প্রথম যেদিন দেখলাম বড় মেয়ের বরের সাথে হাতাহাতি করে ছোট মেয়েটা চিপস খাচ্ছে ভালো লাগেনি। সাথে সাথে আমার মিসেস কে ডেকে বললাম - নিশা কে বলবা দিশার বরের সাথে এত মাখামাখি না করতে।
আমার স্ত্রী তো রেগে আগুন। সে বলল - ছোট মানুষ দুলাভাই এর সাথে একটু দুষ্টামি করে এতেও তোমার সমস্যা?
আমি আর কথা বাড়ালাম না। আমার স্ত্রীর সাথে তর্কে পারবো না। তাও আবার নিশার ব্যাপারে।
বিয়ের অনেক বছর আমাদের সন্তান হচ্ছিলোনা। এরপর কলিগ ও বন্ধুদের কথায় একজন মেয়ে সন্তান পালক নেই। সবাই বলছিলো পালক বাচ্চা নিলে এরপর আল্লাহ খুশি হয়ে বাচ্চা দেন। সে কথার উপর বিশ্বাস রেখে একদম ছোট মা মরা ১৩ দিনের দিশাকে মাত্র ৫ হাজার টাকায় তার দাদির থেকে কিনে ঘরে আনি। আমার স্ত্রী খুব খুশি ছিলো। একদম পুতুলের মত আদর যত্ন করতো। আমিও তাকে অনেক আদর করতাম। দিশাকে বাসায় আনার পর থেকে আমার রহমত বরকত বেড়ে গেলো।
বছর না ঘুরতেই আল্লাহর রহমতের দুয়ার খুলে গেলো। আমার স্ত্রী ৮ বছর পর সন্তান সম্ভাবা। নিশা হওয়ার আগে পর্যন্ত আমার স্ত্রী দিশাকে চোখে হারাতো। এত আদর করত যে আমার দেখেই শান্তি লাগতো।
কিন্তু নিশা হবার পর থেকেই আমার স্ত্রী দিশাকে তেমন যত্ন করত না। কেমন যেন আপন পরের খেলা শুরু হয়ে গেলো। মেয়ে দুইটা বড় হচ্ছিলো পিঠাপিঠি। আমি দুইজনকে সমান আদরই করতাম। কোনদিন আমার আদরের ঘাটতি ছিলো না।
দিশা ছিলো ভীষন মায়াবি সাথে মেধাবিও।
নিশার গায়ের রং শ্যামলা। আমার মত দেখতে হয়েছে। এতে তার মায়ের চিন্তার কোন শেষ নাই।
তাই দিশার কলেজে পরা অবস্থাতেই সে আমাকে খুব বুঝিয়ে বাঝিয়ে দিশার জন্য পাত্র দেখতে বলে। আমি রাজি ছিলাম না। তারপর কোন এক হুজুগের মাথায় রাজি হয়ে গেলাম। ভালো ভালো সম্মন্ধ আসা শুরু করলো। এর মধ্যে একজনের সাথে কথায় বনিবানা হয়ে যাওয়ায় সেখানে বিয়ে ঠিক করি।
দিশা সাহস করে মানা করতে পারে নি। কারন এত বছরে সে জেনে গেছে সে পালিতা সন্তান। আর সেটা আমার স্ত্রী একদিন রাগের মাথায় বলেই ফেলল। আমি দিশাকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছি যে - তোমার মা রাগ হয়ে একথা বলেছে। এটা সত্য না।
কিন্তু মেয়ে আমার ততদিনে জেনেই গিয়েছে মায়ের আচরন ছোট থেকে তার যাথে ভিন্ন হবার কারণ ছিলো সে পালিতা।
তাই আর মেয়ে মুখ ফুটে বলতে পারেনি সে বিয়েতে এখন রাজি না। সে পড়তে চায়।
আর আমার স্ত্রীর জোরে আমিও আর কিছু বলতে পারিনাই।
এদিকে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়ে গেলো।
দিশার এর মধ্যে ইন্টারমিডিয়েটের রেজাল্ট হলো। সব বিষয়ে এ+ পেলো মেয়ে আমার।
ঠিক অপরদিকে আমার আপন সন্তান পড়াশোনায় তেমন ভালো ছিলো না।
দেখতে দেখতে বিয়ের দিন চলে আসলো।
দিশাকে বিয়ে দিয়ে বরের হাতে তুলে দিলাম।
ও বাসা ছাড়ার পর খুব হাহাকার লাগত আমার। আমার স্ত্রী বলত - পালক পালকই! দেইখো বিয়ের পর এই মেয়ে তোমার কোন খোঁজ নিবে না।
কিন্তু তাকে মিথ্যা প্রমান করে দিশা আমার অনেক খোঁজ খবর রাখত।
সুযোগ পেলেই বেড়াতে আসতো।
বিয়ের ৭ মাস পার হয়ে গেলো। মেয়েকে সুখীই মনে হতো। হাসিখুশি দেখলে সবার তাই মনে হওয়া স্বাভাবিক।
সেদিন নিশার সাথে দিশার বরের ওমন মাখা সম্পর্ক আমার একার চোখে ধরা দেয়নি। অনেক আগে থেকেই দিশা তা টের পেয়েছিলো।
সেদিন বাসা ছাড়ার সময় দিশা বলল - আব্বা আমি এখন মাসে মাসে বেড়াতে আসবো না। আপনি যায়েন আম্মাকে নিয়ে আমার বাসায়।
আমি এর মধ্যে অন্য কিছু নিয়ে ভাবি নি।
একদিন হুট করে দিশা রাতে এসে বাসায় উঠলো।
চোখ মুখ ফোলা। গালে চড়ের দাগ।
আমি তাড়াহুড়ো করে তাকে হাত ধরে খাটে বসিয়ে পানি খেতে দিলাম। আর জিজ্ঞাসা করলাম - কি হয়েছে তোমার?
সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।
আমার স্ত্রী বলল - কি রে জামাই কোথায়? একা আসছিস কেন এত রাতে? কি হইসে?
দিশা কান্না করে বলল - আপনাদের একটা কথা বলি বলি করে বলা হয়নি। আমার বরের সাথে …
বলে থেমে গেলো।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম - কি হইসে সাঈফের? ঝগড়া হইসে?
আমার স্ত্রী পাশ থেকে বলল - তোর কি অন্য কারো সাথে সম্পর্ক আছে? আমি আগেই টের পাইসিলাম।
আমি ধমক দিয়ে তাকে থামালাম।
দিশা চোখ মুছতে মুছতে বলল
- আব্বা নিশা আর সাঈফ বিয়ের পর থেকেই অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে আছে।
এই কথা শুনে পায়ের নিচ থেকে মাটি সড়ে গেলো।
আমার স্ত্রী ততক্ষনে দিশার দিকে এগিয়ে আসছে তাকে মারবে। আমি থামালাম। আর দিশাকে বললাম - তুমি কবে থেকে জানো? আর কিভাবে জানো?
সে বলল - আমি আগে থেকে ওদের সম্পর্কের ব্যাপারে আঁচ করেছিলাম। কিন্তু এ নিয়ে কাউকে কিছু বলিনি। আমার স্বামী বাসায় দেরি করে ফিরতো। বাসায় ফিরে সে ঘন্টার পর ঘন্টা মোবাইলে নিশার সাথে আজেবাজে কথা বলত। যেদিন জানতে পেরেছি সেদিন জিজ্ঞাসা করায় সে বলে শালির সাথে এতটুক দুষ্টামি করা স্বাভাবিক। আমি শেষবারই আপনাদের বলতে চেয়েও আটকে গিয়েছি। এজন্য এবার বাসায় যাওয়ার পর আমাকে সে বারবার বলার পরও আপনাদের বাসায় আসিনি। তারা বাইরে দেখা করত। আবাসিক হোটেলে সময় কাটাতো। কিন্তু আমার কাছে কোন প্রমান ছিলো না। আজ আমি তাকে বলি আমি সকালে আমার এক বান্ধবীর বাসায় যাবো। সারাদিন থাকবোনা। এই বলে বেড়িয়ে যাই। ওর আজ সাপ্তাহিক ছুটি ছিলো তাই সে বাসাতেই ছিলো..
