের চূড়ান্ত সুখ খুঁজে পেল, আবার একই সাথে মৃত্যুর দংশন অনুভব করলো।
মিলনের মুহূর্তে চারপাশের বাতাস ঘন কালো হয়ে গেল, যেন সমগ্র জগৎটাই হারিয়ে গেল তাদের চারপাশ থেকে। রিহানের শরীর শক্তি হারাতে থাকলো, মনে হচ্ছিল আত্মাটাও টেনে নিচ্ছে কোনো গভীর অতল গহ্বরে।
ভোর হতেই রিহান জ্ঞান হারাল। যখন চোখ খুলল, তখন সে নিজেকে পেল কুঠির ভেতর পড়ে থাকা অবস্থায়। পরি উধাও।
কিন্তু তার শরীরের ভেতর কিছু যেন বদলে গেছে। সে এখন আর আগের রিহান নয়। তার শরীর জড়ানো ছিল এক ঠাণ্ডা অদৃশ্য বন্ধনে। চোখের পলক ফেললেই সে দেখতে পেত — দূরে দাঁড়িয়ে হাসছে সেই পরি, ডাকছে তাকে।
গ্রামবাসীরা পরদিন সকালে তাকে কুঠির সামনে অজ্ঞান অবস্থায় খুঁজে পায়। রিহান বেঁচে ফিরলেও, তার হাসি মলিন হয়ে গেল, চোখে চিরন্তন এক শুন্যতা।
রাতের বেলা মাঝেমধ্যে সে চুপচাপ বাঁশঝাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকত — যেন অপেক্ষা করছে কারো জন্য।
কিছুদিন পর থেকেই গ্রামের মানুষ লক্ষ করলো — রিহান আর মানুষিকভাবে স্বাভাবিক নেই। তার চোখে মাঝে মাঝে অদ্ভুত জ্বলজ্বল করা আলো দেখা যেত। রাতে, বাঁশঝাড়ের দিক থেকে ভেসে আসত তার হাসির আওয়াজ আর মৃদু কান্না।
গ্রামবাসীরা জানে, রিহান আর সম্পূর্ণ মানুষ নেই।
সে এখন পরির সহচর — অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক অশরীরী।
প্রতিটি পূর্ণিমা রাতে, নিশ্চিন্তপুরের বাঁশঝাড়ে দেখা মেলে দুইটি ছায়ার — এক মেয়ের আর এক ছেলের — যারা চিরকাল একে অপরের সাথে মিলিত হয়ে হারিয়ে যায় অন্ধকারে।
আর গ্রামের বয়স্করা এখনো ফিসফিসিয়ে বলে —
"পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ভালোবাসা কখনো কখনো সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হয়। পরির সাথে সহবাস করা মানে নিজের জীবন বিসর্জন দেওয়া..."
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন