প্যারিসের এক দোকানে মাইকেল মধুসূদন দত্তের চোখে পড়ল বিদ্যাসাগরের বই। মাইকেল দোকানদারকে বললেন এই লেখক আমার একজন মস্ত বন্ধু। মাইকেল মধুসূদনের জীবনে বন্ধুর থেকে আরও বেশি কিছু ছিলেন বিদ্যাসাগর। বিদেশে টাকার অভাবে মাইকেল চরম দূর্ভোগে,পরিত্রাতা বিদ্যাসাগর মহাশয়। ব্যারিস্টারি পাশ করে কলকাতা হাইকোর্টে প্রাকটিসের জন্য অনুমতি প্রার্থনা। কিন্তু মাইকেলের চরিত্র নিয়ে আপত্তি একাধিক বিচারপতির। চরিত্র সম্বন্ধে কয়েকখানা উপযুক্ত সার্টিফিকেট পেলে আশা আছে। মাইকেল একাধিক প্রশংসাপত্র যোগাড় করেছেন। ১৮৬৭ সালে বিদ্যাসাগর মহাশয়,রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারী একসাথে মাইকেল কে প্রশংসাপত্র দিয়েছেন। ১৮৬৭ সালের ৩ মে জজেরা একমত হয়ে মাইকেল কে কলকাতা হাইকোর্টে ব্যারিস্টারি করার অনুমতি দিলেন।
মাইকেল ফ্রান্সে এসেছেন বছর খানেক হল দেশ থেকে এক কানাকড়িও আসেনি। চরম দুর্দশা বললে কম বলা হয়। জিনিসপত্র সব বন্ধক সঙ্গে প্রচুর ধারদেনা। এমন অবস্থা মাইকেল প্রায় জেলে যায়। তখন তিনি বিদ্যাসাগরের শরণ নিলেন। চিঠি দিলেন পরপর দুটো। মাইকেল নিশ্চিন্ত নন দুটো চিঠি লিখেও, যদি বিদ্যাসাগর চিঠিগুলো না পেয়ে থাকেন! জীবনযুদ্ধে বেঁচে থাকা কত কঠিন প্রতি মুহূর্তে অনভূত হচ্ছে।স্ত্রী,কন্যা নিয়ে উপোস করার মত অবস্থা। বাধ্য হয়ে এক পাদ্রীর থেকে পঁচিশ ফ্রাঁ ধার করলেন। কয়েক দিনের মধ্যে একটু আশার আলো দেখা গেল। দিগম্বর মিত্র আটশো টাকা পাঠিয়েছেন। তবে মাইকেলের ধার দেনার যা বহর আটশো টাকা কিছুই নয়। একদিন হেনরিয়েটা কাঁদতে কাঁদতে মাইকেলের পড়ার ঘরে এসে বললেন ছেলেমেয়েরা মেলায় যেতে চায়, কিন্তু তাঁর কাছে আছে মাত্র তিন ফ্রাঁ। সংসারে অভাব, অনটন মারাত্মক। মাইকেল হেনরিয়েটা কে মনখারাপ করতে নিষেধ করে বললেন আজই ডাক আসবার কথা ছিল, সুখবর নিশ্চয়ই আসবে। কেননা তিনি যাঁর কাছে টাকার জন্য আবেদন করেছেন তাঁর প্রতিভা,জ্ঞান প্রাচীন ঋষিদের মত,শক্তি ইংরেজদের সমতুল,প্রাণ বাংলার মায়েদের মত। মাইকেল ভুল কিছু বলেন নি, একঘন্টা বাদে বিদ্যাসাগরের চিঠি এল।দেড়হাজার টাকা তিনি পাঠিয়েছেন। সত্যি হল বারবার টাকা দিয়ে মাইকেলকে বাঁচিয়েছেন বিদ্যাসাগর, তিনিই তাঁর আসল পরিত্রাতা।
অবশ্য ততদিনে মাইকেলের কলমে সৃষ্টির জোয়ার, মেতে উঠেছেন সৃষ্টি সুখের উল্লাসে। সংক্ষিপ্ত সময়,সংখ্যায় পাঁচ বছরে মাইকেল বাংলা নাটক ও কাব্যকে নিস্তরঙ্গ পুষ্করিণী থেকে মহাসমুদ্রে পরিণত করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে ফেলেছেন। মধুসূদনের 'তিলোত্তমাসম্ভব' কাব্য প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৬০ সালের মে মাসে। অমিত্রাক্ষর ছন্দে সেই প্রথম বাংলা কাব্য লেখা হল। গোড়ার দিকে মাইকেলের অমিত্রাক্ষর বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পছন্দই হয় নি। কিন্তু কিছুদিন পরে বিদ্যাসাগরের মতের পরিবর্তন হয়। মাইকেল যা লেখেন সব কিছুর মধ্যে তিনি ' Great merit' দেখতে পান।
তবে অভাব,অভাব মাইকেলের নিদারুণ অভাব। অভাবের শেষ নেই। তাতে কি একদিন একটা ঠিকাগাড়িতে বিদ্যাসাগরের বাড়িতে এলেন মাইকেল। কোচম্যানকে দিলেন আধুলি নয়,টাকা নয় আস্ত মোহর। কোচম্যানকে এত বেশি দেওয়া আদপে অপব্যায়,বিদ্যাসাগরের কাছে দু-চার কথা মাইকেল কে শুনতে হল। কিন্তু তিনি যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বললেন, বিদ্যাসাগর আজ দুদিন যাবৎ এই কোচম্যান আমাকে নানা জায়গায় নিয়ে গিয়েছে। ওকে বেশি আর কী দিলাম! ব্যারিস্টার মাইকেল দেশে ফিরলে তাঁর জন্য সুকিয়া স্ট্রীটে একটা বাড়ি সাহেবি কায়দায় বিদ্যাসাগর সাজিয়ে রেখেছিলেন। মাইকেল সেখানে না উঠে স্পেনসেসের মত বিলাশবহুল হোটেলের তিনটে ঘর ভাড়া নিয়েছেন। একা মানুষ,ব্যারিস্টারি করে অর্থাগম হয় কিন্তু ব্যায় করেন অনেক বেশি।ঢালাও হাতে খরচ করেন, বন্ধুবান্ধবরা খাওয়া দাওয়া করেন।মাসে হাজার টাকার কমে চলে না। হেনরিয়েটা ও ছেলেমেয়েদের জন্য তিন- চারশ টাকা বিদেশে পাঠাতে হয়। আগের ঋণ শোধ হয়নি আবার বিদ্যাসাগরের কাছে ধার চাইলেন মাইকেল।
বিদ্যাসাগর মহাশয় কে অবশ্যই অগাধ শ্রদ্ধা করতেন মাইকেল। ১৮৬৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি লন্ডন থেকে তিনি বিদ্যাসাগরকে চিঠিতে লেখেন: My trust in God and after god in you. এর ছয় বছর আগে মাইকেল বিদ্যাসাগরের একটা স্ট্যাচুর জন্য নিজের মাইনের অর্ধেক টাকা চাঁদা দিতে রাজি হয়েছেন। সেজন্য রাজনারায়ণ বসু কে চিঠি লিখেছেন। আবার বিদ্যাসাগর স্বয়ং তাঁর স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ চাঁদা দিতে রাজি হননি।
ব্যারিস্টারি ছেড়ে মাইকেল কিছুদিন চাকরি করলেন। অভাব কিছুতেই দূর হয় না। এদিকে শরীর ভেঙে গিয়েছে। চাকরি ছেড়ে ১৮৭২ সালে আবার ব্যারিস্টারি আরম্ভ করলেন। তখন স্বাস্থ একেবারে ভেঙে পড়েছে,শরীরে অনেক অসুখ।বিপুল ঋণ। বছর ঘুরতে না ঘুরতে মাইকেল মৃত্যুশয্যায়। বালবন্ধু গৌরদাস মধুকে দেখতে যান এবং দেখতে পান — ‘‘সে তখন বিছানায় তার রোগযন্ত্রণায় হাঁপাচ্ছিল। মুখ দিয়ে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছিল। আর তার স্ত্রী তখন দারুণ জ্বরে মেঝেতে পড়ে ছিল।’’
পরদিন মাইকেলকে ভর্তি করানো হয় আলিপুরের জেনারেল হাসপাতালে, গলার অসুখ তো ছিলই, যকৃতের সিরোসিস থেকে দেখা দিয়েছিল উদরী রোগ।
১৮৭৩ এর ২৬ জুন হেনরিয়েটা চলে গেলেন। মাইকেল এই সংবাদ এক পুরনো কর্মচারীর কাছ থেকে জানতে পারলেন। ২৯ জুন রবিবার মাইকেলের অন্তিম অবস্থা ঘনিয়ে এল। বেলা দুটোর সময় চিরঘুমের দেশে চলে গেলেন মধু কবি। তবে বেদনার বিষয় মৃত্যুর পর মাইকেলের শেষকৃত্য নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। কলকাতার খ্রিস্টান সমাজ তাঁকে সমাহিত করার জন্য মাত্র ছয় ফুট জায়গা ছেড়ে দিল না। কবির মরদেহে পচন ধরল। অবশেষে এগিয়ে এলেন অ্যাংলিকান চার্চের রেভারেন্ড পিটার জন জার্বো। বিশপের অনুমতি ছাড়াই, জার্বোর উদ্যোগে, ৩০ জুন বিকেলে, মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টারও পরে লোয়ার সার্কুলার রোডের কবরস্থানে মাইকেলকে সমাধিস্থ করা হয়।
মাইকেলের মৃত্যুর অনেক গুলো বছর পরে কয়েকজন ভদ্রলোক উদ্যোগী হলেন মাইকেলের সমাধিস্থলের উপর কোনও স্মৃতিস্তম্ভ নেই, কোনও চিহ্ন নেই।চাঁদা তুলে একটা স্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে অস্থি পঞ্জর রক্ষা করতে হবে। চাঁদার জন্য বিদ্যাসাগরের কাছে লোক গেলে বিদ্যাসাগরের চোখে জল চলে এল। বিনীত নিবেদন করে লোকদের তিনি বললেন দ্যাখো, প্রাণপণ চেষ্টা করে যাঁর জান রাখতে পারিনি তাঁর হাড় রাখবার জন্য আমি ব্যস্ত নই।
পুস্তক ঋণ,করুণাসাগর বিদ্যাসাগর ,ইন্দ্র মিত্র