আমি ওত পেতে থাকি বাসার নিচে এক চায়ের দোকানে মুখ লুকিয়ে বসে থাকি। আমার মন বলছিলো আজ নিশা আমার বাসায় আসবেই আসবে।
আমি ভুল ছিলাম না। নিশা আসলো আর আমাদের বিল্ডিং এ উঠে গেলো।
তার ১৫ মিনিট পর আমি বাসায় উঠে গেলাম। গিয়ে দুইজনকে ওমন অপ্রস্তুত অবস্থায় দেখে চিৎকার করে উঠি। শুরুতে দুইজনই নানান মিথ্যা বলতে থাকলেও নিশা একসময় রেগে বলল - তুই যদি সুখ দিতে পারতি তাহলে আর বিয়ের ১ মাস পর থেকে তোর জামাই আমাকে নিয়ে হোটেলে হোটেলে ঘুরত না।
ওতটুক মেয়ের কথা শুনে আমি ওকে চড় মারি।
আর আমার স্বামী সাথে সাথে আমাকে এলোপাথাড়ি মারতে থাকতে। বলতে থাকে - তুই কি ওর যোগ্য? তুই ওর গায়ে হাত তুললি?
আমি লজ্জায় অপমানে একমুহূর্ত না দাড়িয়ে কতক্ষন ট্রেন লাইনে হাটি। যেন ট্রেনে কাটা পরি। কিন্তু সে সাহস শিক্ষা আমি পাই নি। তাই দিনশেষে আপনাদের কাছে আসলাম।
আমার স্ত্রী এই বিষয় একদম মেনে নিতে নারাজ। সে উল্টো দিশাকে দোষী বলছে।
নিশা তখনো বাসায় নেই। সে বাসা থেকে বলে বের হয়েছিলো আজ সে তার বান্ধবীর বাসায় থাকবে। কারণ তার সামনে কলেজে ভর্তি পরীক্ষা। অনেক পড়তে হয়। গ্রুপ স্টাডি।
আমি নিশাকে ফোন দেই। সে ফোন রিসিভও করে।
তাকে বলি সে এখন কোথায়?
খুব সহজ ভাবে সে বলে - আমি আর বাসায় ফিরবো না। সাঈফ আমাকে ভালোবাসে। আমি ওকে ভালোবাসি। তোমার বড় মেয়েকে ও ছেড়ে দিবে। আর আমরা বিয়ে করে নিবো।
কথাগুলো ফোনের স্পীকারে শুনে আমার স্ত্রী কান্নায় ভেঙ্গে পরে। সে অনেক বুঝানোর পরও মেয়ে একটু নরম হয়না। বরং ফোন কেটে দেয়। আমি সাঈফকে ফোন দিলে সে আমার ফোন রিসিভই করেনা।
এরপর তার পরিবারকে জানাই। উল্টো দোষ হয় আমাদের। আমরা নাকি মেয়েদের শিক্ষাই দেই নি। এতে তাদের কিছু করার নেই।
নিরূপায় হয়ে সাঈফের বাসায় যাই। সেখানে নিশা আমাকে লুকিং গ্লাসে দেখে দরজাই খুলে নি। আমি জানতাম সে ঘরের ভেতরেই আছে। ফোনের রিং শুনতে পাচ্ছিলাম দরজার বাইরে থেকে।
চলে আসি বাসায়।
বাসায় এসে দেখি দিশা কান্না করছে। কারণ আমার স্ত্রী তাকে মেরেছে এই বলে যে সে ইচ্ছা করে নিশার জীবনটা নষ্ট করেছে। দিশার হাতে তখন ডিভোর্স লেটার। আমি আমার স্ত্রীকে থামিয়ে শান্ত করাই।
পরদিন সেও যায় সাঈফের বাসায়। দারোয়ান বলে তারা কক্সবাজার গিয়েছে। এখানে আমাদের বাসার কেউ আসলে যেন ঢুকতে না দেয়।
অপমানে আমার স্ত্রী বাসায় এসে এক সপ্তাহ রুম থেকে বের হয়নি। দিশা জোর করে তাকে খাইয়েছে।
গল্প- শত হলেও মা।
পর্ব ১
জাকিয়া হোসেইন তৃষা
নেক্সট পার্ট গুলো সবার আগে নতুন পেজে দেয়া হবে নীল লেখায় চাপ দিয়ে নতুন পেজে ফলো করুন 👉 শুন্য-𝐂𝐡𝐢𝐫𝐤𝐮𝐭
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন